• রাশিয়া বিশ্বকাপ ২০১৮
  • " />

     

    দল বদলাবে, কিন্তু আর্জেন্টিনাকে বদলাবে কে?

    দল বদলাবে, কিন্তু আর্জেন্টিনাকে বদলাবে কে?    

    মস্কোর ৫০ কিলোমিটার দক্ষিণের শহর ব্রনিতসিতে বিশ্বকাপের কোনো ম্যাচ নেই। কিন্তু বিশ্বকাপের কয়েকদিন আগে ওই শহরের উন্মাদনা ছাড়িয়ে গেল বাকিসব শহরকেও। ব্রনিতসির দেয়ালে দেয়ালে এখনও শোভা পাচ্ছে লিওনেল মেসির পেইন্টিং। শহরের ট্রেনিং সেন্টারটা প্রস্তুত করা হয়েছে আর্জেন্টিনার জন্য। অনুশীলনে ব্যবস্থা তো আছেই, সঙ্গে অবসরে অন্য খেলার ব্যবস্থাও আছে। আর্জেন্টিনা এবার রাশিয়ায় এসেছে বিলাসবহুল এক বিমানে। দুই বছর আগে বিমান নিয়েই ঝামেলায় পড়েছিল তারা। রাশিয়া বিশ্বকাপে কোনো ঝামেলা রাখতে চায়নি আর্জেন্টিনার ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন, সঙ্গে করে তাই ৩ টন খাবারও নিয়ে এসেছিল তারা।

     

     

    সবকিছুই ঠিকঠাক ছিল। কিন্তু যা কেন্দ্র করে এতো কিছু সেই মাঠের খেলা নিয়ে আর্জেন্টিনার কাছে কি প্রত্যাশা করতে হবে সেটাই কেবল জানা নেই। দুঃস্বপ্নের মতো এক বাছাইপর্বে কোনোরকমে উতরে গেছে আর্জেন্টিনা। টানা ৩ ফাইনাল হারের পর দলের মনোবল আর আত্মবিশ্বাস নিয়ে আর্জেন্টাইনদের মনে সংশয় ছিল। কিন্তু মেসি যে দলে আছে, সেই দল নিয়ে স্বপ্ন দেখাই যায়। একজন ত্রাণকর্তা খুঁজছে আর্জেন্টিনা। মেসির কাছে যেন একটা বিশ্বকাপ পাওনাই হয়ে গেছে তাদের।

    কিন্তু একজনের ওপর নির্ভর করে বিশ্বকাপ জেতার এই রীতিটা তো সেকেলে হয়ে গেছে অনেক আগেই। ডিয়েগো ম্যারাডোনার ছিয়াশিতে ঈশ্বর হয়ে ওঠার মতো আর কোনো গল্পও নেই ফুটবলে। এতোদিনেও তাই ভুল ভাঙেনি। একজন খেলোয়াড়ের ওপর নির্ভর করেই বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্নে বুক বেঁধেছে আর্জেন্টিনা। বাস্তবতার বিচারে সেটা কেবল দুরাশা। স্বপ্ন আর বাস্তবতার মাঝে বিশাল ফারাক রেখে দিনশেষে স্বপ্নাহত হওয়া। 

    সেই স্বপ্নে শুরুতেই লেগেছে আঘাত। আইসল্যান্ডকে হারাতে পারেনি আর্জেন্টিনা। ব্রনিতসিতর উৎসবেও পড়েছে ভাটা। পয়েন্ট হারানো নিয়ে হা-হুতাশ একটু কমত, যদি মেসি পেনাল্টিটা মিস না করতেন। ওই ম্যাচেই বাস্তবতা বুঝে যাওয়ার কথা আর্জেন্টিনার। বিশ্বকাপে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে আসাটাই যে ‘ওয়েক আপ কল’ ছিল সেটা বুঝতে ভুল করেছেন হোর্হে সাম্পাওলি। এরপর প্রীতি ম্যাচে নাইজেরিয়ার কাছে হার, স্পেনের বিপক্ষে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় হার। ইঙ্গিত ছিল অনেককিছুই, কিন্তু সাম্পাওলি আর আর্জেন্টিনা সেসব গায়ে মাখাননি। স্পেনের বিপক্ষে হারের পর মেসিও প্রথমার্ধে আর্জেন্টিনার ভালো খেলার কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন। অথচ দলের খেলায় যে কোনো ছন্দ নেই সেটা নিয়েও যেন কেউই চিন্তিত নন।

