ইতিহাস বদলে কোয়ার্টার ফাইনালে ইংল্যান্ড
৯৩ মিনিটে গোল হজম করে জিততে থাকা ম্যাচটা গেল অতিরিক্ত সময়ে। পুরো ম্যাচে কলম্বিয়ার ওপর ছড়ি ঘুরিয়েও অতিরিক্ত সময়ে মলিন ইংল্যান্ড। কলম্বিয়ানরাই বেশি উজ্জীবিত। ১২০ মিনিট শেষেও স্কোরলাইন ১-১। টাইব্রেকারে খেলা, আর সেটা মানেই তো ইংল্যান্ডের হার! বিশ্বকাপের ইতিহাসে কখনই টাইব্রেকার ভাগ্য যায়নি ইংলিশদের পক্ষে। জর্ডান হেন্ডেরসনের ৩ নম্বর শটটা ডেভিড অস্পিনা ঠেকিয়ে দেওয়ার পর ইংলিশদের দেখে দেজাভু হওয়ার যোগাড়। জার্সির ভেতরে মানুষগুলো আলাদা, কিন্তু এই দৃশ্য তো চিরচেনা। কিন্তু এই বিশ্বকাপও তো আলাদা, রাশিয়ার কাছে যে চমক তোলা ছিল তখনও। কলম্বিয়ার ৪ নম্বর শটটা ফেরত আসলো বারপোস্টের কোণায় লেগে। শেষেরটা ঠেকিয়ে দিলেন জর্ডান পিকফোর্ড। আর ইংল্যান্ডের হয়ে বাকি দুইটি স্পটকিক থেকেই গোল করলেন ট্রিপিয়ার আর ডায়ার। তাতেই ইতিহাস বদলে ফেলল ইংল্যান্ড, টাইব্রেকারে ৪-৩ গোলে জিতে এক যুগ পর বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে থ্রি লায়নরা।
একটা ম্যাচ শুধু নয়, ইংল্যান্ড আসলে জিতেছে একটা যুদ্ধ। যে যুদ্ধে কলম্বিয়ার খেলোয়াড়দের সঙ্গে ৯২ মিনিট পর্যন্তও এগিয়ে ছিল ইংলিশরা। তখন পর্যন্ত রেফারিকে হলুদ কার্ড বের করতে হয়েছিল ৭ বার। রেফারির প্রায় প্রতিটি সিদ্ধান্ত ঘিরেই জটলা, সেখানে হলুদ জার্সির খেলোয়াড়দের আধিক্যই বেশি। হলুদটা আজ বেশি প্রাপ্য ছিল তাদেরই। পুরো ম্যাচে সবমিলিয়ে ৬ জন কলম্বিয়ান খেলোয়াড় দেখেছেন হলুদ কার্ড। সেটা অনেকের ক্ষেত্রেই নিমিষেই লাল কার্ড হয়ে যেতে পারত। প্রথমার্ধ শেষের ৪ মিনিট আগে ফ্রি কিক এর সামনের দেয়ালে হেন্ডেরসনকে মাথা দিয়ে গুঁতো মেরেছিলেন উইলমার ব্যারিয়স। সেটা লাল হতেও পারত, যুক্তরাষ্ট্রের রেফারি মার্ক গেইগার দয়াই দেখিয়েছেন তখন। কিন্তু কলম্বিয়ানরা সেখান থেকে শিক্ষা নিল অল্পই। তাদের কপালও পুড়ল মাথা গরম করার জন্যই। কর্নার থেকে হ্যারি কেইনকে ডিবক্সের ভেতর আটকে রেখেছিলেন কার্লোস সানচেজ। ৫৭ মিনিটে আর রেফারির চোখ এড়ায়নি সেই ঘটনা। সঙ্গে সঙ্গেই পেনাল্টির বাঁশি, ইংল্যান্ড পেল এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ। কেইনই এগিয়ে আসলেন, শট নিলেন, গোল করলেন। বিশ্বকাপে নিজের ৬ নম্বর, আর পেনাল্টি থেকে ৩। গোল্ডেন বুটের পথে আরেক ধাপ এগিয়ে গেলেন, সঙ্গে ইংল্যান্ডকেও কাঁধে করে নিয়ে যাচ্ছিলেন কোয়ার্টার ফাইনালের পথে।
শুরু থেকেই অনুমিতভাবে ইংলিশদের সব আক্রমণের লক্ষ্য ছিলেন কেইনই। ১৬ মিনিটে কেয়ারন ট্রিপিয়ারের ক্রসে ভালোমতো মাথা ছোঁয়াতে পারেননি। প্রথমার্ধে বলার মতো সুযোগ এসেছিল ওই একটাই। তবে বলের দখল বেশি ছিল ইংলিশদের কাছেই, কলম্বিয়ানরা এলোমেলো ছিল প্রায় সবদিক থেকেই। হামেস রদ্রিগেজ ছিলেন না ইনজুরির কারণে। ম্যাচের প্রথম ৯০ মিনিটে রাদামেল ফ্যালকাও তেমন ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠেননি ইংলিশদের জন্য। হামেসকে ছাড়া অসহায় ছিল কলম্বিয়ার মাঝমাঠ, তবে নিজেদের নিয়মিত খেলাটাও খেলতে পারছিলেন না কুয়াদ্রাদো, কিন্তেরোরা। উলটো এক গোলে এগিয়ে থাকা অবস্থায় ট্রিপিয়েরের আরেকটা ক্রস ড্যালে অ্যালি ঠিকমতো মাথা ছোঁয়াতে পারলে ৬৩ মিনিটেই দুই গোলে এগিয়ে যেতে পারত ইংল্যান্ড।
