• রাশিয়া বিশ্বকাপ ২০১৮
  • " />

     

    দ্য কিউরিয়াস কেস অফ রিকার্ডো কারেসমা

    দ্য কিউরিয়াস কেস অফ রিকার্ডো কারেসমা    

    ১.

    ২০০১ সাল। স্পোর্টিং লিসবনের হয়ে মৌসুম শেষ করেছেন কোচ লাজলো বোলিনি। অবসর সময়ে দেখতে গেলেন স্পোর্টিং-এর যুবদলের প্রীতি ম্যাচ, প্রতিপক্ষ ব্রাজিলের বাহিয়া। হঠাৎ করেই তরুণ এক উইঙ্গারের ওপর চোখ আটকে গেল তার। রক্ষণ থেকে লম্বা পাসটা দুর্দান্ত এক টাচে নিয়ন্ত্রণে আনল সে। চকিত ‘বডি ডজ’-এ মার্কারকে ছিটকে ফেললেন। মিডফিল্ডারের ‘ওয়ান-টু’ করে এগিয়ে আসলেন ডিবক্সের দিকে। কেউ কিছু বুঝে উঠার আগে ‘আউটসাইড অফ দা বুট’-এ শট নিলেন। গোলরক্ষক যেন চোখের পলকও ফেলার সময় পেলেন না। সতীর্থদের আলিঙ্গনের আগে জার্সির দুই কোণা টেনে দেখালেন দর্শকদের। জার্সিতে লেখা ‘কারেসমা ২৭’। যাওয়ার আগে ‘বি’ দলের কোচ ভিতর দামাসকে বলে গেলেন, “এই ছেলে আগামী মৌসুম মূল দলেই খেলবে।” রিকার্ডো কারেসমার উত্থানের গল্পটার শুরু সেখান থেকেই।

    ২.

    ইরানের বিপক্ষে গ্রুপপর্বের শেষ ম্যাচ পর্তুগালের। হার এড়ালেই পরের রাউন্ড নিশ্চিত। কাগজে-কলমে আকাশ পাতাল ব্যবধান হলেও ইরানিদের ইস্পাতদৃঢ় রক্ষণভাগ ভেদ করতে হিমশিম খাচ্ছিলেন স্বয়ং ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোই। পর্তুগিজরা যখন গোল না পাওয়ার নিরাশায় বুঁদ, তখনই ত্রাণকর্তার আবির্ভাব। যেন ফিরে গেলেন ১৮ বছর আগের সেই দিনটিতে। আদ্রিয়ান সিলভার সাথে ‘ওয়ান-টু’ করে উইং থেকে ভেতরে ঢুকলেন, ডিবক্সের ঠিক সামনে থেকে আচমকা মারলেন সেই ‘ট্রিভেলা’। ৬ ফুট ৪ ইঞ্চির গোলরক্ষক আলিরেজা বিরানভান্দ সমস্ত শরীর হাওয়ায় ভাসিয়েও নাগাল পেলেন না বলের। কারেসমার ট্রিভেলায় পরাস্ত গোলরক্ষক। ১৮ বছর আগেও, ১৮ বছর পরেও। কোনও এক যুবদলের প্রীতি ম্যাচেও, বিশ্বকাপেও। 

    ৩.

    ওপরের ঘটনা দুটির মাঝে মেঘে মেঘে বেলা হয়েছে অনেক। ক্যারিয়ারটা শুরু করেছিলেন ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর সতীর্থ হিসেবেই। একটা সময় রোনালদোর চেয়েও বেশি প্রতিভাবান ভাবা হত তাকেই। প্রায় দেড় যুগ পরেও দুজন খেলছেন ‘সেলেসাও’দের হয়ে। তবে পার্থক্যটা এখন আকাশ-পাতাল, অন্তত অর্জনের বিচারে। রোনালদো কঠোর পরিশ্রমে হয়েছেন বিশ্বের অন্যতম সেরা ফুটবলার। আর কারেসমা হয়েছেন পর্তুগিজদের সবচেয়ে বড় দীর্ঘশ্বাস। নিজের দিনে অপ্রতিরোধ্য, কিন্তু অন্য সময় একেবারেই অচেনা কেউ। পুরো ক্যারিয়ারটাই কাটিয়েছেন এভাবে। সুযোগ অবশ্য কম পাননি। বার্সেলোনা, ইন্টার মিলান, চেলসির মত ক্লাবগুলোতে গিয়েছিলেন, কিন্তু থিতু হতে পারেননি কোথাও। পেয়েছেন ফ্র্যাঙ্ক রাইকার্ড, হোসে মরিনহোদের মত কোচ। কিন্তু জ্বলে আর ওঠা হয়নি।

