ক্রুস দেখালেন, জার্মানি কেন জার্মানি
সোচির আবহাওয়ায় দুর্যোগের আভাস ছিল। সুইডেনের কাছে সব রকম দুর্যোগে পড়েছিল জার্মানিও। টনি ক্রুসের এক ভুলে বল পজেশন পেয়ে গিয়েছিল সুইডেন। সেখান থেকেই গোল খেয়ে বিশ্বকাপের বিপদ সংকেত বেজে গিয়েছিল জার্মানদের। পরে মার্কো রয়েসের গোলে সমতায় ফেরায় প্রাণ ফিরে বিশ্বজয়ীরা। সেটাও আবার মিলিয়ে গিয়েছিল জেরোম বোয়াটেং লাল কার্ড দেখে দলকে বিপদে ফেলে চলে গেলে। কিন্তু গল্পটা সাজানো ছিল ক্রুসের জন্য। ইনজুরি সময়ের শেষ মিনিটে ডিবক্সের পাশ থেকে একটা ফ্রি কিক পেল জার্মানি। মার্কো রয়েস প্রথম টাচে বলটা এগিয়ে দিলেন ক্রুসের দিকে, দৌড়ে এসে ক্রুসের আগুনে শট, গোলার মতো বিঁধল সুইডেনের জালে। ক্রুসের নাটকীয় প্রত্যাবর্তনে সুইডেন হলো নিঃস্ব, আর ২-১ গোলের জয় নিয়ে বিশ্বকাপে টিকে থাকল জার্মানি।
ম্যাচে জার্মানির শুরুটাও ছিল ঝড়ের মতো। একের পর পর আক্রমণ করে সুইডেনকে শুরুতেই থমকে দিয়েছিল জোয়াকিম লো। সুইডেনও অবশ্য শুরুর ধাক্কা ভালোভাবে সামলে উঠে প্রথম আধ ঘন্টায় জার্মানিকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল বেশ কয়েকবার। সবই খেলার ধারার বিপরীতে, কাউন্টার অ্যাটাক থেকে। প্রথমে এমিল ফসবার্গ চমকে দিয়েছিলেন। কিন্তু জার্মানদের বিপদ হয়নি। আবার জার্মান আক্রমণের রোলার কোস্টার গেছে অন্য প্রান্তে। ১২ মিনিটে প্রান্ত বদল, এবার শুধু চমক নয়, ভড়কেই গিয়েছিল জার্মানি। গোলের পথেই এগুচ্ছিলেন মার্কোস বার্গ। সামনে শুধু ম্যানুয়েল নয়্যার। পরে নয়্যারের হাতেই লেগেছে বার্গের শট, কিন্তু তার আগে পেছন থেকে ধাক্কাও দিয়েছিলেন বোয়াটেং। সে দফায় অবশ্য রেফারি আর ভিডিও সহকারি রেফারি দুইজনের চোখই এড়িয়ে গেছেন তিনি।
এরপর ৩২ মিনিটে ক্রুসের ওই ভুল। সেখান থেকে ওলা টইভোনেনের নিখুঁত ফিনিশ, নয়্যারের মাথার ওপর দিয়ে জার্মানির জালে বল। সুইডেন এগিয়ে যাওয়ার পর জার্মানি খেল বড় ধাক্কা। ৭৫ শতাংশের বেশি বলের দখল রেখেও পিছিয়ে পড়লে তো সংশয় জাগেই। সেবাস্তিয়ান রুডি এরপর ইনজুরি নিয়ে মাঠ ছাড়লে তড়িঘড়ি করে কৌশলেও বদল আনতে হয় জোয়াকিম লোকে। তার জায়গায় নেমে অবশ্য ইলকে গুন্ডোয়ান প্রথমার্ধেই প্রায় সমতায় ফিরিয়ে দিচ্ছিলেন দলকে। কিন্তু ডিবক্সের বাইরে থেকে তার করা শট অল্পের জন্য চলে যায় বাইরে দিয়ে। প্রথমার্ধের শেষদিকে আরও নড়বড়ে জার্মানির রক্ষণ। সেটা অবশ্য শেষ পর্যন্ত আক্ষেপই বাড়িয়েছে সুইডেনের। ৪৪ মিনিটে নয়্যারকে একা পেয়েও শট করা হয়নি ক্লায়েসেনের। আর বিরতির ঠিক আগে নয়্যারের দুর্দান্ত এক সেভে গোলবঞ্চিত হন বার্গ।
