আর্জেন্টিনাকে বিদায় করে কোয়ার্টার ফাইনালে ফ্রান্স
ডিফেন্স ম্যাচ জেতায়- পুরনো সত্যটাই প্রমাণ হলো আরেকবার। নড়বড়ে ডিফেন্স নিয়ে ফ্রান্সকে আটকানো হলো না আর্জেন্টিনার। ক্ষণে ক্ষণে রঙ বদলের খেলায় শেষ পর্যন্ত আর্জেন্টিনাকে ৪-৩ গোলে হারিয়ে বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে উঠে গেল লা ব্লুজরা।
দ্বিতীয় রাউন্ডের প্রথম ম্যাচ, ৭ গোলের থ্রিলার থেকে অবশ্য চোখ ফেরানোর উপায় ছিল না শেষ পর্যন্তও। ৯২ মিনিটে সার্জিও আগুয়েরোর গোলে ব্যবধান দুই থেকে একে নামিয়ে এনেছিল আর্জেন্টিনা। কিন্তু রূপকথা লেখা হয়নি শেষ পর্যন্ত। সেটাও অবশ্য হয়ে যেত, শেষদিকে মেজার ক্রসটা যদি ঠিকমতো পায়ে লাগাতে পারতেন ডি মারিয়া। পারেননি, তাই আর্জেন্টিনা আর বিশ্বকাপ স্বপ্নের মধ্যকার দূরত্বটাই বড়েছে কেবল। ব্যবধানটা হয়ে থেকে ওই মুহুর্তটাই।
কাজানে ৭ মিনিটের এক ঝড়ে আসলে উড়ে গেছে আর্জেন্টিনা। তার আগ পর্যন্ত শুরুতে পিছিয়ে পড়েও লড়াকু এক ফিরে আসায় কোয়ার্টার ফাইনালের স্বপ্ন দেখছিল আর্জেন্টিনা। সেই স্বপ্নে আঘাত হেনেছিল বেঞ্জামিন পাভার্দের অসাধারণ এক গোল। এরপর কিলিয়ান এমবাপ্পে ৪ মিনিটের ব্যবধানে জোড়া গোল করে স্বপ্ন ভেঙে দিয়েছেন আর্জেন্টাইনদের।
৭ গোলের ম্যাচে শুরুটা করেছিলেন আঁতোয়া গ্রিযমান। প্রথম দশ মিনিটেই নাড়িয়ে দিয়েছিলেন আর্জেন্টিনার বারপোস্ট। ফ্রি কিক থেকে অল্পের জন্য গোলটাই পাননি তিনি। এরপর যদিও গোলের অপেক্ষাটা খুব বেশি দীর্ঘ হয়নি তার। আর্জেন্টিনাকে বল পজেশন দিয়ে নিজেদের অর্ধে থেকে প্রতি-আক্রমণেই স্বস্তিতে ছিল ফ্রান্স। দিদিয়ের দেশমের কৌশলটা মাত্র ১৩ মিনিটেই সফল প্রমাণিত, গোলের দিকে এগুতে থাকা এমবাপ্পেকে আটকাতে পারেননি মার্কোস রোহো। রেফারিরও পেনাল্টির সিদ্ধান্ত দিতে দুইবার ভাবতে হয়নি। গ্রিযমানই পেনাল্টি থেকে এগিয়ে দেন লা ব্লুজদের।
এরপরও ম্যাচের গল্পটা ছিল একইরকম। ফ্রান্স বেশ কয়েকটি সুযোগও নষ্ট করেছে প্রথমার্ধে, অলিভিয়ের জিরু ডিবক্সের ভেতর পাওয়া বলটা কাজে লাগাতে পারলে দুই গোলের লিডটা তখনই পায় ফ্রান্স। প্রায় দুই তৃতীয়াংশ বল পজেশনে রেখেও অন্যপ্রান্তে ফ্রান্সের জমাট বাধা রক্ষণ গলে বের হতে পারছিলেন না মেসি, পাভনরা। বিরতিতে যাওয়ার ৪ মিনিট আগে অ্যানহেল ডি মারিয়াই দায়িত্বটা কাঁধে তুলে নিলেন। প্রায় ৩০ গজ দূর থেকে বল পেয়েছিলেন। সেখান থেকেই মারলেন সোজা গোলে, হুগো লরিস ফুল স্ট্রেচডেও ঠেকাতে পারেননি। ডি মারিয়ার গোলে সমতায় আর্জেন্টিনা, স্বপ্ন দেখার শুরুও সেখান থেকে। ৪৮ মিনিটে মেসির নেওয়া শটে পা লাগাতে গিয়েও সরিয়ে ফেলেছিলেন গ্যাব্রিয়েল মের্কাদো। কিন্তু পারলেন না, পায়েই লাগল তার। তারপর সেটাই পরিণত হলো গোলে। ভাগ্যটাও আর্জেন্টাইনদের পক্ষেই ছিল তখনও।
