• রাশিয়া বিশ্বকাপ ২০১৮
  • " />

     

    আলিরেজা বিরানভান্দ : 'গোলকিপার অফ হেভেন'

    আলিরেজা বিরানভান্দ : 'গোলকিপার অফ হেভেন'    

    ১.
    সেলুলয়েডে আলি দৌড়ায়। জাহরা দৌড়ায়। দুই ভাই-বোনের দৌড় একজোড়া জুতা নিয়ে, আরেক জোড়া হারিয়ে গেছে। বাবাকে বলা যাবে না কিছুতেই। এরপর আলির দৌড় নতুন একজোড়া জুতার জন্য, প্রতিযোগিতায় যেটা তৃতীয় পুরস্কার। মাজিদ মাজিদির “চিলড্রেন অফ হেভেন”।

    বাস্তবের আলিরেজা বিরানভান্দ ছুটে বেড়ান। ছুটন্ত বিরানভান্দকে একটা স্বপ্ন তাড়া করে বেড়ায়- ফুটবল। বাবা তার স্বপ্ন দেখার সাহসটা মেনে নিতে পারেননি, যাযাবর পরিবারে জন্ম নেওয়া বিরানভান্দ আদতেই হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়ান এক চিলতে জায়গা, যেখানে ঘুমাবেন। আর ছোটেন ফুটবলের পেছনে। গোলবার তাকে তাড়া করে ফেরে।  


    ২.
    যেন অনেক দৌড়ের পুরস্কার হিসেবে পাওয়া বলটাকে আঁকড়ে ধরে আছেন বিরানভান্দ। শুয়ে পড়েছেন, দুহাতে জড়ানো বলটার ওপর মাথা রেখেই। এই স্বপ্নালু ঘোরটা যদি না কাটতো কখনোই!

    গোললাইন ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিলেন দৌড় শুরুর স্টার্ট-আপের মতো করে। এরপর বাঁদিকে ঝাঁপ, আটকে দেওয়া বলটা ছিটকে বেরিয়ে গেল গ্লাভসে লেগে। আবার হামাগুঁড়ি দিয়ে মুঠোবন্দি করলেন সেটা, ছেড়ে যেতে দেবেন না কিছুতেই। এটা শুধুই ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর পেনাল্টি নয়, বিশ্বকাপ মঞ্চের আলোটা ফুটবল বিশ্বের উজ্জ্বলতম একজনের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া নয়, এর চেয়েও বেশি কিছু। এটা যাযাবর পরিবারের এক ছেলের অনেক বিনিদ্র রজনীর লালিত এক স্বপ্ন। ফুটবলের ঝোঁকে ঘরপালানো, এরপর ঘুম আর ফুটবলের তাগিদে বিচিত্র সব কাজ করে বেড়ানো ২৫ বছর বয়সী এক যুবকের আজন্ম লালিত এক স্বপ্নপূরণ।

     

    ৩.
    কোথায় আছে ঘাস? 

    যাযাবর সেই পরিবারের একমাত্র লক্ষ্য ছিল সেটাই। ফুটবল পিচের নয়, ঘাস প্রয়োজন মেষগুলোর খাবার জোগাতে। সে কারণেই আজ এখানে, কাল সেখানে করে বেড়ায় সেই পরিবার। বিরানভান্দের জন্ম সেই যাযাবর পরিবারে, ইরানের সারাব-ই ইয়াসে। বড় সন্তান বলে পরিবারকে সাহায্য করতে হতো শুরু থেকেই। সাহায্য বলতে আরকি, আলিরেজা বিরানভান্দ ছিলেন রাখালবালক। এর ফাঁকে ফুসরত মিললেই তার কাজ ছিল দুইটা- ফুটবল আর দাল পরান। দাল পরান ইরানের স্থানীয় খেলা, দূর থেকে পাথর ছুড়তে হয় আরও দূরে। আরও অনেক বছর পর, বিরানভান্দকে যেটা পরিচয় পেতে সাহায্য করবে ফুটবলে। 

    ১২ বছর বয়সে তার পরিবার থিতু হলো সারাব-ই ইয়াসে। স্থানীয় এক দলের সঙ্গে অনুশীলন শুরু করলেন, স্ট্রাইকার হিসেবেই খেলতেন। একবার গোলরক্ষক ইনজুরিতে পড়লেন, গোলবারের নিচে দাঁড়ালেন বিরানভান্দ। দারুণ একটা সেভই ঠিক করে দিল গোলরক্ষক হিসেবে তার গতিপথ। তবে বাগড়া বাঁধালেন বাবা। এমন কাহিনীতে যা হয়। 