৯৫ মিনিটে দায়মোচনের পর ক্রুসের উল্লাস, সুইডেনের সঙ্গে ম্যাচে/এএফপি
নয়্যারের ওই সেভ আশা বাঁচিয়ে রেখেছিল জার্মানির। বিরতির পর জার্মানির খেলায় প্রাণ ফিরিয়েছেন টিমো ভার্নার। বদলি মারিও গোমেজকে আক্রমণে জায়গা করে দিয়ে কিছুটা বাঁ প্রান্তে সরে গিয়েছিলেন তিনি। বিরতির পর জার্মানির বেশিরভাগ আক্রমণ ওই প্রান্ত থেকেই। ভার্নারের একটা ক্রসই রয়েস গোলে পরিণত করে জার্মানিকে ম্যাচে ফিরিয়ে আনেন ৪৮ মিনিটে।
উজ্জীবিত জার্মানি এরপর ম্যাচের সময় ঘন্টা ছোঁয়ার আগে অন্তত আরও চারবার নিশ্চিত গোলের সুযোগ তৈরি করলো। ক্রুসের শট, মুলারের হেড গেল বাইরে দিয়ে। ডান দিক থেকে করা কিমিচের ক্রসে পা ছোঁয়াতে পারলেই গোল হয়ে যেত, গোমেজ, রয়েসের কেউই পারলেন না। জার্মানির সুযোগ কাজে লাগাতে না পারার হতাশায় ম্যাচে ফেরত আসে সুইডেন। সেটা অবশ্য অল্প সময়ের জন্যই। দ্বিতীয়ার্ধে আরও বেশি সময় সুইডিশদের গেছে জার্মান আক্রমণ সামলাতেই। কিন্তু জার্মান স্বপ্নে বড়সড় একটা আঘাত লাগে ৮২ মিনিটে। তাতে দম ছাড়ার সুযোগ মেলে সুইডেনের। বার্গকে ফাউল করে দ্বিতীয় হলুদ কার্ড দেখেন বোয়াটেং। বিশ্বকাপে জার্মানির সপ্তম খেলোয়াড় হিসেবে লাল কার্ড দেখে মাঠ ছাড়েন জার্মান ডিফেন্ডার।
সুইডেনের হারটাই তখন অসম্ভব মনে হচ্ছিল। অধিনায়ক গ্রাঙ্কভিস্ট পুরো ম্যাচেই নেতৃত্ব দিয়েছেন রক্ষণে। ৮৩ মিনিটে আক্রমণেও লড়লেন সমান তালে। জার্মানির ডিবক্সের ভেতর লাফিয়ে উঠে তার করা হেড যাচ্ছিল ফাঁকায় দাঁড়ানো জন গুইদেত্তির কাছে। নয়্যার কোনোরকমে সেই বল রুখলেন, পার করে দিলেন মাঠের বাইরে। অন্যপ্রান্তের গোলরক্ষকও কম যান না, সুইডেনের ওলসেনও দারুণ কিছু সেভ করে গোলবার আগলে রেখেছিলেন ৯০ মিনিট পর্যন্ত। জার্মানি দলে ছিলেন না মেসুত ওজিল, প্রতিযোগিতামূলক ম্যাচে প্রথমবারের মতো বাদ পড়েছেন তিনি। বদলি হয়েও মাঠে নামা হয়নি তার। শেষদিকে গোলের আশায় লো নামিয়েছিলেন জুলিয়ান ব্রান্ডটকে। ক্রুস মহাকাব্যের আগে ব্রান্ডটই প্রায় রাতটা নিজের করে নিচ্ছিলেন, ৯২ মিনিটে ডিবক্সের বাইরে থেকে নেওয়া শট বারপোস্টে লাগলে জার্মানির হতাশাটাও দীর্ঘ হওয়ার পথেই এগুচ্ছিল। কিন্তু শেষদিকে ক্রুসের ওই গোলেই রাশিয়ায় অবশেষে ফুটবল মাঠে ‘ক্রুজ কন্ট্রোলের’ দেখা পেল জার্মানি।
আজকের পর দুই ম্যাচে জার্মানির পয়েন্ট দাঁড়াল ৩। জার্মানদের শেষ ম্যাচ দ.কোরিয়ার সঙ্গে।
একাদশ
জার্মানি
নয়্যার, কিমিচ, বোয়াটেং, রুডিগার, হেক্টর, মুলার, রয়েস, রুডি, ভার্নার, ক্রুস, ড্রাক্সলার
সুইডেন
ওলসেন, লুস্টিগ, লিন্ডেলফ, গ্রাঙ্কভিস্ট, অগস্টিনসন, ক্লায়েসন, লারসন, এইকদাল, ফসবার্গ, বার্গ, টইভোনেন