বাংলাদেশের ‘সেরা সময়’
১.
ইমরান তাহি্র বোধহয় গুগলি করতে চেয়েছিলেন। গুগলি হলো না ঠিক। লিটন দাস মিড-উইকেটের ওপর দিয়ে বাউন্ডারিতে পাঠালেন বল। চার। ইতিহাস। চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে গর্জন উঠলো। উঠলো কি গোটা বাংলাদেশেই!
কিন্তু লিটনদের ‘উদযাপন’-এ সেই আভাস পাওয়া গেল কই? ড্রেসিংরুম থেকে খেলোয়াড়রা ছুটে এলেন না। লিটন আর তামিমও ক্রিজে শুধু গ্লাভসে-গ্লাভসে ছোঁয়ালেন। যেন শুধুই আরেকটা বাউন্ডারি, যেন শুধুই আরেকটা জয়!
অথচ আরেকটা ইতিহাস হয়েছে; কয়েকটা ইতিহাসে ভর করে। সাকিব-মাশরাফি একই ম্যাচে ২০০ উইকেটের মাইলফলক ছুঁয়েছেন। সৌম্য সরকার টানা দুই ম্যাচে ম্যাচসেরা হয়ে সিরিজসেরাও হয়েছেন। আর দক্ষিণ আফ্রিকাকেও প্রথমবারের মতো ওয়ানডে সিরিজ হারিয়েছে বাংলাদেশ।
ওয়ানডে জয়, তা বিপক্ষ দল যতোই ‘বড়’ হোক, একরকম ‘অভ্যাস’ হয়ে গেছে বাংলাদেশের। সঙ্গে সিরিজ জয়ও। বিশ্বকাপের আগে জিম্বাবুয়ে এসে হেরেছিল প্রথম। টানা জয়খরার পর যেন এক নতুন সুঘ্রাণের আভাস মিলেছিল। তারপর বিশ্বকাপ। ইংল্যান্ডকে বিদায় করে কোয়ার্টার ফাইনাল।
পাকিস্তান এলো। ভারত এলো। বাংলাদেশ জিতলো দুদলের সঙ্গেই। পাকিস্তান বাংলাওয়াশ। ভারত প্রথম দুই ম্যাচেই সিরিজ হেরে তৃতীয় ওয়ানডেতে পেল ‘স্বান্ত্বনা’র জয়!
এরপর দক্ষিণ আফ্রিকা। ভারত পাকিস্তানের মতো ‘সহজ’ নয় এ সিরিজ! টি-টোয়েন্টি দিয়ে শুরু। এ ফরম্যাটে বাংলাদেশ এখনও অস্বস্তিতে ভোগে যেন। হারলো দুটিতেই। টি-টোয়েন্টির ধাক্কা সামলে উঠতে পারলো না প্রথম ওয়ানডেতেও।
তারপর? ওই যে ইতিহাস! আরেকটি। মিরপুর আর চট্টগ্রাম যার সাক্ষী। সাক্ষী তো গোটা দেশই। গোটা বিশ্বই!
২.
দলের জয়ের চেয়ে সৌম্যের সেঞ্চুরির দিকে নজর তখন সবার! আগের ম্যাচেও বোলারদের কৃপণতায় সেঞ্চুরিবঞ্চিত হয়েছেন, কাল যাতে আর না হয়, সেদিকেই যেন তাকিয়ে ছিলেন সবাই! তামিম সিংগেল নিয়ে স্ট্রাইক দিচ্ছেন। পানি নিয়ে একসময় ঢুকলেন এনামুল হক। টেলিভিশনের ক্যামেরায় যা দেখা গেল, তাতে বোঝা গেল, কোন একটা বার্তা এনেছেন। মনে হচ্ছিল, বিজয় তামিমকে বলছেন, সৌম্যকে যাতে একটু বেশী সুযোগ দেন তিনি! তামিমও যেন বিজয়কে ‘আস্বস্ত’ করলেন! বার্তাটা ঠিক ড্রেসিংরুম থেকেই এলো, নাকি বিজয় ‘স্বপ্রণোদিত’ হয়ে দিলেন, নিশ্চিত না।
সৌম্য সেঞ্চুরিটা করতে পারেননি। আউট হয়ে ফেরার পথে তাঁর মুখে তখন অদ্ভূত এক হাসি, ‘এবারও হলো না!’ রকমের। সৌম্য যখন ড্রেসিংরুমের পথে, বিজয় আবার পানি হাতে ঢুকছেন মাঠে। পিঠ চাপড়ে দিয়ে গেলেন। তাঁর হাসিটার অনুবাদ করলে দাঁড়ায়, ‘ব্যাপার নাহ, পরের বার হয়ে যাবে’!
অথচ এই সৌম্যের কারণেই কিন্তু বিজয় দলে জায়গা পাচ্ছেন না। বিশ্বকাপ থেকে চোট নিয়ে ছিটকে গেলেন, পুনর্বাসন শেষে ঘরোয়াতে রান করে দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে ডাকও পেলেন। তবে তামিমের সঙ্গী হয়ে নামা হলো না তাঁর, সেখানে যে সৌম্যকে বাদ দেওয়ার কথা ভাবতেও পারছেন না নির্বাচকরা! তাতে বিজয়ের বয়েই গেছে! সতীর্থ, দল- এসবের চেয়ে বড় আর কীই বা হতে পারে!
