ক্রোয়েশিয়ার সোনালী প্রজন্ম: এবার হবে তো?
জুন ২, ২০১৮। গত সপ্তাহেই ক্লাব রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে টানা তিনবার চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতেছেন ক্রোয়েশিয়ার অধিনায়ক লুকা মদ্রিচ। সামনেই বিশ্বকাপ। রাশিয়া যাত্রার আগে পাওয়া খানিক অবসরে নাড়ির টানে ফিরলেন মাতৃভূমিতে। গেলেন জাদারের সেই ছোট্ট পাড়ায়, যেখানে শরণার্থী শিবির থেকে পালিয়ে এসেছিলেন মদ্রিচ এবং তার পরিবার। মাদ্রিদে স্থায়ী হলেও ক্রোয়েশিয়ার এই জায়গাটিকে এখনও ভুলতে পারেননি তিনি। স্মৃতিটা আবছা হলেও জাদারকে বাবার মতই পছন্দ করে ছেলে ইভানো মদ্রিচ। এসেই মেতে উঠল হারানো বন্ধুদের সাথে খেলতে। মদ্রিচও দূর থেকে দেখতে লাগলেন, হয়তো ফিরে গেলেন বন্ধুদের সাথে খালি পায়ে ফুটবল খেলার দিনগুলোতেও। এমন সময় প্রায় ষাটোর্ধ্ব এক বৃদ্ধকে এগিয়ে আসতে দেখলেন ক্রোয়েশিয়ার অধিনায়ক। স্মিত হাসি হেসে মদ্রিচের দিকে তাকালেন তিনি। কিছুক্ষণ খুদে ফুটবলারদের কারিকুরি দেখে যাবার বেলায় মদ্রিচকে অনুরোধ করলেন; আর কিছু না হোক, এই বাচ্চাগুলোর জন্য হলেও যেন বিশ্বকাপে ক্রোয়েশিয়া ভাল কিছু উপহার দেয়।
এক সাক্ষাৎকারে এই ঘটনার কথা বলেছিলেন মদ্রিচ। নব্বইয়ের প্রজন্মের ক্রোয়েশিয়ার কথা শুনলেই চোখের সামনে ভাসে ১৯৯৮ ফ্রান্স বিশ্বকাপ। ফাইনালে রোনালদোদের অশ্রুই মনে পড়ে সবার, তবে আড়ালে থেকে যায় আরও কিছু। ডেভর সুকারের কান্না, জোভোনোমির বোবানের শূন্যদৃষ্টি, রবার্ট প্রোসেনেকি জার্সিতে মুখ লুকানো। ক্রোয়েশিয়ার সোনালী প্রজন্ম। ১৯৯২-এ স্বাধীনতার বছর ছয়েক পর প্রথম বিশ্বকাপেই যারা বাজিমাত করেছিল। কোয়ার্টারে যখন ক্লিন্সম্যানের জার্মানির বিপক্ষে খেলা পড়ল, সেবার তাদের পক্ষে বাজি খুব সম্ভবত ধরেননি তাদের কট্টর সমর্থকেরাও। কিন্তু সেদিন স্তাদ গার্ল্যান্ডে সুকার-বোবানদের গর্জন শুনল পৃথিবী। সেমিতে স্বাগতিক ফ্রান্সের বিপক্ষেও লিড নিয়েছিল তারাই। কিন্তু লিলিয়ান থুরামে হল স্বপ্নভঙ্গ।
এরপরের গল্পটা কেবলই হতাশার। ২০০২ বিশ্বকাপে বিদায় নিতে হল গ্রুপপর্ব থেকেই। পুরো চিত্রনাট্য বানিয়ে শেষে অপ্রত্যাশিত সমাপ্তিকে সিনেমার ভাষায় বলে ‘অ্যান্টি ক্লাইম্যাটিক এন্ডিং।’ ক্রোয়েশিয়ার সোনালী প্রজন্মের বিদায়টা কেমন ছিল, তা বোঝাতে এই তিন শব্দই যেন যথেষ্ট।
