• অ্যাশেজ
  • " />

     

    ‘বডিলাইন’ অথবা ‘ফাস্ট লেগ থিওরি’ র গল্প - ৩

    ‘বডিলাইন’ অথবা ‘ফাস্ট লেগ থিওরি’ র গল্প - ৩    

    অ্যাশেজ! ক্রিকেটের সবচাইতে পুরানো দ্বৈরথ। এর রন্ধ্রে রন্ধ্রে ইতিহাস, পরতে পরতে আভিজাত্য। ক্রিকেট এখানে শুধুই খেলা নয়, ক্রিকেট এখানে জাতিগত বৈরিতার প্রতীক। শত বছরের পুরানো এই সিরিজে কারো স্বপ্ন ভেঙ্গেছে, নতুন তারকার জন্ম হয়েছে, কেউবা আবার সবুজ মাঠের আশ্রয় ছেড়ে জায়গা পেয়েছেন অমর রূপকথার কাব্যে।

     

    অ্যাশেজে ক্রিকেট জীবনের অংশ নয়, বরং জীবনই এখানে হয়ে যায় ক্রিকেট। ছোট্ট এই ভস্মাধারের প্রতি আবেগ যে কত তীব্র তা প্রথম অনুভূত হয় ১৯২৮-২৯ এ, ইংল্যান্ডের অস্ট্রেলিয়া সফরে। জন্ম হয় ক্রিকেটের অলটাইম কিছু গ্রেটদের। এর ফলশ্রুতিতে আসে কুখ্যাত বডিলাইন সিরিজ। এই ধারাবাহিকটি বডিলাইন অ্যাশেজেরই পূর্বাপর আর খুঁটিনাটির উপর আলোকপাত করার একটা প্রয়াস। 

     

     


     

    প্রথম পর্বঃ 'বডিলাইন’ অথবা ‘ফাস্ট লেগ থিওরি’ র গল্প - ১

    দ্বিতীয় পর্বঃ'বডিলাইন’ অথবা ‘ফাস্ট লেগ থিওরি’ র গল্প -২

     


     

     

    ৭। অতঃপর জার্ডিন

     

    রবার্ট ডগলাস জার্ডিনকে মনে আছে তো? ঐ যে অস্ট্রেলিয়া সফরের শেষ ইনিংসে ডাক মেরেই যিনি জাহাজ চেপে ভারত চলে গেলেন। ইংল্যান্ড শিবির কোন এক অজ্ঞাত কারণে ১৯৩০ সালের অ্যাশেজের প্রথম চারটি টেস্টেই তাঁকে বসিয়ে রাখে। অবশেষে তিনি ওভাল টেস্টে সুযোগ পান এবং শুনতে অবাক লাগলেও ফিরে এসেই ঐ টেস্টে তিনি অধিনায়কের দায়িত্বও পালন করেন। শেষ টেস্টে নিয়মিত অধিনায়ক চ্যাপম্যান বাজে ফর্মের জন্যে না খেলে বব ওয়াইটকে সুযোগ করে দেয়ার ফলেই অধিনায়কত্ব তাঁর হাতে আসে। ব্র্যাডম্যানের সৌজন্যে তাঁর ঐ টেস্ট যে হারতে হয় তা তো ইতোমধ্যেই আপনারা জেনে গেছেন।

     

    পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সাকিব আল হাসান একবার সিরিজ মিস করেছিলেন মনে আছে? উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার জন্যে পাকিস্তান না যাওয়ায় তখন পাকিস্তানের অধিনায়ক বলেছিলেন, ‘আমাদের হলে তো ওকে এমনিতেই পাশ করিয়ে দিতাম, পরীক্ষা দেয়া লাগতো না’। জার্ডিনের ব্যাপার অবশ্য ভিন্ন ছিল- ঐ অ্যাশেজের পরবর্তী মৌসুমে জার্ডিনকে সাসেক্সের অধিনায়ক হবার প্রস্তাব দেয়া হলেও তিনি প্রত্যাখ্যান করেন ব্যবসাতে সময় ঠিকমত দিতে পারবেন না বলে! তাঁকে দায় দিয়ে লাভ নেই, এখনকার মত টাকার ঝনঝনানি তো আর তখন ক্রিকেটে ছিল না, ক্রিকেটাররা তখন নেহায়েতই শখ আর সম্মানের জন্যে খেলতেন। সংসার সামলানোর জন্যে অন্য উপায় তাই বের করতেই হতো।