     

     

    অবশ্য কারেসমার এই অম্ল-মধুর ক্যারিয়ারের কারণটা তিনি নিজেই। কখনোই ধরা-বাঁধা নিয়ম ভাল লাগেনি তার। মা ছিলেন রোমানিয়ার বংশোদ্ভুত। সেই থেকে তার ডাকনাম ‘ও সিগানো’ (জিপসি)। ডাকনামের প্রতি সুবিচারের কথা বললে কারেসমা পাবেন লেটার মার্কস। ইউরোপের সেরা ক্লাবগুলোতে সুযোগ পাওয়ায় খেলে বেড়িয়েছেন বিশ্বজুড়ে। কিন্তু ওই যে, জেদি মানসিকতা। এ কারণেই কারেসমা যতটা না ‘সেলিব্রেটেড’, তার চেয়ে অনেক বেশি হতাশার। খুব সম্ভবত সবচেয়ে বেশি হতাশ করেছেন নিজ দেশকেই। ৩৪ বছর বয়সে এসে খেলছেন নিজের প্রথম বিশ্বকাপ! বছর দুয়েক আগে ইউরো ২০১৬ ছিল তার প্রথম প্রতিযোগিতামূলক টুর্নামেন্ট। ফাইনালে ইনজুরিতে পড়া রোনালদোর বদলে নামার আগে কানে কানে তাকে কী যেন বললেন কোচ ফার্নান্দো সান্তোস, হয়ত “আমাদের ভরসা এখন তুমিই।”

    ৪.

    ভরসার প্রতীক অবশ্য খুব বেশিবার হতে পারেননি কখনোই। রাইকার্ড-মরিনহোদের সাথে বাগবিতণ্ডায় জড়িয়ে ছেড়েছিলেন বার্সেলোনা এবং ইন্টার। তবে মাত্রা ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন '১২-এর ইউরোপা লিগের একটা ম্যাচে। অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের বিপক্ষে শেষ ষোলর প্রথম লেগের ম্যাচে প্রথমার্ধে তাকে তুলে নিয়েছিলেন তখনকার কোচ কার্লোস কারভালহাল। সিদ্ধান্ত মানতে না পেরে মাঠেই মাথা গরম করে কোচের দিকে বোতল ছুঁড়ে মারলেন কারেসমা। পরে সংবাদ সম্মেলনে কোচ ধুয়ে দিলেন কারেসমাকে। ক্লাবেই আর থাকা হলো না তার। কারেসমা ছেড়ে গেলেন বেসিকতাস, পাড়ি জমালেন কাতারের আল-আহলিতে। সেখানেও মন টিকছিল না তার। ফিরে আসলেন ছেলেবেলার পোর্তোতে। এখান থেকেই শুরু হল ফিনিক্স পাখির মত তার ভস্ম থেকে মাথা তুলে দাঁড়ানোর গল্প।

     

     

    পোর্তোতে ফেরার বছরখানেক পরের কথা। অবশেষে কোনো ক্লাবে থিতু হয়েছেন কারেসমা, খেলছেনও সামর্থ্য অনুযায়ী। চ্যাম্পিয়নস লিগে তার জোড়া গোলেই বায়ার্নকে হারিয়েছিল পোর্তো। ইউরোপ মাতালেও জাতীয় দলের দরজা ছিল বন্ধই। ২০১৪ বিশ্বকাপে তাকে দলে নিলেন না পাওলো বেন্তো। ইউরো ২০১৬-এর বাছাইপর্ব চলাকালেই বেন্তো বরখাস্ত হওয়ার পর কপাল খুলে যায় কারেসমার। তার জায়গায় আসলেন ফার্নান্দো সান্তোস, যার অধীনে সেই ২০০১-০২ মৌসুমে পর্তুগিজ ‘ট্রেবল’ (লিগ, কাপ, সুপারকাপ) জিতেছিলেন কারেসমা। কোচ হওয়ার পরই সান্তোসের সাথে দেখা করলেন তিনি, যদি একটা সুযোগ পাওয়া যায়। এককালের ছাত্রকে অগ্রাহ্য করতে পারলেন না সান্তোস। তবে শর্ত জুড়ে দিলেন। নিয়ম মেনে চললে আর পারফরম্যান্স ভাল থাকলে তবেই কেবল সুযোগ পাবেন দলে। কথা দিলেন কারেসমা। এর কয়েকদিক আগে কারেসমার ছেলে পেদ্রোও বলেছিল, স্কুলে তাকে বাবার ক্যারিয়ার নিয়ে কথা শোনায় অনেকেই। আর কিছু না হোক, ছেলের মান বাঁচাতে হলেও শৃঙ্খলায় ফিরতে হবে কারেসমাকে। প্রতিজ্ঞাই করেছিলেন বোধ হয়, এবার আর হতাশা নয়; আসল কারেসমাকেই দেখবে বিশ্ব।