    আইসল্যান্ডের বিপক্ষে আর্জেন্টিনার খেলা বিরক্তি ধরিয়েছে। দলটা যে অতিরিক্ত মেসিনির্ভর সেটার প্রমাণ আরও একবার মিলেছে। মেসি নিজেও হতাশ করেছেন, বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচেই ঝিমিয়ে ছিলেন। অথচ আগের বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনাকে ছন্দে তুলে দেওয়ার কাজটা করেছিলেন, সেটাই হয়ে গিয়েছিল অনুপ্রেরণা। ইরানের সঙ্গে যোগ করা সময়ের গোল আর্জেন্টিনাকে গতবার যতটা উজ্জীবিত করেছিল, আইসল্যান্ডের সঙ্গে পেনাল্টি মিসটা ঠিক ততোটাই দমিয়ে দিয়েছে তাদের। বিশ্বকাপ কোনো লিগ নয়; একটা, দুটো ম্যাচ বাজে খেললেই বেজে যায় বিদায়ঘন্টা। একটা খেলে ফেলেছেন, আরেকটা ম্যাচেও অমন হবে না তার নিশ্চয়তা কি?   

    ৪-২-৩-১ যে আর্জেন্টিনার ফর্মেশন নয়, সেটা বিশ্বাস করতে চাননি সাম্পাওলি। মেসিকে কেন্দ্র করে খেলতে চান তিনি, কিন্তু ৪-২-৩-১ এ মেসি কবে ভালো খেলেছেন সেই প্রশ্নের জবাব জানা নেই তারও। দুই ফুলব্যাকের একজন রাইটব্যাকই নন। এদুয়ার্দো সালভিও ডান প্রান্ত ধরে ওপরে উঠেছেন, তারপর দিশেহারা মনে হয়েছে তাকে। এতোবছর ধরে আর্জেন্টিনা দলে খেলেও ডি মারিয়া লেফট উইং, নাকি রাইট উইংয়ে ভালো সেটা নির্ধারণ করা যায়নি। সাম্পাওলি মেসি আর দিবালাকে একসঙ্গে খেলাতে চান না, কিন্তু ডি মারিয়া খেলানোর পেছনেও যুক্তি দাঁড় করাতে পারেন না। সাহসীও হতে পারেননি, ডি মারিয়াকে ছাড়া দল নামানোর সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি তিনি। অথচ জাতীয় দলে ব্রাত্য হয়ে পড়া গঞ্জালো হিগুয়াইনকে দলে নেওয়ার মতো সাহস দেখিয়েছিলেন তিনি। আইসল্যান্ডের খেলোয়াড়েরা শারীরিকভাবে আর্জেন্টাইনদের চেয়ে শক্তিশালী। সেটা জেনেও কেন হিগুয়াইনের মতো শক্ত সামর্থ্য একজন সেন্টার ফরোয়ার্ড নামানোর সিদ্ধান্ত আগে নিতে পারলেন না সাম্পাওলি?     

    এখন অবশ্য আর্জেন্টিনার সংবাদমাধ্যম বলছে দলে বড়সড় পরিবর্তন আসতে যাচ্ছে ক্রোয়েশিয়ার ম্যাচের আগে। রক্ষণ বরাবরই আর্জেন্টিনার দুর্বলতা। নিকোলাস অটামেন্ডিকে বাদ দিলে দলে থাকে কেবল আর দুই সেন্টারব্যাক। একজন মার্কোস রোহো, গত মৌসুমে তার ক্লাবের হয়ে খেলারই সুযোগ হয়নি। আরেকজন ফ্রেডেরিকো ফাজিও রোমার কৌশলের সঙ্গে যতটা যান, আর্জেন্টিনায় ততোটাই বেমানান। অটামেন্ডি নিজের পজেশন ছেড়ে ওপরে উঠে যান, এটাই তার খেলার ধরন। ধীর গতির একজনকে নিচে ফেলে মাঝমাঠ পর্যন্ত উঠে যাওয়া তো আত্মঘাতী। ফাজিওকে দলে নেওয়ার স্বার্থকতা কি তাহলে?     

    দল থেকে রোহো বাদ পড়ছেন, কিন্তু ফাজিও আসছেন না তার জায়গায়। ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে থ্রি ম্যান ডিফেন্সের মধ্যমণি অটামেন্ডি। এমন একজন যিনি নিজের পজিশন নিয়ে নিয়মিতই ভোগেন। আইসল্যান্ডের বিপক্ষে আর্জেন্টিনাকে রক্ষণ নিয়ে তেমন ভুগতে হয়নি। ৭২ শতাংশ বলই ছিল আকাশি-সাদাদের দখলে। কিন্তু যে কয়বারই আইসল্যান্ড আক্রমণে উঠেছে প্রতিবারই নড়বড়ে মনে হয়েছে আর্জেন্টিনার রক্ষণকে। অথচ সেই ম্যাচে আর্জেন্টিনার ডিফেন্সিভ লাইনকে নিরাপত্তা দিতে ছিলেন আরও দুইজন ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার।