সুকারের পর ক্রোয়েশিয়ার ‘দ্বিতীয়’ সোনালী প্রজন্মের অধিনায়ক মদ্রিচ। ২০০২-এর পরের পাঁচ বছর বেশ হতাশায়ই কাটাতে হয়েছে ক্রোয়েশিয়াবাসীকে। দলের খেলায় নেই কোনো প্রাণের সঞ্চার, তারকাদের অভাবটাও বেশ চোখে পড়ার মত। ফলাফল? ২০০৬ বিশ্বকাপে আবারও গ্রুপপর্ব থেকে বিদায়। মদ্রিচ, দারিও স্রনারা ছিলেন ২০০৬তেই, এরপর আসলেন ইভান রাকিটিচ, মারিও মানজুকিচরা। অনূর্ধ্ব-২৩ থেকে আসলেন দেয়ান লভ্রেন, দোমাগজ ভিদা। ক্রোয়েশিয়া পেল সুকারদের ‘ড্রিম টিম’-এর উত্তরসূরি।
শুধু নামে নয়, মাঠের পারফরম্যান্সেও সুকারদের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছিলেন মদ্রিচরা। ইউরো ২০০৮-এর মাসখানেক আগে প্রীতি ম্যাচে দেল পিয়েরো, লুকা টনির ইতালিকে ২-০ গোলে হারাল তারা। জার্মানির সাথে একই গ্রুপে পড়লেও তাদের হারিয়েই গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে শেষ আটে ক্রোয়েশিয়া। প্রতিপক্ষ যখন তুরস্ক, তখন ২০ বছর পর আবারও এক আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টের শেষ চারে যাওয়ার স্বপ্নে বিভোর তারা। শেষ আটে ১১৯ মিনিট এগিয়ে, ক্লাসনিচের গোলে সেমিতে যাওয়ার প্রহর গুণছে তখন সমগ্র ক্রোয়েশিয়া। এমন সময় সমতায় ফিরল তুরস্ক। ম্যাচ গেল পেনাল্টিতে। আবারও তীরে এসে তরী ডুবল মদ্রিচদের। ১০ বছর আগে, ১০ বছর পরে।
সুযোগ অবশ্য কম আসেনি এরপর। ২০১০ বিশ্বকাপের মূলপর্বে কোয়ালিফাই-ই করতে পারল না ক্রোয়েশিয়া, ২০১২ ইউরো থেকে বিদায় নিতে হল গ্রুপপর্বেই। একই ভাগ্য বরণ করে নিতে হল ২০১৪ বিশ্বকাপেও। ২০০৭-এর তরুণেরা আর নেই তরুণ। বয়সের ছাপটা পড়তে লাগল সবার খেলাতেই। কেটে গেল বছর দুয়েক। এলো ইউরো ২০১৬। স্পেনকে হারিয়ে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে শেষ ষো্লোতে। কিন্তু পর্তুগালের কাছে হেরে আবারও চোখের জলে বিদায় নিলেন মদ্রিচরা।
সুকারদের পরবর্তী প্রজন্ম হয়ে থাকতে পারত ‘ট্রাবল্ড জিনিয়াস’ হয়েই। হঠাৎ সামর্থ্যের জানান দেওয়া, আর বাকিটা সময় একেবারেই সাদামাটা। ২০১৮ বিশ্বকাপে আসতে হল প্লে-অফ খেলে। বিশ্বকাপের মাত্র মাস সাতেক আগে বরখাস্ত করা হল কোচ আনতে কাসিচকে। তার জায়গায় আসলেন সাবেক ফুটবলার দালিচ। এবারও খুব একটা প্রত্যাশা ছিল না কারো মাঝেই। কিন্তু দালিচ এবং মদ্রিচরা প্রতিজ্ঞা করলেন, শেষটা যেন হয় মনে রাখার মতই। দালিচ দলকে বাঁধলেন এক সুতোয়, দেশবাসীর প্রত্যাশা এবং নিজেদের সামর্থ্যের ওপর বিশ্বাস রাখতে বললেন। একতাবদ্ধ ক্রোয়েশিয়ার সামনে দাঁড়াতেই পারল না মেসি-আগুয়েরোদের আর্জেন্টিনা। ৩-০ গোলের জয়ে আবারও দেশবাসীকে বুঁদ করলেন স্বপ্নে।
