বিশ্বকাপেই যাদের শেষ
আন্দ্রেস ইনিয়েস্তা
স্পেন, ১৩১ ম্যাচ, ৪ বিশ্বকাপ
সেস ফ্যাব্রিগাসের বাড়ানো বলটা রিসিভ করে সামনে বাড়িয়ে ভলি, এরপর গোল- স্পেনের ফুটবল ইতিহাসের এখন পর্যন্ত সবচেয়ে স্মরণীয় মুহুর্ত তো সেটাই! যে মুহুর্তের জনকের নাম আন্দ্রেস ইনিয়েস্তা। ১১৬ মিনিটের সেই গোলেই বিশ্বকাপ জিতেছিল স্পেন, জোহানেসবার্গে। তবে সময় তো কম গড়ায়নি, মাঝে পেরিয়ে গেছে আরেকটা বিশ্বকাপ, যেখানে স্পেন দেখেছিল পুরো উলটো দৃশ্যটা। ব্রাজিল বিশ্বকাপ থেকে গ্রুপ-পর্বেই বিদায় নিতে হয়েছিল তাদের। রাশিয়ায় যখন আরেকটা বিশ্বকাপ, ইনিয়েস্তার বয়স তখন ৩৪, এখন পুরো নব্বই মিনিটও খেলতে পারেন না। স্পেন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে এল দ্বিতীয় রাউন্ডে, অবিশ্বাস্য রাশিয়ায় যেখানে আটকা পড়ে গেল তারা, টাইব্রেকারে। ইনিয়েস্তা একটা কিক নিলেন, গোলও করলেন। স্পেনের হয়ে যেটা হয়ে থাকলো তার শেষ কিক। বিশ্বকাপের আগেই বলে রেখেছিলেন, স্পেনের বিদায়ের পর নিশ্চিত করেছেন সেটাই। বিদায় বলছেন আন্তর্জাতিক ফুটবলকে, বিদায় বলেছেন স্পেনকে। ২০০৬ সালে অভিষেক হয়েছিল স্পেনের হয়ে, ওই বিশ্বকাপ ছাড়াও জিতেছেন দুইটি ইউরো- ২০০৮ ও ২০১২ সালে। ১২ বছরের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে কম দ্যূতি ছড়াননি, শেষটা নাহয় নাইবা হলো মনের মতো! ইনিয়েস্তা তো সঙ্গে করে নিয়েই যাচ্ছেন একগাদা সুখের স্মৃতি!
হাভিয়ের মাসচেরানো
আর্জেন্টিনা, ১৪৭ ম্যাচ, ৪ বিশ্বকাপ
নাইজেরিয়ার বিপক্ষে ম্যাচটায় চোট পেলেন মুখে, রক্ত পড়ছিল রীতিমতো। সেটা নিয়েই খেলে গেলেন হাভিয়ের মাসচেরানো। আর্জেন্টিনা পার করলো অনেক বড় হার্ডল, মেসিকে জড়িয়ে থাকা মাসচেরানোর ছবিটাই যেন বলে দেয়, কী স্বস্তি পেয়েছিলেন তারা। তবে সেটাই শেষ। ফ্রান্সের কাছে হেরে দ্বিতীয় রাউন্ডেই শেষ আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ, মাসচেরানোও বিদায় বললেন তার ১৪ বছরের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে। অবশ্য তার আগেই একটা রেকর্ড হয়ে গেছে এই মিডফিল্ডারের, আর্জেন্টিনার হয়ে রেকর্ড ১৪৭টি ম্যাচ খেলেছেন তিনি। ২০০৪ সালে অভিষেক হয়েছিল, অবশ্য জাতীয় দলের হয়ে সবচেয়ে বড় অর্জন ২০০৮ সালে বেইজিং অলিম্পিকে স্বর্ণপদক জেতাটাই। এর চেয়েও অনেক বড় কিছুর খুব কাছে গিয়েছিলেন তিনি, ২০১৪ বিশ্বকাপে জার্মানির বিপক্ষে খেলেছিলেন ফাইনাল।
রাফায়েল মার্কেজ
মেক্সিকো, ১৪৬ ম্যাচ, ৫ বিশ্বকাপ
১৯৯৭ সালে ইকুয়েডরের বিপক্ষে ওই ম্যাচটায় নাকি ডাকার কথা ছিল সিজার মার্কেজকে, ডাকা হলো আরেক মার্কেজ, রাফায়েলকে। সেই যে ভুল হলো, এরপর সেখান থেকেই ফুটলো ইতিহাসের ফুল! রাফায়েল মার্কেজ খেললেন টানা পাঁচটি বিশ্বকাপ, মেক্সিকোর হয়ে গড়লেন রেকর্ড! ইতিহাসে মার্কেজ ছাড়া পাঁচটি বিশ্বকাপ খেলেছেন আর মাত্র তিনজন! ব্রাজিলের বিপক্ষে শেষ ষোল-র ম্যাচে নামলেন প্রথম থেকেই, পরলেন অধিনায়কেরও আর্মব্যান্ড। পাঁচটি বিশ্বকাপে অধিনায়কত্ব করা একমাত্র ফুটবলার হয়ে গেলেন মার্কেজ। অবশ্য হাফ-টাইমেই বেঞ্চে চলে যেতে হলো তাকে, ২১ বছরের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারটাও শেষ ওখানেই, মেক্সিকো যে ব্রাজিলের কাছে হেরে আবারও বিদায় নিল দ্বিতীয় রাউন্ড থেকেই।
