মেসি-রোহোর ডান পায়ে টিকে রইল আর্জেন্টিনা
সেন্ট পিটার্সবার্গে গ্যালারি ভর্তি আর্জেন্টিনা সমর্থকদের গান মিলিয়ে গেছে ততক্ষণে। অথচ প্রথমার্ধ শেষেও যে সমীকরণ ছিল, তাতে লিওনেল মেসির গোলে এগিয়ে থেকে দ্বিতীয় রাউন্ডে যাওয়ার কথা আর্জেন্টিনার। দ্বিতীয়ার্ধেই বদলে গেল সব সমীকরণ। নাইজেরিয়া ফিরল ম্যাচে, অন্যদিকে আইসল্যান্ডও পেছন থেকে ফিরে এসেছে। আর আর্জেন্টিনা তখন আরও একবার দিশেহারা। আর্জেন্টাইন সমর্থকদের গলায় জোর উঠল মার্কোস রোহোর তৈরী করা একটা মুহুর্তের পর। গ্যব্রিয়েল মের্কাদোর ডান দিক থেকে আসা ক্রসে আর্জেন্টিনাকে জীবন ফিরিয়ে দিলেন রোহো। ডান পায়ের দারুণ ফিনিশে যে গোল করলেন, সেটা স্ট্রাইকারদেরই লজ্জায় ফেলে দেবে! সেটাই বড় একটা অস্বস্তি থেকে বাঁচাল আর্জেন্টিনাকে। ২-১ গোলে জিতে বিশ্বকাপে টিকে রইল আর্জেন্টিনা।
অথচ রোহোর সেখানে থাকারই কথা ছিল না। ৮৬ মিনিটের ওই গোলের সময় হুট করেই ছিলেন ডিবক্সের ভেতর। সেটা যেমন নাইজেরিয়াকে ছিটকে ফেলেছে, এর আগে রোহোর কারণেই ম্যাচটা জিতে যেতে পারত সুপার ঈগলরা। ডান দিক থেকে আসা নাইজেরিয়ার একটা ক্রসে হেড করতে লাফ দিয়েছিলেন রোহো। সেটা হাতেই লেগেছিল তার। এরপরও নাইজেরিয়ার স্ট্রাইকার ইঘালো শট করেছিলেন, কিন্তু ফাঁকা বারে মেরেছেন বাইরে দিয়ে। কিন্তু এরপর উত্তেজনা ছড়িয়েছে রোহোর সম্ভাব্য হ্যান্ডবলের ঘটনাই। যদিও উদ্দেশ্য প্রণোদিত ছিল না সেটা। তবুও রেফারি চাইলে পেনাল্টি দিতেও পারতেন। কিন্তু ভিএআরের সাহায্য নিয়েও রেফারি রাখলেন তার পুরনো সিদ্ধান্তটাই। পেনাল্টি পেল না নাইজেরিয়া। রোহোর কপালই বটে!
এসব কিছুর আগেই অবশ্য আর্জেন্টিনাকে সেন্ট পিটার্সবার্গে উজ্জীবিত করেছেন লিওনেল মেসি। বাঁচা মরার লড়াইয়ে যার দিকে চেয়ে ছিল আর্জেন্টিনা, সেই তিনিই সময়মতো জ্বলে উঠলেন আরেকবার। দলের কাছ থেকেও সাহায্যটা পেয়েছেন মেসি। এভার বানেগা, গঞ্জালো হিগুয়াইনকে নামিয়ে কোচ হোর্হে সাম্পাওলি পরিবর্তন এনেছিলেন দলে। সেটা কাজ করল টনিকের মতো। ১৪ মিনিটে বানেগার মাঝমাঠ থেকে বাড়ানো বল খুঁজে পেয়েছিল মেসিকে। তিনি বাঁ উরু দিয়ে বল রিসিভ করলেন, এরপর নিয়ে গেলেন সুবিধামতো জায়গায়। তারপর ডান পায়ের চোখ ধাঁধানো ফিনিশে নাইজেরিয়ার জালে বল। বিশ্বকাপে ৬৮৮ মিনিটের গোলখরা ঘুচল তাতে মেসির। শেষ এই নাইজেরিয়ার সঙ্গেই বিশ্বকাপে গোল করেছিলেন তিনি, ২০১৪ সালে। চক্রটা পূরণ করলেন আজ, উল্লসিত মেসিকে দেখল বিশ্বকাপ। সেটাও আবার হয়ে গেল এই বিশ্বকাপের শততম গোল।
