বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্ব: দ্য গুড, দ্য ব্যাড অ্যান্ড দ্য আগলি
গ্যারি লিনেকারের টুইট নিয়ে এমনিতেই মহাকাব্য লিখে ফেলা যাবে। ইংলিশ কিংবদন্তির রসবোধেরও জবাব নেই। তবে এবারের বিশ্বকাপ কেমন হচ্ছে, সেটা নিয়ে তাঁর একটা টুইটই বলে দিচ্ছে সবকিছু, ‘আপনি যদি ফুটবল অপছন্দ করেন, তাহলে এই কঠিন সময়ে আপনার জন্য সমবেদনা।’ তো বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্বেই যা হলো, তাতে টুর্নামেন্ট শেষের পর আপনাকে হয়তো হাসপাতালেও যেতে হতে পারে। এমন ঘটন, অঘটন বা প্রপঞ্চময় বিশ্বকাপ কি আগে দেখেছেন কখনো? তার মধ্যেও কিছু থাকে ‘গুড’, কিছু ‘ব্যাড’ আর কিছু ‘আগলি’।
দ্য গুড
‘ফুটবল, ব্লাডি হেল।’ স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসনের সেই অমৃতবচনটা এবার স্মরণ করতে হচ্ছে প্রতি ম্যাচের আগেই। ‘ফার্গি টাইমের’ গোলের দিক দিয়ে এবারের বিশ্বকাপ ছাড়িয়ে গেছে আগের সব আসরকে। প্রতি ম্যাচে ৮০ মিনিটের মধ্যে কিছু হোক আর না হোক, শেষ সময়ে গিয়ে কিছু না কিছু হবেই। শেষ সময়ের গোলে কপাল যেমন খুলেছে জার্মানির, আবার কপালও পুড়েছে তাদের। ব্রাজিল-আর্জেন্টিনারও লিখতে হয়েছে এবার শেষের কবিতা, আবার তীরে এসে একটুর জন্য তরী ডোবেনি পর্তুগালের।
রাখুন, রাখুন। এটাই শেষ নয়। এবারের বিশ্বকাপের সবচেয়ে বড় সৌন্দর্য, হারার আগে কেউ হারেনি। বিশেষ করে এশিয়ার দলগুলো যেভাবে লড়েছে, তাতে মাথা উঁচু করে ফিরতে পারে তারা। ইরান স্পেন-পর্তুগালের মতো দলের সঙ্গে দাঁত কামড়ে লড়েছে, ছেড়ে কথা বলেনি। দক্ষিণ কোরিয়া চার বারের চ্যাম্পিয়নদের জার্মানিকে ধরিয়ে দিয়েছে দেশে ফেরার টিকেট। আফ্রিকার একটি দেশও উঠতে পারেনি নকআউটে, কিন্তু তারাও বিনা যুদ্ধে দেয়নি সূচাগ্র মেদিনী। মিশর আর তিউনিসিয়া বাদ দিলে নাইজেরিয়া, মরক্কো আর সেনেগাল, তিন দলই খেলেছে গর্ব করার মতো ফুটবল। কিন্তু কখনো ভাগ্য, আর কখনো নিজেদের ব্যর্থতা শেষ পর্যন্ত বলে দিয়েছে, ‘নট দিস টাইম ফর আফ্রিকা’। তাতে অবশ্য আফ্রিকার সম্মান মোটেই খাটো হয়নি।
এবারের বিশ্বকাপ মনে রাখতে হবে আরও অনেক কারণেই। কাউকেই তো খালি হাতে ফেরায়নি এই বিশ্বকাপ। ৩২টি দলের প্রতিটিই অন্তত দুইটি করে গোল করেছে, বিশ্বকাপ ইতিহাসে প্রথমবারের মতো। গোলের খেলা ফুটবলে গোলের জন্য মাথা কুঁটে মরতে হয়নি, ফ্রান্স-ডেনমার্ক ম্যাচ বাদ দিলে বাকি সব ম্যাচেই হয়েছে অন্তত একটা গোল। হাতেগোণা কয়েকটি বাদ দিলে সব ম্যাচই তো ছিল টানটান উত্তেজনার।
এবং অতি অবশ্যই ‘ভিএআর’। বিশ্বকাপের আগে ভিডিও সহকারী রেফারি নিয়ে যে শঙ্কা ডালপালা মেলছিল, তার অনেকটুকুই কেটে গেছে এখন। ভিএআরের তৃতীয় নয়ন দেখছে সবকিছু, রেফারিদের মানবীয় ভুলগুলো শুধরে যাচ্ছে প্রযুক্তির উপদেশে। খুব বেশি সময়ও নষ্ট হচ্ছে না, কিন্তু মাঠের খেলাটা অনেক বেশি কলুষমুক্ত থাকছে। এর মধ্যেও কিছু সিদ্ধান্ত হয়েছে বিতর্কিত, তবে তাতে যতটা না প্রযুক্তির দায়, অনেক বেশি মানুষের বা রেফারির।