টিম কেহিল
অস্ট্রেলিয়া, ১০৭ ম্যাচ, ৪ বিশ্বকাপ
বয়সভিত্তিক দলে খেলেছিলেন সামোয়ার হয়ে। তবে টিম কেহিল পরে জানিয়েছিলেন, সেটা ছিল নিতান্তই ছুটি কাটানোর উপলক্ষ্য! আন্তর্জাতিক ফুটবলে অভিষেকটা কেহিলের অস্ট্রেলিয়ার হয়েই, ২০০৪ সালে। এরপর খেললেন চারটি বিশ্বকাপ। আগের তিন বিশ্বকাপেই গোল করেছিলেন, চারটি বিশ্বকাপে গোল করা তিনজনের এক সংক্ষিপ্ত তালিকা ডাকছিল কেহিলকে। তবে রাশিয়ায় জালের দেখা পেলেন না কেহিল, অস্ট্রেলিয়াও বিদায় নিল প্রথম রাউন্ড থেকেই। বয়স ৩৮ হয়ে গেছে, কাতারে কেহিলকে দেখার আশাটা তাই একটু বাড়াবাড়িই! কেহিলের ইতিহাসটাও তাই গড়া হলো না আর।
পেপে
পর্তুগাল, ৯৯ ম্যাচ, ৩ বিশ্বকাপ
লাফিয়ে উঠলেন, করলেন হেড। জাতীয় দলের হয়ে ৬ষ্ঠ গোল। ৫৫ মিনিটে সমতায় ফিরে এলো পর্তুগাল, দ্বিতীয় রাউন্ডে উরুগুয়ের সঙ্গে। তবে পেপের সেই গোলটা ছাপিয়ে খানিকবাদেই উরুগুয়ে এগিয়ে গেল আবার। পর্তুগাল আর ধরতে পারলো না তাদের। রাশিয়া বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নিতে হলো দ্বিতীয় রাউন্ডেই। ২০০৭ সালে আন্তর্জাতিক ফুটবলে অভিষেক হয়েছিল পেপের, এরপর খেললেন তিনটি বিশ্বকাপ। তার বাবা দাবি করেছিলেন, জন্মভূমি ব্রাজিল থেকে নাকি প্রস্তাব পেয়েছিলেন খেলার। পেপে সেটা নাকচ করে খেলেছিলেন পর্তুগালের হয়েই। বয়স এখন ৩৫, পর্তুগালের হয়ে কাতারে তাকে দেখা যাবে?
জেরার্ড পিকে
স্পেন, ১০২ ম্যাচ, ৩ বিশ্বকাপ
২০১০ বিশ্বকাপে কার্লোস পুয়োলের সঙ্গে জেরার্ড পিকের কাছেই ছিল স্প্যানিশ রক্ষণের দায়িত্ব। সাত ম্যাচে স্পেন গোল হজম করেছিল মাত্র দুইটি, নক-আউট পর্বে টানা চারটি ম্যাচেই ছিল ক্লিন-শিট। জুটিটা যে দারুণ ছিল, সেটা কি আর বলতে হয়! সেই স্পেনই পরের বিশ্বকাপে গ্রুপ-পর্বেই বাদ, আর এবার রাশিয়ার কাছে হেরেই বিদায় বলতে হলো রাশিয়াকে, দ্বিতীয় রাউন্ডেই। আগেই বলে রেখেছিলেন, রাশিয়াতেই বিদায় বলবেন স্পেনকে। তবে জেরার্ড পিকে এতো আগে বলতে চাননি হয়তো! ২০০৯ সালে স্পেন জাতীয় দলের হয়ে অভিষেক হয়েছিল পিকের, এরপর খেলেছেন ১০২টি ম্যাচ। ৩১ বছর বয়স হয়ে গেছে, ভারটা আর নিতে চাননি তিনি।
তারা দুজনও?
রোনালদো (পর্তুগাল), মেসি (আর্জেন্টিনা)
সময়ের সেরা দুই ফুটবলারের আক্ষেপটা ঘুচলো না এবারও। লিওনেল মেসি গতবার গিয়েছিলেন খুব কাছে, এবার ফিরেছেন দ্বিতীয় রাউন্ডেই। ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর সেরা অর্জন- ২০০৬ সালে পর্তুগালের চতুর্থ হওয়া। রাশিয়া বিশ্বকাপে একই রাতেই ঘন্টা কয়েকের ব্যবধানে বিদায় নিয়েছেন দুইজন। মেসি একবার অবসর ভেঙে ফিরে এসেছিলেন জাতীয় দলে, এই বিশ্বকাপের পর অবশ্য জানাননি তেমন কিছু। আর রোনালদো বলেছেন, পর্তুগালের হয়ে তার ভবিষ্যত নিয়ে আলোচনার উপযুক্ত সময় এটা নয়। মেসির বয়স ৩১, রোনালদোর ৩৩- পরের বিশ্বকাপ পর্যন্ত অপেক্ষা করবেন দুইজন? নাকি এই আক্ষেপের গল্পগুলোই থাকবে শুধু তাদের বিশ্বকাপ অধ্যায়ে?