• অ্যাশেজ
  • " />

     

    ‘বডিলাইন’ অথবা ‘ফার্স্ট লেগ থিওরি’ র গল্প- শেষ পর্ব

    ‘বডিলাইন’ অথবা ‘ফার্স্ট লেগ থিওরি’ র গল্প- শেষ পর্ব    

    অ্যাশেজ! ক্রিকেটের সবচাইতে পুরানো দ্বৈরথ। এর রন্ধ্রে রন্ধ্রে ইতিহাস, পরতে পরতে আভিজাত্য। ক্রিকেট এখানে শুধুই খেলা নয়, ক্রিকেট এখানে জাতিগত বৈরিতার প্রতীক। শত বছরের পুরানো এই সিরিজে কারো স্বপ্ন ভেঙ্গেছে, নতুন তারকার জন্ম হয়েছে, কেউবা আবার সবুজ মাঠের আশ্রয় ছেড়ে জায়গা পেয়েছেন অমর রূপকথার কাব্যে।

     

    অ্যাশেজে ক্রিকেট জীবনের অংশ নয়, বরং জীবনই এখানে হয়ে যায় ক্রিকেট। ছোট্ট এই ভস্মাধারের প্রতি আবেগ যে কত তীব্র তা প্রথম অনুভূত হয় ১৯২৮-২৯ এ, ইংল্যান্ডের অস্ট্রেলিয়া সফরে। জন্ম হয় ক্রিকেটের অলটাইম কিছু গ্রেটদের। এর ফলশ্রুতিতে আসে কুখ্যাত বডিলাইন সিরিজ। এই ধারাবাহিকটি বডিলাইন অ্যাশেজেরই পূর্বাপর আর খুঁটিনাটির উপর আলোকপাত করার একটা প্রয়াস। 

     

     


     

    প্রথম পর্বঃ 'বডিলাইন’ অথবা ‘ফাস্ট লেগ থিওরি’ র গল্প -১

    দ্বিতীয় পর্বঃ'বডিলাইন’ অথবা ‘ফাস্ট লেগ থিওরি’ র গল্প -২

    তৃতীয় পর্বঃ বডিলাইন অথবা ফাস্ট লেগ থিওরি' র গল্প -৩

    চতুর্থ পর্বঃ বডিলাইন অথবা ফাস্ট লেগ থিওরি' র গল্প-৪

     


     

     

     

    ১৬. অতঃপর এমসিসি...

     

     

    মানুষ মাত্রই স্বার্থান্বেষী। দুনিয়াতে খুব কম মানুষই নিজের লাভের দিকটা অগ্রাহ্য করে অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে পারে। স্বার্থের টান অন্যায়ের প্রতি মানুষের চোখ কান বন্ধ করে দেয়।

     

    অ্যাশেজ ফিরিয়ে এনে ইংল্যান্ড ক্রিকেট দল তখন আকাশে উড়ছে। জার্ডিনের বিচক্ষণতা নিয়ে পত্রিকার পাতায় লেখা হচ্ছে পাতার পর পাতা। লারউড তখন জাতীয় বীর। এমন সময়ই ওয়েস্ট ইন্ডিজ দল ইংল্যান্ড সফর করল। প্রথম টেস্টে ইনিংস ব্যবধানে হারার পর অধিনায়ক জ্যাকি গ্রান্ট সিদ্ধান্ত নিলেন ‘কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার’।

     

    মার্টিনড্যাল আর কন্সট্যান্টিন ইংল্যান্ডের মাটিতে সর্বপ্রথম বডিলাইন কৌশলে বোলিং করে দেখালেন। চিবুকে প্রবল চোট পেয়ে হ্যামন্ড সাজঘরে ফিরলেন, প্রথম ইনিংসে ৩৭৫ রানে এগিয়ে থাকা ওয়েস্ট ইন্ডিজ মাত্র ১৩৪ রানেই ইংল্যান্ড এর চার উইকেট ফেলে দিল। জার্ডিন অবশ্য বডিলাইনের জবাব বেশ ভালই দিয়েছিলেন। তাঁর ক্যারিয়ারের একমাত্র টেস্ট শতক এই ইনিংসেই পাওয়া। বাউন্সারগুলোর জবাব কখনো একহাতে পুল করে, আবার কখনো আপার কাট করে দিচ্ছিলেন। তাঁর ব্যাটিং নৈপুণ্যেই ইংল্যান্ড ম্যাচ বাঁচায়।কিন্তু ম্যাচ শেষ হলেও এর চিহ্ন থেকে যায় ইংলিশদের শরীরের অসংখ্য কালশিটে দাগে।

     

    এই টেস্ট শেষেই দ্য টাইমস  ‘ফাস্ট লেগ থিওরি’র বদলে সর্বপ্রথম ‘বডিলাইন’ ব্যবহার করে খবর ছাপল। যে তত্ত্বের জন্যে এতকাল অস্ট্রেলীয়দের তারা উপহাস করে এসেছে, নিজেরাই এর শিকার হওয়ার পর অবশেষে এমসিসির ও টনক নড়ল! স্বার্থের টান আসলেই প্রবল!