গুডবুকে আরও থাকবে সেনেগালের কোচ আলিউ সিসে, জাপানের কোচ আকিরো নিশিনোরা। প্রায় শূন্য অভিজ্ঞতা নিয়ে বিশ্বকাপ খেলতে এসে দুজনের দল চমকে দিয়েছে সবাইকে। বলতে হবে ইরানের গোলরক্ষক বেহেরভান্ডের কথা, যাযাবর হওয়া ছিল একসময় যার নিয়তি।ফুটবল যে জীবনের চেয়েও বড়, তার প্রমাণ বেহেরভান্ডের গল্প। এবং সেইসব সেনেগাল ও জাপান সমর্থকদের, খেলা শেষে গ্যালারি পরিষ্কার করে বিশ্বকাপের ভাবমূর্তিটা নিয়ে গেছেন উঁচুতে। ফুটবল যে বিশ্বের সবচেয়ে বৈশ্বিক ভাষা, তার সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপন তো এই বিশ্বকাপই।
দ্য ব্যাড
এমন একটা বিশ্বকাপে ‘খারাপ’ খুঁজতে যাওয়াও আসলে খড়ের গাদায় সূচ খোঁজার মতো। বলতে হবে জার্মানির কথা, চ্যাম্পিয়নের অভিশাপ নিয়ে যারা বিদায় নিয়েছে প্রথম পর্ব থেকে। টনি ক্রুসের ওই গোল ছাড়া জার্মানিকে চিনতে হয়েছে জার্সি দেখে। গ্রুপ পর্বে যারা কখনো বাদ পড়েনি, তারাই এখন বিশ্বকাপ দেখবে টিভিতে। এত বড় বিপর্যয় আসছে, জার্মানি বোধ হয় তা স্বপ্নেও কল্পনা করেনি।
ব্যাডের ছোট্ট তালিকায় থাকবে গোলরক্ষকদের কথাও। সেই অর্থে এবারের বিশ্বকাপের কোনো ম্যাচে অতিমানবীয় কিপিং দেখা যায়নি। ডি গিয়ার মতো বিশ্বসেরা গোলরক্ষক করেছেন হাস্যকর ভুল, উইলি কাবায়েরো করেছেন স্কুলবালকের মতো গোলকিপিং। ম্যানুয়েল নয়্যার যে ভুল করেছেন, ছাড়িয়ে গেছে সবকিছুকেই। পেনাল্টি মিসটা ঠিক ব্যাড বলা উচিত না, তবে মেসি-রোনালদোর মিসের মাশুল আরেকটু হলেই দিতে হচ্ছিল দুই দলকে। ভাগ্য ভালো, সেটা আর হয়নি।
খুব বেশি বাজে রেফারিং হয়নি, তবে বলতে হবে সৌদি আরব-মিশর ম্যাচে কলম্বিয়ান রেফারি উইলমার রোলডানের কথা। স্রেফ নিজের ইগোর জন্য দুইবার বিতর্কিত সিদ্ধান্ত ভিডিও দেখেও বদলাননি। ম্যাচটা গুরুত্বহীন ছিল বলে অল্পতেই হয়তো পার পেয়ে গেছেন রোলডান।
এবং দ্য আগলি
না, জোয়াকিম লোয়ের কথা এখানে থাকবে, ভাবলে ভুল করবেন। এখন পর্যন্ত গ্রুপ পর্বের শেষ দিনটাই যা একটু বিতর্কের জন্ম দিচ্ছে। পোল্যান্ডের সঙ্গে যেমন, হারছে দেখেও শুধু অন্য ম্যাচের দল জেনে শেষ দিকে খেলার কোনো চেষ্টাই করেনি জাপান। ইংল্যান্ড-বেলজিয়াম ম্যাচে সহজ প্রতিপক্ষ পাওয়ার জন্য জিততে চায়নি কোনো দল, শেষ পর্যন্ত তাও মান রক্ষা করেছে বেলজিয়াম। কিন্তু ইংল্যান্ড সমালোচনা থেকে নিজেদের আড়াল করবে কীভাবে?
এবং প্রথম ম্যাচের জন্য ‘অনারেবল মেনশন’ পেতে পারেন নেইমার। যেভাবে প্রতিটা স্পর্শের সাথে সাথে পড়ে গেছেন, সেটা মাঝেমধ্যেই মনে হয়েছে অতি নাটুকে। পরের দুই ম্যাচে অবশ্য নেইমার অনেকটাই শুধরে নিয়েছেন, খেলায়ও উন্নতির ছাপ ছিল স্পষ্ট। মাঠে বর্ণবাদী আচরনের শিকার হয়েছেন সুইডিশ ডিফেন্ডার, ফুটবল মাঠে এখনো এসব কদর্যের চর্চা হয়, সেটাই তো লজ্জার।