     

    সাসেক্সের অধিনায়ক না হলেও ১৯৩১ সালে নিউজিল্যান্ড এর বিপক্ষে টেস্টের জন্যে জার্ডিনকে আবার অধিনায়ক করা হয়। ইংলিশ ক্রিকেট আসলে তখন একজন অধিনায়ক খুঁজছিল, লক্ষ্য ছিল পরের বছর অস্ট্রেলিয়া সফরের দল একজন দক্ষ নেতার অধীনে সোপর্দ করা। জার্ডিন প্রতিভাবান অধিনায়ক ছিলেন সত্যি, কিন্তু পরীক্ষিত ছিলেন না। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্টগুলোতে তাই তাঁকে আতসী কাঁচের নিচে রেখে পর্যবেক্ষণ করা হয়। তিনি যে সে পরীক্ষায় পাশ করেছিলেন তা কিন্তু বলা যাবে না, সতীর্থ অনেকেই তাঁর উপর ক্ষুব্ধ ছিলেন ‘রুক্ষ এবং একগুঁয়ে’ আচরণের জন্যে। দলের তরুণ খেলোয়াড়দের বাজেভাবে তিরস্কার করার জন্যেও তিনি সমালোচিত হয়েছিলেন।

     

    তবে পুরো মৌসুমে ব্যাট হাতে তাঁর ধারাবাহিকতার জন্যে সাসেক্স পুনরায় ১৯৩২ সালের শুরুতে তাঁকে অধিনায়ক হতে প্রস্তাব করে। এবার তিনি অবশ্য ফিরিয়ে দেন নি। একগুঁয়ে মনোভাব থেকে ঐ মৌসুমেই তিনি হয়ে উঠেন একজন আগ্রাসী অধিনায়ক। পয়েন্ট টেবিলে সাসেক্স বিগত ৬ বছরে তাদের সেরা অবস্থান অর্জন করে।

     

    ভারত সে বছরেই তাদের প্রথম টেস্ট খেলার জন্যে ইংল্যান্ড সফর করে এবং জার্ডিন তাতে অধিনায়কত্বের দায়িত্ব পান। অভিষেক টেস্টে ভারতের উজ্জীবিত বোলিং স্বাগতিকদের সাংঘাতিক বিপর্যয়ের মুখে ফেলে। তবে প্রথম ইনিংসে জার্ডিনের ৭৯ আর দ্বিতীয় ইনিংসে অপরাজিত ৮৫ এর বদৌলতে ইংল্যান্ড ম্যাচ জিতে যায়। বিশ্লেষকরা বলেন, জার্ডিনের প্রখর ক্রিকেটবোধ আর লড়াকু মানসিকতার জন্যেই ইংল্যান্ড ঐ টেস্ট হেরে লজ্জার মুখোমুখি হয়নি।

     

    ভারতের বিপক্ষে ঐ টেস্টের পর জার্ডিনকে অস্ট্রেলিয়া সফরে অধিনায়ক করার দাবি জোরালো হলেও নির্বাচকরা তখন পর্যন্ত নিশ্চিত ছিলেন না। একদম শেষ মুহুর্তে অনেক ‘যদি’ আর ‘কিন্তু’র পর তাঁকে অধিনায়ক ঘোষণা দেয়া হয়। ক্রিকেট ইতিহাসের সবচাইতে বিতর্কিত ঘটনা প্রবাহেরও তখন থেকেই সূত্রপাত ঘটে।

     

    ৮। ব্র্যাডম্যানের দুর্বলতা!!!