     

     

    ১৭. ‘বলির পাঁঠা’

     

     

    ক্রিকেটের বাইরেও ‘বডিলাইন’ এর যে ব্যাপক ভূমিকা ছিল তা ইতোমধ্যেই আপনাদের বলেছি। দুই দেশের মধ্যে ঘৃণার তীব্রতা এতটাই চরম আকার ধারণ করেছিল যে, এক পর্যায়ে পণ্য বর্জনের মতো ঘটনাও শুরু হয়ে যায়। এশীয় ব্রিটিশ-কলোনিগুলো ছিল অস্ট্রেলীয় পণ্যের বৃহৎ বাজার। সিরিজ শেষ হবার পর থেকেই সেই বাজারে ব্যাপক ধ্বস নামে। ফলশ্রুতিতে অস্ট্রেলীয় অর্থনীতি সাংঘাতিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

     

    ইংল্যান্ডের অবস্থাও অতটা সুবিধার ছিলনা। আধুনিক অস্ট্রেলিয়ার বিকাশ অনেকটাই ইংলিশদের হাত ধরে বলে অনেক ইংলিশেরই দ্বিতীয় বাড়ি ছিল অস্ট্রেলিয়া। বডিলাইন সিরিজের পর ইংলিশ ব্যবসায়ীরা অস্ট্রেলিয়াতে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে শুরু করেন। বেশ কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাও ঘটে যায়। ব্যাপার যে শুধুই আর ক্রিকেটের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই দুই দেশের সরকারও সেটা বুঝতে পারে। চাপ এসে পড়ে এমসিসির উপর।

     

    অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি হোক আর ওয়েস্ট ইন্ডিয়ানদের বোলিং তোপের মুখে পড়েই হোক, এমসিসি শেষ পর্যন্ত বিবৃতি দেয় বডিলাইন কৌশল ক্রিকেটীয় চেতনা বিরোধী! যেই জার্ডিন এবং লারউড কিছুকাল আগেও ছিলেন ‘নয়নের মণি’, তারাই তখন হয়ে গেলেন খল নায়ক। বোর্ডের এই দ্বিমুখিতায় ক্ষুব্ধ জার্ডিন ক্রিকেটই ছেড়ে দেন। লারউডকে বলা হয় লিখিতভাবে অস্ট্রেলীয় জনগণের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতে! এতে রাজি না হওয়ায় সেই ইংলিশ গণমাধ্যমই তাঁকে ভয়াবহ অপমান করে। ব্যথিত লারউড ক্রিকেট ছেড়ে দিয়ে লোকচক্ষুর আড়ালে চলে যান।

     

    পরিবর্তন আসে ক্রিকেটের নিয়মকানুনেও। ওভারে বাউন্সার কোটা সীমিত করে দেয়া হয়। লেগ শর্টে দুইজনের বেশি ফিল্ডার দাঁড়ালে নো বল ডাকার বিধান রাখা হয়। উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে শরীর লক্ষ্য করে বোলিং করা হচ্ছে এমন বুঝতে পারলে আম্পায়াররা খেলা বন্ধ করতে পারবেন- এমন ক্ষমতাও তাঁদের দেয়া হয়।

     

    জার্ডিনের অবসর, এমসিসির বিবৃতি আর লারউডের জাতীয় দল থেকে নির্বাসন- সবকিছু মিলিয়েই দুই দেশের ক্রিকেট সম্পর্ক আবার উষ্ণ হয়। বিল উডফুলের নেতৃত্বেই আবার অস্ট্রেলিয়া ১৯৩৪ সালে ইংল্যান্ড সফর করে।

     

     

    ১৮. নায়ক নাকি খলনায়ক?

