বিশ্বকাপে 'প্ল্যান বি' কই?
এমন অনেক কিছুই হচ্ছে এবারের বিশ্বকাপে, যা আগে কখনো হয়নি। সবচেয়ে বেশি পেনাল্টি, সবচেয়ে বেশি আত্মঘাতী গোলের রেকর্ড হয়ে গেছে বহু আগেই। শেষ সময়ে এত বেশি গোলের শেষের কবিতাও লেখা হয়নি কখনো। কে জানে, হয়তো নতুন কোনো চ্যাম্পিয়নও দেখতে পারে রাশিয়া। আরও একটা ব্যাপারে বোধ হয় নিশ্চিত, একের পর এক পরাশক্তিদের এমন হোঁচটও বিশ্বকাপে হয়েছে অনেক দিন পর। জার্মানি, স্পেন, আর্জেন্টিনার মতো দলের বিদায়ের কারণ নিয়ে অনেক রকম কাঁটাছেড়াই হতে পারে। তবে একটা ব্যাপার পরিষ্কার, এবারের বিশ্বকাপে ‘প্ল্যান বি’ ঠিকঠাক কাজে লাগাতে পেরেছে এখন পর্যন্ত খুব কম দলই।
এমন নয়, এবারের বিশ্বকাপে বদলিরা গোল পাননি। ডেনিশ চেরিশেভই প্রথম ম্যাচে জোড়া গোল করে সব আলো নিজের দিকে নিয়েছিলেন। তবে চেরিশেভকে মাঠে নামতে হয়েছিল অনেকটা পাকেচক্রেই, অ্যালান জাগোয়েভের চোটেই ভাগ্য খুলে যায় তাঁর। গ্রুপ পর্বে মোট দশ জন বদলি হিসেবে নেমে গোল করেছেন, দ্বিতীয় রাউন্ডে যেমন পেয়েছেন ফিরমিনো, ফেলাইনি, শাদলিরা। গত বিশ্বকাপে সংখ্যাটা ছিল ২৪, ব্রাজিলের চেয়ে রাশিয়া এখানে এখনো অনেকটা পিছিয়ে। কিন্তু ঠিক বিকল্প কৌশল হিসেবে নেমে বদলিরা বলার মতো কিছু করেছেন, বা ‘প্ল্যান বি’ দারুণভাবে কাজে এসেছে, এমন উদাহরণ এক আঙুলেই বোধ হয় গুণে ফেলা যাবে।
বড় দলগুলোই দেখুন। জার্মানির প্রথম রাউন্ড থেকে বিদায়ের সবচেয়ে বড় কারণ কী? জোয়াকিম লোর ভাবনা থেকে একটা ব্যাপার পরিষ্কার, ‘প্ল্যান বি’ কীভাবে কাজে লাগাতে হবে সেটা তিনি খুব একটা ভাবেনইনি। দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে ম্যাচে জার্মানি যখন গোল পেতে জেরবার, তখন বদলি হিসেবে নামলেন গোমেজ। কিন্তু কোরিয়ানদের উচ্চতার সুবিধা জার্মানরা কাজে ঠিকঠাক লাগাতে পারল কই? জার্মানির একমাত্র জুলিয়ান ব্রান্ডটই বদলি হিসেবে নেমে কিছুটা ঝলক দেখিয়েছেন। কিন্তু তাঁকে আগে না নামানোয় লোর আদৌ কোনো দ্বিতীয় পরিকল্পনা ছিল কি না, সেটা নিয়ে প্রশ্ন উঠেই যাচ্ছে। একগুচ্ছ দারুণ খেলোয়াড় নিয়েও জার্মানিকে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্ব থেকে বিদায় নিতে হয়েছে। শুধু কোরিয়া কেন, সুইডেন বা মেক্সিকোর সঙ্গে ম্যাচেও জার্মানি যখন কোণঠাসা, লোর বিকল্প কৌশলের খুব একটা ছাপ দেখা যায়নি মাঠে।