     

    নাহ, শিরোনাম ভুল পড়েন নি। যার ব্যাটিং গড় অল্পের জন্যে তিন অঙ্ক ছোঁয়নি, তাঁর  আবার কি কোন দুর্বলতা থাকতে পারে? এখনকার যুগ হলে নিশ্চিতভাবেই ব্র্যাডম্যানের ভিডিও ফুটেজ দেখে পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করা হতো, তাঁর প্রত্যেকটা শট পর্যালোচনা করা হত।

     

    কিন্তু জার্ডিন সেই ১৯৩২ সালেই ভিডিও ফুটেজ দেখে কৌশল নির্ধারণের ব্যাপার ভেবেছিলেন। আগের অ্যাশেজের শেষ টেস্টের কয়েকটি ফুটেজ দেখে তিনি নিশ্চিত হন যে, লেগ স্ট্যাম্পের উপর সোজা ফাস্ট বল করলে ব্র্যাডম্যান স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না! পার্সি ফেন্ডার, আগের অস্ট্রেলিয়া সফরের ইংলিশ অধিনায়ক, সর্বপ্রথমে তাঁকে এ কথাটা বলেছিলেন। পাশাপাশি অস্ট্রেলিয়া থেকে আসা কিছু চিঠি এবং সংবাদপত্রের কাটিং -ও পার্সি দেখান জার্ডিনকে; যেখানে বলা ছিল- পুরো মৌসুম ব্র্যাডম্যান ফাস্ট বোলারদের বিরুদ্ধে স্বাচ্ছন্দ্য ছিলেন না। লেগ স্ট্যাম্পের উপর লাফিয়ে উঠা দ্রুত গতির বল গুলোতে তিনি বেশ কয়েকবার আউট হয়েছেন। একজন বুদ্ধিমান অধিনায়কের যা করা দরকার ছিল, জার্ডিন তখন তাই করলেন; রণপরিকল্পনা সাজাতে লাগলেন ফাস্ট বোলারদের অগ্রাধিকার দিয়ে।

     

    ৯। রণপ্রস্তুতি

     

    আগস্টের শেষ প্রায়। সন্ধ্যা নামতেই ইংল্যান্ডের বাতাস শীতের আগমনী বার্তার গান শুনিয়ে যায়। লন্ডনের ব্যস্ত জীবনের এমনি এক সাধারণ বিকেলে পিকাডেলি হোটেলে জার্ডিন আলাপে বসলেন আর্থার কার-এর সাথে। আর্থার ছিলেন নটিংহ্যামশায়ারের অধিনায়ক, সাথে করে তিনি এনেছিলেন তাঁর দলের দুজন ফাস্ট বোলার হ্যারল্ড লারউড আর বিল ভোক-কে। লারউড কে মনে পড়ছে? আগের অস্ট্রেলিয়া সফরে ধারাবাহিকভাবে অসাধারণ বল করেছিলেন তিনি। কিন্তু ওয়ালি হ্যামন্ডের অতিমানবীয় কীর্তিতে তাঁর নাম তেমন প্রচারে আসেনি।

     

