• রাশিয়া বিশ্বকাপ ২০১৮
  • " />

     

    মেসি-রোনালদো যখন এক বিন্দুতে

    মেসি-রোনালদো যখন এক বিন্দুতে    

    ব্রনিৎসি থেকে ক্রাতোভো। মস্কোর উপকন্ঠে দূরত্বটা খুব বেশি নয়। মেসিরা যখন ব্রনিৎসি থেকে বাক্সপ্যাটরা গুছিয়ে বিমানবন্দরের পথ ধরেছেন, কে ভেবেছিল কয়েক ঘণ্টা পর রোনালদোরাও হবেন সেই একই পথের যাত্রী। কে জানত, বিশ্বকাপ থেকে দুইটি তারা খসে পড়বে একই দিনে, তাও আবার এমন অদ্ভুত সমাপতনে!

    লিওনেল মেসি ও ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর মধ্যে অমিল নেহাত কম নয়। সেটা খেলার ধরনে হোক বা অন্যকিছুতে। ক্যারিয়ারে দুজনের পথ চলেছে সমান্তরালে, মেসি একটা সময় অনেকটা এগিয়ে গেলেও রোনালদো তাঁকে ধরে ফেলেছেন দুর্দান্ত ধারাবাহিকতায়। কিন্তু ফুটবলীয় দক্ষতা ছাপিয়ে মেসির নেতৃত্বগুণ যখন বার বার প্রশ্নবিদ্ধ, রোনালদো সেই সামনে থেকে পথ দেখানোর ক্ষমতা দিয়েই তাঁর মানচিত্রে যোগ করেছেন নতুন সাম্রাজ্য। মেসির জন্মগত প্রতিভা যখন বার বার অতিমানবীয় কিছু মনে করিয়ে দেয়, তখন মানবীয় রোনালদোও মনে করিয়ে দেন, অমর্ত্যকে ছোঁয়াও রক্তমাংসের মানুষের পক্ষে খুব সম্ভব।

    কিন্তু বিশ্বকাপে দুজনের শেষটা এমনভাবে মিলে যাবে, সেই চিত্রনাট্য বোধ হয় ক্রিস্টোফার নোলানের জন্যও লেখা কঠিন ছিল। এমন নয়, দুজন পথ হারিয়েছেন শুরু থেকেই। রোনালদো প্রথম ম্যাচেই হ্যাটট্রিক করে যখন মঞ্চটা নিজের করে নিচ্ছেন, আইসল্যান্ডের সঙ্গে পেনাল্টি ব্যর্থতায় মেসি তখন ক্রুশবিদ্ধ। আবার ইরানের সঙ্গে ও যখন রোনালদোর কাছে পেনাল্টি জটিল একটা ধাঁধাঁ, মেসি তার পরেই নাইজেরিয়ার সঙ্গে নিজের জাদুর টুপি থেকে বের করলেন একটা ম্যাজিক। সবকিছুই দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল, এমন একটা সমীকরণের, যখন দুই দলের দেখা হতে পারত শেষ আটে। না চাইলেও যখন দুজনের তুলনাটা চলে আসে, সেটার জন্য ভালো মানদণ্ড আর হতে পারত না কিছুই।

    তবে অলক্ষ্যে থেকে একজন হয়তো হাসছিলেন মুচকি। বিশ্বকাপের নকআউটে দুজন এর আগে কখনোই গোল পাননি। মেসি দলকে বিশ্বকাপের ফাইনালে নিয়ে গেছেন, রোনালদোও খেলেছেন সেমিফাইনালে, কিন্তু দুজনের সব গোল গ্রুপ পর্বেই। নকআউটের চাপের সামনে দুজনের কাছ থেকে যখন প্রত্যাশা অভাবনীয় কিছুর, সেটা পূরণ হলো না আরও একবার।

    সেই সুযোগও যে সেভাবে পাননি, সেটার জন্য অবশ্য ফ্রান্স-উরুগুয়েকে কৃতিত্ব দিতেই হবে। মেসির পাশে যেমন ছায়া হয়ে ছিলেন কান্তে-ভারানরা, রোনালদোকে তেমনি প্রায় বোতলের মধ্যে ভরে রেখেছিলেন গডিন-জিমেনেজরা। মেসি অবশ্য তাও দুইবার গোলের উৎসে ছিলেন। শেষ দিকে তাঁর সেই স্তব্ধ করা মুভে ঢুকে পড়েছিলেন ভেতরে, অন্য কোনো দিনে ডান পায়ের শটটা হয়তো গোল হয়েই যেত। কিন্তু যেদিন নিয়তি লিখে রেখেছে বিদায়, সেদিন আসলে হওয়ার নয় কিছুই। দুই ঘণ্টা পর রোনালদোর জন্যও অপেক্ষা করছিল একই নিয়তি।

    প্রশ্ন উঠতেই পারে, বিশ্বকাপের অপূর্ণতা কি তাদের অমরত্বের পথে কাঁটা হয়ে দাঁড়াল? আজ থেকে আরও ২০ বছর পর মেসি-রোনালদো কোন উচ্চতায় থাকবেন? পুসকাস, ক্রুইফ, ডি স্টেফানোরাও কখনো বিশ্বকাপ জেতেননি, আপনি হয়তো সেটা মনে করিয়ে দেবেন। তবে সবকিছুর ওপরে ফুটবল একজনের নয়, ১১ জনের খেলা, দিন শেষে এটাই ধ্রুব সত্য। মেসি ছাড়া এই আর্জেন্টিনার আর কেউ কি ফ্রান্সে সুযোগ পেতেন? বা রোনালদো ছাড়া পর্তুগালের কজন গোছানো, সুসংবদ্ধ উরুগুয়ের প্রথম একাদশে থাকতেন? পুসকাসের সঙ্গে ককসিস, হিদেকুটিরা ছিলেন, ক্রুইফের সঙ্গে ছিলেন নেসকিন্সরা, মেসি-রোনালদোর সঙ্গে এই দলে কারা ছিলেন? বিশ্বকাপের অপূর্ণতার দায় একা কেন এই দুজনকেই নিতে হবে?

    সেই অপূর্ণতা ঘোঁচানোর শেষ সুযোগ এবারই কি না, সেটা নিয়ে আপনি প্রশ্ন তুলতে পারেন। চার বছর পর মেসির বয়স হবে ৩৪, রোনালদোর ৩৭। পেলে নিজের শেষ বিশ্বকাপ খেলেছেন ৩৩ বছর বয়সে, ম্যারাডোনা আর জিদান ৩৪। তবে মেসি-রোনালদো দুজনেই আভাস দিয়েছেন, শিগগির জাতীয় দলের জার্সি তুলে রাখার কোনো পরিকল্পনা নেই তাঁদের। মেসি বলেছেন, আকাশী নীলের জার্সি তুলে রাখার আগে কিছু একটা জেতার চেষ্টা করবেন। আর রোনালদোর মতো জাত লড়িয়ে প্রতিনিয়ত জানান দিচ্ছেন, বয়স শুধুই একটা সংখ্যা। কে জানে, চার বছর পর কাতারে হয়তো দেখা হয়ে যেতেই পারে। এবার হয়তো আর বিমানবন্দরে নয়, মাঠেই।