     

     

     

    ৫.

    কথা রাখলেন কারেসমা, সান্তোসও ফিরিয়ে আনলেন দলে। ক্যারিয়ারে যখন অন্যরা বুটজোড়া তুলে রাখার সিদ্ধান্ত নেন, তখনই যেন পুনর্জন্ম হল পর্তুগিজদের প্রিয় 'জিপসি'র। ২০১৬ ইউরো বাছাইপর্বে নিজের প্রথম ম্যাচে ডেনমার্কের বিপক্ষে নামলেন ৮৪ মিনিটে। ম্যাচ যখন এগুচ্ছে নিশ্চিত ড্রয়ের দিকে, তখনই ডানপ্রান্ত থেকে মাপা এক ক্রস করলেন কারেসমা। হেডে গোল করলেন রোনালদো। এরপরের গল্পটা শুধুই উত্থানের। বাছাইপর্বে এরপর থেকে পর্তুগাল দলে অপরিহার্য হয়ে উঠলেন ‘জিপসি’ কারেসমা। সিক্ত হলেন সমর্থকদের ভালবাসায়। সুযোগ পেয়ে গেলেন ‘১৬-এর ইউরো দলেও। পোল্যান্ডের বিপক্ষে পর্তুগালের জয়সূচক পেনাল্টি নিয়েছিলেন তিনিই। আস্থার পূর্ণ প্রতিদান দিলেন সতীর্থ, অধিনায়ক রোনালদো ও কোচ সান্তোসের। কারেসমার যখন রোনালদোর আলিঙ্গনে আবদ্ধ হয়ে উদযাপন করছিলেন গ্যালারির পর্তুগিজ সমর্থকদের সাথে, তখন ‘রিকি তে আমো!’ (রিকার্ডো তোমায় ভালবাসি) চিৎকারে মুখরিত হয়ে উঠেছিল গ্যালারি। রোনালদোর চেয়েও সে রাতে পর্তুগিজদের কাছে জনপ্রিয় ছিলেন একজন। রিকার্ডো আন্দ্রাদে কারেসমা বের্নার্দো। ফাইনালে এডারের গোলে জিতলেও পুরো ম্যাচে আক্রমণে পর্তুগালের সেরা খেলোয়াড় ছিলেন কারেসমাই।

     

     

    ইউরোর আবেগ কাটতে না কাটতেই বিশ্বকাপ। ৩৪ বছর বয়সে ক্যারিয়ারের সায়াহ্নে চলে আসলেও কারেসমাকে দলে নিতে দুবার ভাবেননি সান্তোস। বয়সকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে এগিয়ে চলছেন পুরনো উদ্যমে। আগের চেয়ে অনেক পরিণত এই কারেসমা। মাথা গরম করেন না, মুখে সবসময়ই লেগে থাকে হাসি। বাছাইপর্বেও পারফরম্যান্স ছিল দারুণ। মূলপর্বে গতকালের আগে পর্তুগালের সবগুলো গোল করেছিলেন রোনালদোই। ‘সিআর৭’ যেদিন ব্যর্থ হলেন, পর্তুগালের চিত্রনাট্যে পার্শ্বনায়কের চরিত্র ছেড়ে মূলনায়কের রোলে আবির্ভূত হলেন কারেসমা। তার ‘ট্রিভেলা’য় ভেসেই দ্বিতীয় রাউন্ডে পর্তুগাল। উরুগুয়ের বিপক্ষে দ্বিতীয় রাউন্ডে খেলবে পর্তুগাল। বরাবরের মত মূল ভরসা থাকবেন রোনালদোই। তবে কারেসমা গতরাতে ঠিকই প্রমাণ করেছেন, ভরসা যার ওপরই থাক, তার সামর্থ্যের কাছে হার মানতে বাধ্য যেকোনো প্রতিপক্ষই।