    ‘মধুরেণ সমাপয়েৎ’ ধরনের কোনও গল্পে হয়তো বাবা শেষ পর্যন্ত মেনে নিয়ে দারুণ উৎসাহ দিতেন। তবে মোর্তেজা বিরানভান্দ সেটা করলেন না। আলিরেজা সাধারণ একজন কর্মঠ মানুষ হোক, বাবার চাওয়া ছিল সেটাই। ফুটবলের কাপড়-চোপড় বা গ্লাভস বারকয়েক ছিঁড়েও ফেলেছিলেন তিনি। বিরানভান্দকে গোলকিপিং করতে হতো তখন খালি হাতে। 

    বিরানভান্দের যাযাবর সত্ত্বার সঙ্গে ফুটবল সত্ত্বা মিলে গেছে এর আগেই, সেটাই তাকে তাড়া দিচ্ছিল। একদিন ঘর ছেড়ে ছুট। গন্তব্য তেহরান। লক্ষ্য ফুটবল। এক আত্মীয়র কাছে টাকা ধার করে চেপে বসলেন একটা বাসে। 


    স্বপ্নের দিকে লাফ আলিরেজা বিরানভান্দের/টুইটার

     

    ৪.
    সেই বাসেই এক ফুটবল কোচ হোসনেইন ফেইজের সঙ্গে পরিচয় হয়ে গেল তার। নিয়তিও হয়তো চাইছিল, বিরানভান্দ ফুটবলেই প্রাণ বাঁধুন! তবে সেই কোচ ফি হিসেবে চেয়ে বসলেন দুই লক্ষ ইরানিয়ান তোমান। অঙ্ক শুনে ভড়কে যাবেন না, টাকার হিসেবে তিন হাজারের একটু বেশি সেটা। 

    তবে তার কাছে তখন থাকার জায়গাই নেই, আর এতো টাকা! আরও সব গৃহহীনের মতো তারও আশ্রয় হলো আজাদি টাওয়ারের আশেপাশে। এক সেলসম্যান থাকার একটা জায়গা করে দিতে চেয়েছিলেন, বিরানভান্দ সে প্রস্তাবে রাজি হয়েও শেষে ফিরে এসেছিলেন ক্লাবে। যেখানে প্রতিদিন ট্রায়াল দেন তিনি। সে রাতে ক্লাবঘরের দরজার পাশেই ঘুমিয়ে পড়লেন। সকালে উঠে দেখলেন, তার আশেপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বেশ কিছু মুদ্রা, লোকে ভিক্ষুক ভেবে দিয়ে গেছে! 

    সেই টাকা দিয়ে সকালে জম্পেশ একটা নাস্তা হয়েছিল তার! 

    বিরানভান্দের এতো ত্যাগ দেখেই হয়তো মন গললো ফেইজের, ফি ছাড়াই ভর্তি করিয়ে নিলেন তাকে। অধিনায়ককেও বললেন, যাতে একটু সাহায্য করেন। এক সতীর্থের সঙ্গে থাকলেন সপ্তাহ দুয়েক, তারপর আরেক সতীর্থের বাবার পোশাক কারখানায় চাকরি নিলেন। ঘুমাতেন সেখানেই। 
     
    এরপরের কাজটা গাড়ি ধোয়ার। উচ্চতার কারণে ‘এসইউভি’ ধোয়ার কাজে বেশ পাকা হয়ে উঠলেন। একটা বিব্রতকর অবস্থাতে পড়ে গেলেন এই কাজ করতে গিয়েই। ইরানের ফুটবল কিংবদন্তি আলি দায়ই এসেছিলেন গাড়ি ধোয়াতে, বিরানভান্দের সহকর্মীরা চেপে ধরলেন, যাতে সাবেক বায়ার্ন মিউনিখ তারকার সঙ্গে গিয়ে কথা বলেন সহায়তার ব্যাপারে। তিনি জানতেন, দায়ই ফিরিয়ে দেবেন না তাকে, তবে কেমন একটা আড়ষ্ঠতা চেপে ধরলো তাকে। গেলেন না। 

    নাফত-ই-তেহরান কোচের সঙ্গে পরিচয় হলো এর কদিন পরই। প্রথম কদিন ক্লাবের প্রার্থনাকক্ষে থাকতে দেওয়া হয়েছিল তাকে, এরপর সে সুযোগটাও কেড়ে নেওয়া হলো। আবার সেই ঘুমানোর জায়গা নিয়ে টানাটানি। এবার বিরানভান্দ নিলেন পিজ্জার দোকানে চাকরি। সেখানে যদি রাত কাটানোর একটু আশ্রয় মেলে! 