    জার্ডিনের পরিকল্পনা ছিল আপাতভাবে সাধারণ- লেগস্ট্যাম্পের উপরের দ্রুতগতির বলে যেহেতু ব্র্যাডম্যান দুর্বল, তাই তাঁকে ঐ লাইন আর লেংথেই ক্রমাগত বল করে যেতে হবে। এভাবে বল করলে অফসাইডে শট খেলাও সম্ভব হবে না, ঠেকাতে গেলে শর্টে ক্যাচ উঠবে। আর ব্যাটসম্যান আক্রমণাত্মক হয়ে পুল কিংবা হুক করলে সীমানার কাছে ক্যাচ উঠার সম্ভাবনা তৈরি হবে। যেহেতু অফসাইডে বল যাবার সম্ভাবনা একেবারেই কম, তাই লেগসাইডে শর্টে ছাতার মত ফিল্ডার দাঁড়িয়ে থাকবে ক্যাচ ধরার জন্যে। সাথে ডিপ লেগ আর থার্ডম্যান পজিশনে আরো দুইজন দাঁড়াবে যাতে ব্যাটসম্যান পুল শট না খেলে। লেগ স্লিপে দুইজন দাঁড় করানোর ধারণাও তখন বের হয়। জার্ডিন, লারউড আর বিলকে পরামর্শ দেন, সফরের আগের কয়দিন তাঁরা যেন এইভাবে ক্রমাগত বল করার অনুশীলন করতে থাকেন।

     

    ছোট এক টেবিলে চারজন ব্যাক্তির সেই বৈকালিক আড্ডা থেকেই জন্ম নিল ক্রিকেট ইতিহাসের সবচাইতে কুখ্যাত বোলিং পরিকল্পনার। আপাতদৃষ্টিতে এতে কোন অস্বাভাবিকতা না থাকলেও এই পরিকল্পনাই কয়দিন পর দুই দেশের গণমাধ্যমকে দাঁড় করিয়ে দিল সম্মুখ সমরে।

     

    ১০। প্রথম বাস্তবায়ন

     

    ১৯৩২-এ অস্ট্রেলিয়া সফর করা ইংলিশ দলটিতে পেসার ছিলেন পাঁচজন। লারউড, বিল এবং মরিস টেট প্রচন্ড গতিতে বল করতে পারতেন। সাথে গাবি অ্যালেন আর হ্যামন্ডের মিডিয়াম পেস নিয়ে ঐ ইংল্যান্ড দলের ছিল বেশ শক্তিশালী পেস আক্রমণ।

     

    সফর শুরুর প্রস্তুতি ম্যাচগুলোতে অবশ্য জার্ডিনের ঐ কৌশল দেখা যায়নি। বোলাররা লেগস্ট্যাম্পের উপর বাউন্সার দিচ্ছিলেন ঠিক, কিন্তু সেটা ক্রমাগতভাবে নয়; সাথে লেগ সাইডে ছাতার মত ঘিরে ধরার ফিল্ডিং কৌশলও ছিলনা।

     

    প্রথম টেস্টের আগে এক প্রস্তুতি ম্যাচে বিল উডফুল এর নেতৃত্বে ‘অস্ট্রেলিয়ান একাদশ’ নাম নিয়ে মোটামুটি প্রথম টেস্টের একাদশই মাঠে নেমে পরে। জার্ডিন ঐ ম্যাচটা খেলেননি, তাঁর ডেপুটি বব ওয়াইট ঐ ম্যাচে অধিনায়ক হয়েই তাঁদের পরিকল্পনার পূর্ণরূপ বাস্তবায়ন করলেন। লেগস্ট্যাম্পের উপর ক্রমাগত শরীর লক্ষ্য করে ধেয়ে আসা বাউন্সার, সাথে শকুনের মত ক্যাচের জন্যে শর্টলেগ আর স্লিপে ওঁত পেতে থাকা একগাদা ফিল্ডার; অস্ট্রেলিয়ানরা রান করবে কি, শরীর বাঁচাতেই তাঁরা হিমসিম খেয়ে যাচ্ছিল।

     

     