    ক্রোয়েশিয়া আইসল্যান্ড নয়। আর্জেন্টিনার মতো তারাও বল পায়ে রেখে খেলতে পছন্দ করে, অবস্থাভেদে প্রতি আক্রমণেও ভয়ঙ্কর। মারিও মাঞ্জুকিচ, আনতে রেবিচরা একটা সুযোগ পেলেই ধ্বংস করে দিতে পারেন আর্জেন্টিনার রক্ষণকে। আর ক্রোয়েশিয়ার মাঝমাঠে মদ্রিচ, রাকিটিচরা তো আছেনই গোল করার মতো বলের যোগান দিতে। এই ম্যাচ হারলে বিদায়ঘন্টা বেজে যাবে আর্জেন্টিনার, সেই ম্যাচে তাই একরকম জুয়া খেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সাম্পাওলি। আর্জেন্টিনার সংবাদমাধ্যমের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী ৩-৩-৩-১ ফর্মেশনে দল নামাবেন তিনি। সেটা হতে পারে ৩-৪-৩ ও। তাতে মাসচেরানোর সঙ্গে মিডফিল্ডে খেলবেন আকুনিয়া আর মেজা। তবে মেজার জায়গায় খেলা হতে পারে এনজো পেরেজেরও। ডি মারিয়াকে বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্তটা হয়ত শেষ পর্যন্ত নেবেনই, তার জায়গায় ক্রিশ্চিয়ান পাভন। উদ্ভট এই দলটাই ধ্বংসের কারণ হতে পারে সাম্পাওলি আর আর্জেন্টিনার জন্য। যদিও সংবাদসম্মেলনে এখনও দল ঠিক করেননি বলেই জানিয়েছিন সাম্পাওলি।

    দলটা বুড়িয়েও গেছে। বয়স্ক দলের তালিকায় পেরুর চেয়ে কয়েকদিন পিছিয়ে দুই নম্বরে আর্জেন্টিনা। যা কিছু খারাপ হতে পারত, তার সবটাই হয়েছে আর্জেন্টিনার জন্য। বিশ্বকাপের আগে ইনজুরির হাত থেকেও রেহাই পায়নি তারা। নতুন গোলরক্ষক উইলি ক্যাবেয়ারোকে মোটেই প্রস্তুত মনে হয়নি আগের ম্যাচে। তার ভুলে তো আরও একটা গোল খেয়ে বসতে পারত আর্জেন্টিনা। নিচ থেকে খেলা বিল্ড আপ করার এই রীতিও তাই বিধ্বংসী হতে পারে ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে।

     

     

    মেসি বিশ্বকাপ জিততে চান- একথা সবার জানা। প্রতিবারই সাক্ষাৎকারে একই কথা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে জানান দেন। মেসির প্রবল ইচ্ছা নিয়ে সংশয় নেই, কিন্তু আরও একবার কি দলের গুরুত্বপুর্ণ সময়ে অনুপ্রেরণা হয়ে উঠতে পারবেন? আপাতদৃষ্টিতে এছাড়া আর্জেন্টিনার দ্বিতীয় রাউন্ডে ওঠার সম্ভাবনা নেই। নাকি মেসি আসলে সবটুকু নিংড়ে দিয়েছেন আগেই? আর কিছুই নেই দেওয়ার? আইসল্যান্ডের সঙ্গে তার শরীরী ভাষা তো এই ভয়ঙ্কর ইঙ্গিতটাই দিয়ে গেছে।

    বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচে জিততে না পারা সবসময়ই পাহাড় সমান চাপে ফেলে দেয়। যে চাপে পড়েছে আর্জেন্টিনা। তাদের মতো ব্রাজিলও পয়েন্ট খুঁইয়েছে, জার্মানি তো হেরেই বসেছে। কিন্তু ওই দুই দলের কোনোটাই একজন খেলোয়াড় নির্ভর নয়। আর্জেন্টিনার জন্য ভয়টা তাই সত্যিকারের।  ২০০২ সালে মার্সেলো বিয়েলসা ছিলেন কোচ, এবারও একজন বিয়েলসিস্তার হাতে আর্জেন্টিনা। মেসি নয়, সাম্পাওলির ওপরই আসলে নির্ভর কিছু। দল হয়ত বদলাবেন, কৌশলও বদলাবেন- কিন্তু ভাগ্যটা কি বদলাতে পারবেন সাম্পাওলি? নাকি রাজসিকভাবে রাশিয়া এসে, আতঙ্ক নিয়ে দেশে ফিরতে হবে আর্জেন্টিনাকে?