গতকাল শেষ ষোলর ম্যাচে ১১৫ মিনিটে যখন মদ্রিচ পেনাল্টি মিস করলেন, তখন ফিরে এলো। ম২০০৮ ইউরো কোয়ার্টার ফাইনালের দুঃস্মৃতি। সেদিনও পেনাল্টি থেকে গোল করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন ‘লুকিতা।’ মদ্রিচের মতই সেদিন মিস করেছিলেন রাকিটিচ। নিকোলাই ইয়োর্গেনসেনের পেনাল্টি যখন ফিরিয়ে দিলেন ক্রোয়াট গোলরক্ষক ড্যানিয়েল সুবাসিচ, তখন ‘ম্যাচ পয়েন্ট’ চলে আসল রাকিটিচের পায়ে। এবার আর ভুল করলেন না তিনি। ঠান্ডা মাথার মাটি কামড়ানো শটে বল জড়ালেন জালে। সবার আগে, সবচেয়ে দ্রুত ছুটে আসলেন মদ্রিচই। রাকিটিচকে জড়িয়ে ধরার পর বাবাকে দীর্ঘদিন পর দেখা শিশুর মত লাফিয়ে চড়লেন সুবাসিচের কোলে। তার শাপমোচনটা যে সম্ভব হল এই দুজনের জন্যই। এরপর দর্শকদের ধন্যবাদ জানালেন মদ্রিচ-রাকিটিচ-মানজুকিচরা। ছিলেন ভিদা, লভ্রেনরাও। মদ্রিচ চলে গেলেন কিছুটা দূরে, ভিআইপি গ্যালারির ঠিক নিচে। হাত নেড়ে একজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন। করজোড়ে ক্ষমা চাইলেন তার কাছে। কাঁচা-পাকা চুলের ‘স্যুটেড বুটেড’ কেতাদুরস্ত ভদ্রলোকটিও মৃদু হাসলেন। এরপর প্রত্যুত্তরে ‘স্যালুট’ জানালেন মদ্রিচকে। মানুষটা আর কেউ নন, বরং ডেভর সুকার। যার পায়ের কারিশমাতেই ১৯৯৮-এর রূপকথা লিখেছিল ক্রোয়েশিয়া।
গতকালের ম্যাচটায়ও ছিল না নাটকের কমতি। অতিরিক্ত সময়ে ভিদার গোলে লিড নিলেও ম্যাচ শেষের মিনিট পাঁচেক আগে সমতায় ফিরল রাশিয়া। আবারও ম্যাচ গেল পেনাল্টিতে। নির্ধারিত সময়ে পায়ে ব্যথা পেয়ে খোঁড়াচ্ছিলেন। কিন্তু পেনাল্টিতে সুবাসিচ যেন ফিরে গেলেন ডেনমার্কের ম্যাচেই। সেভ করলেন স্মোলোভের পেনাল্টি, সমতায় ফেরানোর নায়ক ফার্নান্দেজ মারলেন বাইরে। আবারও ক্রোয়েশিয়ানদের ভরসা নেমে আসল একজনের কাঁধে। আগের ম্যাচের মত এবারও মাথা ঠান্ডা রাখলেন। বলতে গেলে 'কার্বন কপি'ই করলেন নিজের আগের শটটি। ডানদিকের মাটি কামড়ানো শটে ক্রোয়েশিয়াকে সেমিফাইনালে নিয়ে গেলেন রাকিটিচ। গোলের পর উদযাপনে শামিল হলেন ক্রোয়েশিয়ার প্রেসিডেন্টও। আবেগটা যে তাদের সবারই একটু বেশি!
সেই ২০০৮-এর তরুণরা এখন অভিজ্ঞ সৈনিক। বয়সটা প্রায় সবারই এখন ত্রিশের কোঠায়। চার বছর পর কাতারে হয়ত থাকবেন না মদ্রিচ-রাকিটিচরা। হয়ত বিশ্ব দরবারে এবারই শেষ একসাথে দেখা যাবে ক্রোয়েশিয়ার একবিংশ শতাব্দীর সোনালী প্রজন্মের। এবার কি অসম্ভব কিছু হবে, ৯৮ এর সেই আক্ষেপ কি এবার ঘুঁচবে?