দেরি করে হলেও কলম্বিয়া অবশ্য ইংল্যান্ডের রক্ষণে ভীতি চড়াতে শুরু করেছিল। মহিকার ডানদিক থেকে করা ক্রসে ফ্যালকাওয়ের হেড ৮৬ মিনিটে যায় বাইরে দিয়ে। এরপর ৯২ মিনিটে মাথিয়াস উরিবের শট সেভ করেন পিকফোর্ড। তখনও প্রাণ যায়নি কলম্বিয়ার, এরপরই সেটা দেখাল তারা। দেখালেন আসলে ইয়েরি মিনা। আগের দুই ম্যাচেই গোল করেছিলেন, ৯৩ মিনিটে লাফিয়ে উঠে করলেন হেড। এরপর বারপোস্টে দাঁড়ানো ট্রিপিয়ারের মাথার ওপর দিয়ে সেটা ঢুকল জালে, ইংল্যান্ডের হৃদয় ভাঙল, কলম্বিয়ার মরা গাঙে বান আসলো তাতে।
অতিরিক্ত সময়েও তাই কলম্বিয়ার অনুপ্রেরণার অভাব হলো না। হামেস গ্যালারি থেকেই সমর্থন যুগিয়ে যাচ্ছিলেন, শেষদিকে এসে দলের সঙ্গেও যোগ দিলেন। ১০০ মিনিটেই আরেকবার উল্লাসে মাতার সুযোগ পেতে পারতেন হামেস। হুয়ান কুয়াদ্রাদোর ক্রসে বাক্কার হেড গোলে পরিণত হতে পারত। একইরকম ভাবে মহিকার ক্রসেও মাথা ছুঁয়েছিলেন ফ্যালকাও। সে দফায়ও পারেননি গোল করতে। দ্বিতীয়ার্ধে ইংল্যান্ডও অবশ্য ফেরত এলো ম্যাচে, ড্যানি রোজ ডিবক্সের ভেতর থেকে অল্পের জন্য লক্ষ্য মিস করলেন, আর ডায়ার প্রায় ফাঁকায় থেকেও হেড করলেন বাইরে দিয়ে। খেলাটা ওখানেই সঁপে দেওয়া হলো ট্রাইব্রেকার ভাগ্যের কাছে।
অস্পিনার প্রথম সেভের পরও মুখ লুকিয়ে ছিলেন কলম্বিয়া কোচ হোসে পেকারম্যান। অথচ টাইব্রেকারে কলম্বিয়াই তখন জয়ের পথে। এই দৃশ্য তার খুব চেনা। ২০০৬ সালে আর্জেন্টিনার কোচ হয়েও টাইব্রেকারে হেরেছিলেন তিনি। জানাই ছিল টাইব্রেকারের রঙ্গমঞ্চের কথা। ম্যাচ শেষে তাকে আর খুঁজে পাওয়া গেল না। ইংল্যান্ডের ভাগ্য ফিরেছে, কিন্তু তার ভাগ্যটা আর ফিরল না। প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপে কোনো দলকে অন্ততপক্ষে কোয়ার্টার ফাইনালে নিয়ে যাওয়া হলো না তার। আর আগের বিশ্বকাপের গোল্ডেন বুটজয়ী হামেস তো চেষ্টাটাও করতে পারলেন না। আরও একবার আফসোসেই বিশ্বকাপ শেষ হলো হামেসের। ইংল্যান্ডের কাছে হেরেছে কলম্বিয়া, আর সোনার বুটের লড়াইয়ে তো সবাই হারছে কেইনের কাছে।
কিন্তু ম্যাচের ভেতরের এইসব ছোট গল্প ছাপিয়ে গেল গ্যারেথ সাউথগেটের গল্পটা। ১৯৯৬ ইউরোতে টাইব্রেকারে পেনাল্টি মিস করেছিলেন, এরপর বাড়ি ফিরেছিল ইংল্যান্ড। ইংলিশদের বলির পাঠায় পরিণত হয়েছিলেন তখন। ২২ বছর পর সেই সাউথগেট যখন ইংল্যান্ডের কোচ, অবশেষে তখন ভাগ্য ফিরল ইংল্যান্ডের।
একাদশ
ইংল্যান্ড
পিকফোর্ড, ওয়াকার, স্টোন, ম্যাগুয়ের, ট্রিপিয়ার, ইয়াং, লিনগার্ড, হেন্ডেরসন, অ্যালি, কেইন, স্টার্লিং
কলম্বিয়া
অস্পিনা, অ্যারিয়াস, ইয়েরি মিনা, মহিকা, ডেডিনসন সানচেজ, ব্যারিয়স, কার্লোস সানচেজ, কুয়াদ্রাদো, লার্মা, কিন্তেরো, ফ্যালকাও