৩.
নাসির অফস্পিনার হয়ে গেছেন। মাশরাফির মতে, তিনিই এখন দেশসেরা অফস্পিনার। ম্যাচ শেষ করে আসা যাঁর দায়িত্বের মধ্যে পড়তো, সেই তিনিই এখন ব্যাটিংয়ের সুযোগ পান না। চোটের সঙ্গে লড়াইটা একটু দ্রুতই শেষ করে এসেছেন মাহমুদুল্লাহ। দলে জায়গা পেতে হবে যে! তামিম দেখেশুনে খেলছেন, সৌম্যের সঙ্গে জুটিটা জমে উঠছে বেশ! সাব্বির ভয়ডরহীন ক্রিকেটকে নতুন করে চেনাচ্ছেন, ফিল্ডিংয়ে সহজ সুযোগ মিস পুষিয়ে দিতে চাইছেন অসাধারণ দুটি ক্যাচ নিয়ে।
লিটন দাস একটু ‘হতাশ’ করলেও সুযোগ পাচ্ছেন, একটা বড় ইনিংসই তো পারে লিটনের ‘আসল’ রূপটা চেনাতে! সাকিব রেকর্ড গড়ে যাচ্ছেন। দলের সেরা ব্যাটসম্যান মুশফিকের ‘অফফর্ম’-ও চাপা পড়ে যাচ্ছে অন্যদের, দলের সাফল্যে।
আর নেতৃত্ব দিচ্ছেন একজন ‘নেতা’। মাশরাফি বিন মর্তুজা। নাসিরকে তিনি অফস্পিনার বানিয়ে দেন, মুস্তাফিজ তার ‘সাজেশন’ ছাড়া সংবাদ সম্মেলনেও কথা বলতে চান না! নিজে বোলিংয়ে আসেন পাঁচ ছয়ে। তাঁর ক্রিকেটীয় জ্ঞান আর প্রজ্ঞার যেন নতুন নতুন পরিচয় মিলছে নিত্যদিন! আর ক্রিকেটারদের উদযাপনের পরিমিতবোধ তো পরিপূর্ণ হয়ে ওঠারই পরিচায়ক!
৪.
বিশ্বকাপে তখন ‘দুর্বার’ নিউজিল্যান্ড। আক্রমণাত্মক ক্রিকেটকে একটা নতুন ধাপে নিয়ে গিয়েছিল ব্রেন্ডন ম্যাককালামের দল। প্রথমবারের মতো সেমিফাইনাল বাধা টপকে গেল তারা। ম্যাককালাম সেসময় একটা কথা বলেছিলেন, ‘এটি আমাদের জীবনের সেরা সময়’। সেরা সময়েও বিশ্বকাপটা জেতা হয়নি তাদের। তাতে কী! নিউজিল্যান্ড তাদের ক্রিকেটের ‘ব্র্যান্ড’টা পরিবর্তন করেনি।
সেই বিশ্বকাপেই যেন এই বাংলাদেশের নতুন করে জেগে ওঠা। তারপর টানা তিনটি সিরিজ জয়। যাদের বিপক্ষে একটি জয়ই একসময় বর্তে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল, সেরকম প্রতিপক্ষের সঙ্গেই! বাংলাদেশ এর আগেও সিরিজ জিতেছে। 'বাংলাওয়াশ' করেছে। তবে এখনকার মতো করে নয়। এরকম একের পর এক নয়।
তবে এমন দিনও ফুরোবে। বাংলাদেশ সিরিজ হারবে। তবে ক্রিকেটকে উপভোগ করা যেন ফুরিয়ে না যায়। দলে টিকে থাকার এই সুস্থ লড়াই যাতে টিকে থাকে। একজনের খারাপ সময় যাতে অন্যদের পারফরম্যান্সে মিলিয়ে যায়। মাশরাফি ক্রিকেট ছাড়ার পরও যাতে নেতৃত্বে পাওয়া যায় এমন কাউকেই। দরকার পড়লে, অমন কাউকে এখনই নির্বাচন করে মাশরাফির অধীনে অধিনায়কত্ব শেখানো হোক।
আর হ্যাঁ, বাংলাদেশের এই ওয়ানডের সাফল্য সবার আগে ছুঁয়ে যাক ঘরোয়া ক্রিকেটে।
প্রথম শ্রেনীর ক্রিকেট হয়ে উঠুক মানসম্মত। সেখান থেকে উঠে আসুক টেস্টের মুস্তাফিজুররা। ‘টেস্টের জন্য প্রস্তুত’ সৌম্যরা। লিটনরা।
এমন সময়ে এই ‘আশা’টুকু করতেই পারেন এদেশের ক্রিকেটপ্রেমীরা।
এটি যে বাংলাদেশের ক্রিকেটেরও ‘সেরা সময়’!
সবাইকে ঈদুল ফিতরের শুভেচ্ছা।