বিরতির সময় রোহোকে বসিয়ে ফ্রেডেরিকো ফাজিওকে নামিয়েছিলেন আর্জেন্টিনা কোচ হোর্হে সাম্পাওলি। তাকে নামিয়েও রক্ষণের তেমন উন্নতি হলো না। বরং ফাজিওকেই তটস্থ রাখলো ফ্রেঞ্চ আক্রমণ। ৫৭ মিনিটে পাভার্দের হাফ ভলিতে করা গোলে অবশ্য করার ছিল না তেমন কিছুই। ডি মারিয়ার গোলকেও ছাড়িয়ে গেল সেটা। পাভার্দের চোখ ধাঁধানো স্ট্রাইকে ফ্রান্সও ফিরল সমতায়। ফ্রান্সের জার্সিতে ক্যারিয়ারের প্রথম গোলটা তাই পাভার্দের হলো মনের রাখার মতোই।
এরপরই তাসের মতো ভেঙে পড়ল আর্জেন্টিনার রক্ষণ। ৬৪ মিনিটে এমবাপ্পের গোল আর্জেন্টাইনদের হৃদয়ে বিঁধল শেল হয়ে। আর মিনিট চারেক পর এমবাপ্পে শেষ পেরেকটা ঠুকলেন আর্জেন্টিনার কফিনে। অলিভিয়ের জিরুর পাস খুঁজে পেয়েছিল ফাঁকায় দৌড়াতে থাকা এমবাপ্পেকে। সেখান থেকেই নিখুঁত ফিনিশে ফ্রান্স পেল চতুর্থ গোল। তখনই প্রায় নিশ্চিত হয়ে গেল ফ্রান্সের জয়।
অবশ্য আর্জেন্টাইন লড়াই চলেছে শেষ পর্যন্তই। হয়ত একটু দেরি করেই শুরু হয়েছিল সেটা। লিওনেল মেসি দুইজন ফ্রেঞ্চ ডিফেন্ডারকে কাটিয়ে ঢুকেও গিয়েছিলেন ভেতরে। শুট করতে হত ডান পায়ে, দুর্বল পায়ে আজ আর জাদুকরী কিছু করা হয়নি তার। দুর্বল শট লরিসের হাতেই গেছে সরাসরি। ৯২ মিনিটে অবশ্য বদলি সার্জিও আগুয়েরোকে করা ক্রসটা ছিল নিখুঁত, তাতে হেড করে আগুয়েরোও গোল করেছিলেন। কিন্তু সময় ফুরিয়ে গেছে ততোক্ষণে। আর একটা সুযোগ পেয়েছিল আর্জেন্টিনা, সেটাও আক্ষেপই হয়ে থেকেছে শেষ পর্যন্ত।
সম্ভবত বিশ্বকাপে লিওনেল মেসির শেষটা হলো সবচেয়ে খারাপভাবেই। এর আগের তিন বিশ্বকাপে অন্তত কোয়ার্টার ফাইনালে উঠেছিল তার দল। মেসির আর ডিয়েগো ম্যারাডোনা হওয়া হলো না। এই ম্যাচেও যদিও দুই অ্যাসিস্ট করে ম্যারাডোনার একটা রেকর্ড ছুঁয়েছেন। কিন্তু আর্জেন্টাইনদের প্রবল আকাঙ্ক্ষার বিশ্বকাপ স্বপ্নটা মেটানো হলো না। এবার নতুন এক তারকার কাছেই হার মানলেন তিনি- এমবাপ্পে। আর ফ্রেঞ্চ স্ট্রাইকার ঢুকে গেলেন রেকর্ডবুকে। পেলের পর দ্বিতীয় টিনএজার হয়ে বিশ্বকাপের এক ম্যাচে করলেন জোড়া গোল।
আর্জেন্টিনা একাদশ
আর্মানি, মের্কাদো, অটামেন্ডি, রোহো, টালিয়াফিকো, মাসচেরানো, বানেগা, পেরেজ, পাভন, মেসি, ডি মারিয়া
ফ্রান্স একাদশ
লরিস, পাভার্দ, ভারান, উমতিতি, হার্নান্দেজ, কান্তে, পগবা, গ্রিযমান, এমবাপ্পে, মাতুইদি, জিরু