    তখন আধুনিককালের মত হেলমেট ছিলনা; আর্ম-গার্ড, চেস্ট-গার্ডের বালাই ছিলনা। অনেকে বাহুল্যতা আর শৌর্যহীনতার প্রতীক ভেবে হ্যান্ড-গ্লাভসও পরতেন না। তাই ম্যাচটা শোচনীয়ভাবে হারার সাথে অসি ব্যাটসম্যানদের সঙ্গী হয় বুক, পেট আর হাতে অজস্র কালশিটে দাগ। ব্র্যাডম্যান অদ্ভুতভাবে টেনিসের মত ব্যাকহ্যান্ড, ফোরহ্যান্ড শট খেলে রান করার চেষ্টা করেছিলেন; কিন্তু ব্যর্থ হন। ব্র্যাডম্যানের ব্যর্থতায় উজ্জীবিত ইংলিশরা প্রবল উদ্যমে প্রথম টেস্ট খেলার জন্যে অপেক্ষা করতে থাকে।

     

    ১১। ‘ফাস্ট লেগ থিওরি’ নাকি ‘বডিলাইন’?

     

    বিখ্যাত হবার দুটো উপায় আছে। আপনি ভাল কিছু করবেন যাতে মানুষ আপনাকে মনে রাখে অথবা এমন কিছু করবেন যাতে ঘৃণার সাথে আপনার নাম লোকে উচ্চারণ করে। হ্যারল্ড লারউড আগের সফরে ভালো বল করেছিলেন, উইকেটও পেয়েছিলেন অনেকগুলো। অস্ট্রেলিয়ানরা তখন তাঁর প্রাপ্য সম্মানটুকু দেয়নি। দেশে ফিরেও দেখলেন হ্যামন্ডকে নিয়েই গণমানুষের উচ্ছ্বাস, তাঁকে নিয়ে পত্র-পত্রিকাতেও তেমন লেখা নেই।

     

    লারউড হয়তো ভিতরে ভিতরে ফুঁসে ছিলেন, কিংবা হয়তো ছিলেন না- এতকাল পরে সেটা আর কে বলতে পারে? তবে এতদিন ধরে চলে আসা উপেক্ষার জবাব তিনি দিলেন সিডনীতে প্রথম টেস্টে একটানা লেগস্ট্যাম্পের উপরে শরীর লক্ষ্য করে বাউন্সার দিয়ে। প্রথম ইনিংসে স্ট্যান ম্যাককেবের অপরাজিত ১৮৭ রানের বদৌলতে অস্ট্রেলিয়া তাও ৩৬০ রান করে, কিন্তু দ্বিতীয় ইনিংসে তাঁর ছোঁড়া গোলার সামনে একদমই দাঁড়াতে পারেনি অজি ব্যাটসম্যানরা, অল আউট হয় ১৬৪ রানে। লারউড দ্বিতীয় ইনিংসে মাত্র ২৮ রান খরচায় ৫ উইকেট তুলে নেন। সাথে প্রথম ইনিংসের ৫ উইকেট নিয়ে মোট ম্যাচ উইকেট দাঁড়ায় ১০-এ। প্রথম ইনিংসে হারবার্ট সাটক্লিফ, ওয়াল্টার হ্যামন্ড আর পতৌদির নবাবের সেঞ্চুরিতে ৫২৪ রান করা ইংল্যান্ডের লক্ষ্য দাঁড়ায় মাত্র এক রান। ফলাফল ১০ উইকেটের বিজয়।

     

    এই ম্যাচের পর অস্ট্রেলীয় গণমাধ্যমে আগুন লেগে যায়। যেই লারউড আগের সফরে পত্রিকায় একটুও জায়গা পাননি, তাঁকে নিয়ে অস্ট্রেলীয় পত্রিকাগুলোতে প্রতিবেদন ছাপা শুরু হয়। নেতিবাচকভাবে লারউড অস্ট্রেলিয়াতে ‘বিখ্যাত’ হয়ে যান। প্রস্তুতি ম্যাচে খেলোয়াড়দের আঘাত পেতে দেখে এমনিতেই অস্ট্রেলীয় দর্শকরা ছিলেন ক্ষুব্ধ। প্রথম টেস্টের পর সেই আগুনে ঘি পড়ে। পরিস্থিতি এতটাই বাজে হয়ে যায় যে, ইংলিশ দল জনসম্মুখেই আর আসতে চাইত না।