প্রথমার্ধে মেসির আরও একটা দুর্দান্ত মুহুর্ত দেখতে পারত সেন্ট পিটার্সবার্গ। ১৯ বছর বয়সী গোলরক্ষক ফ্রান্সিস উজোহার আঙ্গুলের ছোঁয়ায় ডিবক্সের ঠিক বাইরে থেকে পাওয়া ফ্রি কিকে গোল পাওয়া হয়নি মেসির। স্বস্তির দুই গোলের লিডটাও তাই নেওয়া হয়নি তাদের। মেসির থ্রু পাস থেকে হিগুয়াইনও একটা গোল করতে পারতেন, সেটাও হয়নি। প্রথমার্ধে দল পরিবর্তনের সুফলটা পেলেও দ্বিতীয়ার্ধের শুরু থেকেই আবারও এলোমেলো আর্জেন্টিনার খেলা। নাইজেরিয়ার কর্নার নেওয়ার সময় লিওন বালোগানকে ধরে রেখেছিলেন হাভিয়ের মাসচেরানো। প্রথমার্ধে মাসচেরানোকে দেখা গিয়েছিল পুরনো ফর্মে। কিন্তু দ্বিতীয়ার্ধে তার ফাউলেই কপাল পুড়েছে আর্জেন্টিনার। বালোগানকে করা ফাউল চোখ এড়ায়নি রেফারির সুনেইত সাকিরের। আর্জেন্টিনার জার্সিতে প্রথমবার খেলতে নামা গোলরক্ষক ফ্রাঙ্কো আর্মানিও নায়ক হয়ে উঠতে পারেননি। ভিক্টর মোসেস তাকে বোকা বানিয়ে সহজেই বল জড়িয়েছেন জালে। নাটকের সে অধ্যায়ে নাইজেরিয়াই তখন দ্বিতীয় রাউন্ডের পথে।
গোল হজম করে আর্জেন্টিনার খেলা হয়ে গেল আরও এলোমেলো। পরে ম্যাচের ঘন্টা খানেক পার হওয়ার পর ক্রিশ্চিয়ান পাভন নেমে ডান দিক থেকে বেশ কয়েকটি সম্ভাবনাময় ক্রস করেছিলেন। তবে কোনোটাই সফল হয়নি। বিরতির সময় নামা নাইজেরিয়ার বদলি ওডিওন ইঘালো গোলরক্ষকের সঙ্গে ওয়ান অন ওয়ানে থেকেও গোলটা করতে পারেননি। আর্মানি বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন তখন। এরপর ম্যাচের গল্পটা একইরকম, আর্জেন্টিনার আক্রমণ আর নাইজেরিয়ার লড়াই। তবে আর্জেন্টিনার গতিহীন আক্রমণে নাইজেরিয়াকে বেগ পেতে হচ্ছিল না মোটেও। তার ওপর হিগুয়াইন ভালো জায়গা থেকেও বারপোস্টের ওপর দিয়ে বল মারলে হতাশা আরও বাড়ে আর্জেন্টাইনদের।
রোস্তভে আরেক ম্যাচে আইসল্যান্ড সমতায় ফেরার পর টনক নড়ে সাম্পাওলি। অল-আউট অ্যাটাকে যেতে ডিফেন্ডারকে বসিয়ে সার্জিও আগুয়েরোকে নামিয়ে দেন তিনি। এর আগে ম্যাক্সিমিলিয়ানো মেজাও নেমেছিলেন, কিন্তু তিনিও হতাশাই যোগ করেছেন দলের খেলায়। সব হতাশা কেটেছে শেষে রোহোর ওই গোলে। গত বিশ্বকাপে নাইজেরিয়াকে হারানোর ম্যাচেও জয়সূচক গোলটা করেছিলেন তিনিই, রোহোও মেসির মতো পূরণ করেছেন চক্রটা। তবে তখনও বাকি নাটক। অন্য ম্যাচে আইসল্যান্ড আরেকটা গোল দিয়ে দিলেই জিতেও লাভ হত না আর্জেন্টিনার। আগের ম্যাচে আর্জেন্টিনাকে হারিয়ে বিপদের দিকে ঠেলে দিয়েছিল ক্রোয়েশিয়া, এরপর ক্রোয়াটদের কাছে আর্জেন্টাইনদের যতটুকু চাওয়া ছিল, সেটাও পূরণ করল তারা। ৯১ মিনিটে ইভান পেরিসিচের গোলে আইসল্যান্ডের স্বপ্নটাও ভেঙে দিয়েছে তারা।
ম্যাচ শেষে সেন্ট পিটার্সবার্গের উৎসব রোজারিও, বুয়েনস আইরেস হয়ে আছড়ে পড়ে ঢাকার অলিগলিতেও। খাদের কিনার থেকে বিশ্বকাপে এসেছিল আর্জেন্টিনা, রোমাঞ্চ জাগিয়ে। আরেক রোমাঞ্চ জাগিয়ে গ্রুপপর্ব পার হলো লা আলবিসেলেস্তেরা। দ্বিতীয় রাউন্ডে প্রতিপক্ষ ফ্রান্স, ৩০ জুলাই কাজানে।
আর্জেন্টিনা একাদশ
আর্মানি, মের্কাদো, রোহো, অটামেন্ডি, টালিয়াফিকো, মাসচেরানো, বানেগা, পেরেজ, মেসি, ডি মারিয়া, হিগুয়াইন
নাইজেরিয়া একাদশ
উজোহো, ইদোউ, একম, বালোগান, ওমেরু, এনদিদি, এতেবো, ওবি মিকেল, মুসা, মোসেস, ইহেনাচো