     

     

    আচ্ছা জার্ডিনের জায়গায় আপনি যদি থাকতেন তাহলে কি করতেন? আপনার কাঁধে নিজেকে প্রমাণ করার চাপ, গোটা জাতির প্রত্যাশার চাপ, অনভিজ্ঞ এক দল পরিচালনার চাপ- সবকিছু ছাপিয়ে ভিনদেশে, অচেনা কন্ডিশনে খেলে আপনাকে অ্যাশেজ ঘরে ফিরিয়ে আনতে হবে। এর উপর প্রতিপক্ষ দলে আছেন একজন ব্র্যাডম্যান, যিনি ভুল করে একবার-দুবার আউট হন, যার ব্যাট টেস্টের এক ইনিংসে হেসেই ম্যাচ নিজ দলের দিকে টেনে নিয়ে যেতে পারে! জার্ডিন একটা দুর্বলতা পেয়ে সেটাকে কাজে লাগিয়েছিলেন মাত্র। ক্রিকেটীয় ব্যাকরণের বাইরে এক পা’ও তিনি যাননি। যা করেছিলেন সব নিয়ম মেনে, তাই নিজের সিদ্ধান্তে অটল না থাকার কোন কারণ তাঁর ছিলনা।

     

                  ডগলাস জার্ডিন

     

    জার্ডিন সেই গুটিকয়েক ইংলিশ অধিনায়কদের একজন যারা দোর্দন্ড প্রতাপে অস্ট্রেলিয়া থেকে অ্যাশেজ জিতে ফিরেছেন। ব্যাট হাতে তাঁর সাফল্যও কম নয়। একগুঁয়েমির জন্যে তাঁকে যে দোষ দিচ্ছেন, তো একগুঁয়ে না কে? এই যুগেও কি এমন খেলোয়াড় নেই?

     

    অস্ট্রেলীয় দর্শকরা তাঁকে ম্যাচের পর ম্যাচ টিটকারি দিয়ে গেছে, তিনি কিন্তু জনসম্মুখে কখনোই এর জবাব দেননি। কোন অস্ট্রেলীয় খেলোয়াড়ের সাথে বাজে ব্যবহার করেছেন এমনটাও কেউ বলতে পারবে না। নিজ দলের খেলোয়াড়দের সাথে বাজে ব্যবহার করতেন সত্যি, কিন্তু আগলেও তো রাখতেন! স্বেচ্ছা-নির্বাসনে যাওয়া লারউডকে অকৃতজ্ঞ জনতা ভুলে গেলেও জার্ডিন ভুলেননি। তাঁকে ডাকযোগে পাঠিয়েছিলেন একটি ছাইদানি- অস্ট্রেলীয়দের ভস্মীভূত করার স্মারক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর লারউড পাড়ি জমান অস্ট্রেলিয়ায়। মানুষের মনে তখন যুদ্ধের ক্ষত; ক্রিকেটীয় ঘৃণা ভুলে তাই অস্ট্রেলিয়াতে তিনি বেশ স্বাচ্ছন্দ্যেই থিতু হয়ে যান। ইংল্যান্ড ছাড়ার আগে লারউডের সম্মানে জার্ডিন নৈশভোজের আয়োজন করেছিলেন, পরে অস্ট্রেলিয়াতে গিয়েও লারউডের সাথে দেখা করেছিলেন।

     

    জার্ডিন চুপচাপ থাকতেন, কিন্তু নীরবতাই ছিল তাঁর একাগ্রতার প্রতীক। ছিলেন অকুতোভয়, সাহসী; এক সত্যিকারের নেতা। আর লারউডের বাউন্সার দেয়াটাই আপনি দেখছেন, একটানা এক লাইন-লেংথে বল করে যাওয়ার প্রতিভাটা দেখছেন না? তিনি কৌশল বাস্তবায়ন করছিলেন মাত্র, আঘাত করার কোন উদ্দেশ্য তাঁর ছিলনা একথা তিনি সহস্রবার বলেছেন। এটা যে নিজেকে বাঁচানোর জন্যে তিনি বলেননি, তার প্রমাণ ওল্ডফিল্ডের মাথার চোটের পর তাঁর মেয়ের কাছে লারউডের পাঠানো উপহার, সাথে বাবাকে ‘অসুস্থ’ করে দেয়ার জন্যে ক্ষমা চেয়ে ছোট্ট চিরকুট!