     

    শরীর লক্ষ্য করে বাউন্সার দেয়ার এই কৌশলকেই অস্ট্রেলীয়রা নাম দেয় ‘বডিলাইন’। আর ইংল্যান্ড দলের সাথে সফররত ইংলিশ সাংবাদিক লন্ডনে তারবার্তা পাঠান ‘ফাস্ট লেগ থিওরি’ নাম দিয়ে। স্বাভাবিকভাবেই তাঁদের বার্তায় জার্ডিন আর লারউডের উচ্চকিত প্রশংসা করা হয়। অস্ট্রেলীয় গণমাধ্যম আর জনমানুষের তীব্র রোষের আঁচ যে ইংল্যান্ডে পৌঁছায় নি ব্যাপারটা সেরকম নয়। তবে তখন তো আর ভিডিও পাঠানোর উপায় ছিল না। ক্রিকেটের আইনকানুন প্রণেতা ‘মেরিলিবোর্ন ক্রিকেট ক্লাব’ তাই বুঝতে পারছিল না এই কৌশলে এত শোরগোলের কি আছে!

     

    ব্রিটিশ গণমাধ্যম উল্টো অস্ট্রেলীয়দের ‘ক্রাই বেবি’ সম্বোধন করে বসে। ১০ উইকেটে হারের জ্বালা সহ্য করতে না পেরেই অসিরা এমন শোর তুলেছে বলে ‘লন্ডন টাইমস’ রায় দিয়ে দেয়। এই খবর তারবার্তার মাধ্যমে আবার অস্ট্রেলিয়া পৌঁছালে জনরোষের মাত্রা আরো বেড়ে যায়। চলতে থাকে পাল্টাপাল্টি তারবার্তা বিনিময়। বোঝাই যায়, ইংলিশদের কাছে যেটা ছিল ‘ক্রিকেটীয় প্রজ্ঞা’, অস্ট্রেলীয়দের কাছে সেটা ছিল ‘নেতিবাচক ক্রিকেটের নিকৃষ্ট প্রজ্ঞাপন’।

     

    'বডিলাইন' নিয়ে ইংলিশ আর অস্ট্রেলীয় পত্রপত্রিকা 

     

    গত বিশ্বকাপে রোহিত শর্মার ঐ বিতর্কিত নো বল নিয়ে আপনি নিশ্চয়ই বিমর্ষ হয়েছিলেন। হয়তো অতিরিক্ত আগ্রাসী হয়ে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে ভারতীয় সমর্থকদের সাথে বাকযুদ্ধে জড়াতেও দ্বিধা করেন নি। ক্রিকেট আসলে এমনই, সমর্থকদের আবেগ এই ‘ভদ্রলোকের খেলা’ টাকে নিয়ে প্রায়ই ভদ্রতার সীমা ছাড়িয়ে যায়। প্রায় শত বছর আগেও দুই জাতিকে এই খেলা রণসম্মুখে দাঁড় করিয়েছিল, এখনো করাচ্ছে, হয়ত আগামী একশ বছর পরেও করাবে।

     

    বডিলাইন সিরিজ কিন্তু এখানেই শেষ নয়! নাটকের তো প্রথম টেস্টে কেবল শুরু। তাছাড়া ঐ টেস্টে ব্র্যাডম্যান অসুস্থতার জন্যে খেলেনও নি। অবশ্য জার্ডিন মনে করেছিলেন, তাঁর কৌশলে ভয় পেয়ে 'নার্ভাস ব্রেকডাউন'-র জন্য খেলেননি ডন। যাকে আটকানোর জন্যে ইংলিশদের এই ফাঁদ পাতা, তিনি কেমন সাড়া দিয়েছিলেন পরে? এই উত্তর পরবর্তী পর্বের জন্যে তোলা থাকল।

     

    (চলবে)