    এবার নতুন বাগড়া। একদিন সে দোকানে এলেন তার কোচ, যিনি জানতেন না বিরানভান্দের এই চাকরির ব্যাপারে। তার সামনে যেতে আপত্তি করেছিলেন, তবে মালিকের জোরাজুরিতে যেতেই হয়েছিল। কদিন বাদে সেই চাকরিটাও ছেড়ে দিলেন বিরানভান্দ। 

    আবার সেই পুরোনো সমস্যা। ঘুমানোর জায়গা। বিরানভান্দ এবার রাস্তাকেই বেছে নিলেন। ঝাড়ুদারের কাজ এবার। মাঝে মাঝে বিশাল চত্ত্বর একা হাতেই পরিস্কার করতে হতো। ওদিকে ক্লাবের সঙ্গেও গন্ডগোল। আরেক ক্লাবের সঙ্গে অনুশীলন করতে গিয়ে চোট পাওয়ায় নাফত বহিষ্কার করেছে তাকে, সেখান থেকে গেলেন হোমায়। হোমা ম্যানেজার চুক্তি করলেন না। 

    বিরানভান্দের স্বপ্নটার মৃত্যু ঘটছিল। তেহরানের ওই বিনিদ্র রজনীতে, নিঃসঙ্গ রাস্তায়। 


    ৫.
    নাফতের অনূর্ধ্ব-২৩ দলের ম্যানেজার ডেকে পাঠালেন সেসময়ই। ভাগ্যিস, হোমার সঙ্গে চুক্তিটা করেননি তখন তিনি! এরপর বিরানভান্দের এগিয়ে যাওয়ার পালা। 

    প্রথমে ইরান অনূর্ধ্ব-২৩ দলে ডাক পেলেন, এরপর হয়ে গেলেন নাফতের প্রথম গোলরক্ষক। তবে তাকে বিখ্যাত বানালো তার ছোটবেলার আরেক প্রেম, ‘দাল পরান’। এবার পাথর নয়, ছুঁড়লেন বল। ডি-বক্স থেকে প্রায় ৭০ গজ দূরে গোলের অ্যাসিস্টই করলেন ট্রাক্টর সাজির বিপক্ষে। বিদেশী সংবাদমাধ্যমের নজরও কাড়লেন সেবার। 

    ২০১৫ সালে আলিরেজা বিরানভান্দ হলেন ইরানের প্রথম গোলরক্ষক। বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে রাখলেন ১২টি ক্লিনশিট, ইরানকে রাশিয়ায় নিয়ে যেতে বড়রকমের সাহায্য তো তারই। 

    রাশিয়া এসে মরক্কোর সঙ্গে ক্লিনশিট রাখলেন, স্পেনের বিপক্ষে ডিয়েগো কস্তার গোলটাতেও তো মিশে ছিল ভাগ্যের ছোঁয়া। এরপর পর্তুগাল, রিকার্ডো কারেসমার শটটা বেরিয়ে গেল আঙুলের ডগার একটু ওপর দিয়ে। তার আগে বড্ড নড়বড়ে ছিলেন, ধেয়ে আসা ক্রসগুলোতে যেন ধাতস্থ হতে পারছিলেন না মোটেও। তবে রক্ষণের সতীর্থদের উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছিলেন তবুও। জীবনে কতো চ্যালেঞ্জ নিয়েছেন, এ আর এমন কী! 

    এরপরই রোনালদোর সেই পেনাল্টি। তেহরানের রাস্তার সেই বিনিদ্র রাতগুলো এসে ভর করলো যেন তার ওপর। 

    বিরানভান্দের হাত থেকে এরপর বেরুতে লাগলো লম্বা সব থ্রো। সারাব-ই ইয়াসের দাল পরান এসে ভর করলো তার ওপর।  

     

    ৬.
    সেলুলয়েডের আলি সেই দৌড়ে তৃতীয় হয়ে জুতা জিততে পারে না। প্রথম হয়ে যায়। বাস্তবের আলির গ্রুপপর্বেই শেষ হয়ে যায় বিশ্বকাপ, এরপর মিলিয়ে যান সতীর্থদের কান্নায়। তবে তার আগে ঠেকিয়ে দেন রোনালদোর পেনাল্টি। যেখানে মিশে থাকে আলিরেজা বিরানভান্দের এক স্বপ্নপূরণের গল্প। 

    জীবনে স্বপ্ন দেখতে গিয়ে কম বাধা আসেনি, ঘুমানোর জায়গা খুঁজে বেরিয়েছেন কতো। সেই ছুটে বেড়ানোর দিনগুলো ভোলেন না বিরানভান্দ, সেগুলোই তো তাকে আজকের বিরানভান্দ বানিয়েছে! 

    রোনালদোর পেনাল্টি আটকানোর আগে থেকেই আরও অনেক বড় স্বপ্ন দেখেন। কোনও ইউরোপিয়ান ক্লাবে খেলার, ইরানের হয়ে আরও বড় কিছুর করার। 

    আলিরেজা বিরানভান্দের মতো যাযাবররা আজীবন ছুটে বেড়ান, স্বপ্নের পেছন পেছন। আর সেই দৌড়ে তৈরি হয় কতো কতো গল্প। জীবনের সেলুলয়েডে কোনও এক মাজিদি হয়তো ধরে রাখেন সেটা।

     

    তথ্যসূত্র- দ্য গার্ডিয়ান