     

    ক্ষমা যেখানে প্রার্থনা করার দরকার ছিল তিনি করেছেন, এমসিসির কথায় আবার কেন তিনি লিখিত ক্ষমা চাইবেন? সেই অস্ট্রেলিয়াতেই তো পরে তিনি জীবনের অর্ধেক সময় কাটিয়েছেন, মিশেছেন সেখানকার মানুষের সঙ্গে। বন্ধুত্ব করেছেন সেইসব ব্যাটসম্যানদের সাথেই- বডিলাইন সিরিজে যাঁরা তাঁর বদৌলতে পেয়েছিলেন অসংখ্য আঘাতের চিহ্ন। শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন সেই অস্ট্রেলিয়ার মাটিতেই।

     

    বডিলাইন কৌশল নিয়মের বাইরে কিছু না হবার পরও এটা নিয়ে তখনকার দুনিয়ায় যে এত কিছু ঘটে গেল তাঁর দায় যদি কিছু থাকে, তবে সেটা ইংলিশ গণমাধ্যম আর এমসিসির। দ্বিমুখিতা, মূর্খতা আর প্রতিপক্ষকে ছোট করে দেখার স্বার্থপর মানসিকতাসম্পন্ন প্রতিবেদনগুলোই বডিলাইন সিরিজকে কেন্দ্র করে এমন উত্তেজনার পারদ চড়িয়েছিল। কপটচারী যে ইংলিশরা জার্ডিন আর লারউডকে মাথায় করে নাচছিল অ্যাশেজ ফিরিয়ে আনার জন্যে, তারাই আবার কয়েকদিন যেতে না যেতেই এঁদের আস্তাকুড়ে ছুঁড়েছিল।

     

    সেই ঘটনার পর টেমস আর ইয়ারা নদী দিয়ে মিলিয়ন-বিলিয়ন কিউসেক পানি গড়িয়ে গেল। মানুষ অবলোকন করল বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা, ব্রিটিশ কলোনীগুলো পেল স্বাধীনতা। আরো কত দেশ ক্রিকেটে আসলো, জয়মাল্য উঠলো আরো কত মহানায়কদের গলায়! টাইমলেস টেস্টের যুগ শেষ হল, খেলাকে জনপ্রিয় করতে আসল ওয়ানডে ক্রিকেট। শুরু হল বিশ্বকাপ। কেরি প্যাকারের হাত ধরে ক্রিকেটে লাগলো রঙ্গিন ছোপ,লাল বলের টেস্ট খেলা থেকে ক্রিকেট গড়ালো ফ্লাডলাইটের আলোয় সাদা বলে। বাণিজ্যলক্ষ্মী হয়ে ক্রিকেট মুনাফালোভীদের পাতে পরল। আসল টি-টোয়েন্টি ধামাকা, আইপিএল, আলোর চোখ ঝলসানো রোশনাই।

     

    কিন্তু একজন ডগলাস জার্ডিন অথবা একজন হ্যারল্ড লারউড তাঁদের প্রাপ্য সম্মান টুকু পেলেন না! আজ, এতকাল পরেও, তাঁদেরকে ঘৃণার সাথে ইংল্যান্ডে দেখা হয়। জয়মাল্য এনে দিয়েও তাই তাঁরা এখনো খলনায়ক, মহানায়কের সম্মান পাবার যোগ্য হয়েও তাঁরা অস্পর্শিত। ইংল্যান্ড যে ক্রিকেটের জনক হয়েও বিশ্বকাপ তো পরের কথা, কোন আইসিসি ট্রফিই জিততে পারে না - এর সাথে এর কোন সংযোগ আছে কিনা কে জানে! যেখানে ‘গুণী’র কদর হয়না সেখানে ‘গুণী’ জন্মাবে না এইতো যুগ যুগান্তরের নিয়ম।  

     

    (সমাপ্ত)

     

     


     

    এই ধারাবাহিকটি লিখতে যেসকল সূত্রের সাহায্য নেয়া হয়েছেঃ

     

    ১। ‘80 years ago, Bodyline ended and English Cricket enjoyed a triumph’ by Alex Massie

     

    ২। ‘Douglas Jardine: The Villain who should have been Hero’ by KrishSripada

     

    ৩। Wisden

    1. The Australian Cricket Team in England 1930
    2. The England Cricket Team in Australia 1932-33
    3. The West Indies Cricket Team in England 1933
    4. The Indian Cricket Team in England in 1932

     

    ৪। Wikipedia

    1. Douglas Jardine
    2. Adelaide Leak
    3. Donald Bradman
    4. Bodyline
    5. Walter Hammond
    6. Harold Larwood
    7. Bill Woodfull

     

    ৫। এছাড়াও espncricinfo-র বিভিন্ন নথি, স্কোরকার্ড, ম্যাচ রিপোর্ট এর সাহায্য নেয়া হয়েছে।