আর্জেন্টিনা হতে পারে এই পরিকল্পনাহীনতার সবচেয়ে বড় উদাহরণ। হোর্হে সাম্পাওলির একটাই কৌশল ছিল, মেসিকে ঘিরে কীভাবে খেলানো যায়। কিন্তু মেসিকে যখন প্রতিপক্ষ বোতলবন্দি করে রাখে বা যেদিন মেসি একটু নিষ্প্রভ থাকেন, সেদিন সাম্পাওলি যেন জানেনই না কী করবেন। ক্রোয়েশিয়ার সঙ্গে ম্যাচে হিগুয়াইন, দিবালারা মাঠে নামলেও খেলা দেখেই বোঝা যাচ্ছিল, তাদের নিয়ে কোচ কোনো পরিকল্পনাই করেননি। স্কোয়াডে লে সোলসো বা দিবালাদের বদলি হিসেবে কীভাবে কাজে লাগানো যায়, সেটা নিয়েও সাম্পাওলি ভাবেননি একদমই। ফ্রান্সের সঙ্গে মেসি ফলস নাইনে খেললেও মাঠের খেলায় মেসিদের সুস্পষ্ট দিক নির্দেশনার ছাপ পাওয়া যায়নি। নাইজেরিয়ার সঙ্গে রোহো ভাগ্যবলে গোলটা না পেলে এই পরিকল্পনাহীনতার মাশুল আগেই দিতে হতো সাম্পাওলিকে।
তবে এই ‘প্ল্যান বি’-এর অভাবের সবচেয়ে বড় উদাহরণ সম্ভবত স্পেন। রাশিয়ার সঙ্গে ম্যাচে ১১০০র বেশি পাস দিয়েও স্পেন আসল কাজটাই করতে পারেনি। পুরো ম্যাচে একই কৌশলে খেলে গেছে- পাস, পাস এবং পাস। অথচ রদ্রিগো, আসপাস নামায় খেলার ধারটা যখন বেড়েছে, দেরি হয়ে গেছে অনেক। বোঝাই গেছে, ফার্নান্দো হিয়েরো তাঁদের নিয়ে ভাবেননি। অবশ্য হিয়েরোর খুব একটা দোষ দেওয়াও অনুচিত। বিশ্বকাপের মাত্র এক দিন আগে দায়িত্ব পেয়ে একজন কোচের পরিকল্পনা করাও কঠিন। তবে স্পেন শুরু থেকেই কেন ওই কৌশলে খেলল, সেটা নিয়েও উঠতে পারে প্রশ্ন।
বড় দলগুলোর মধ্যে বিকল্প ভাবনা এখন পর্যন্ত সেভাবে কাজে লাগাতে হয়নি ব্রাজিলেরও। কোস্টারিকার সঙ্গে ম্যাচেই শুধু গোল না পাওয়ায় শেষ দিকে ফিরমিনোকে নামিয়েছিলেন তিতে। কৌতিনহোর ওই সমতা ফেরানো গোলে ছিল বড় অবদান। ট্যাকটিক্যালি একটা বিকল্প ভাবনা অবশ্য এখনই ভাবতে হচ্ছে তিতেকে। কাসেমিরো না থাকায় বেলজিয়ামের সঙ্গে হয়তো নামাতে হবে ফার্নান্দিনহোকে। ব্রাজিলের কৌশল সেক্ষেত্রে কেমন হয়, সেটাই এখন দেখার।
‘প্ল্যান বি’ যদি কেউ একদম ঠিকঠাক কাজে লাগাতে পারে, সেটা বেলজিয়ামই করে দেখিয়েছে কিছুটা। জাপানের সঙ্গে যখন ২-০ গোলে পিছিয়ে পড়েছিল, রবার্তো মার্তিনেজ নামান মারুয়ানে ফেলাইনি ও নেসার শাদলিকে। ক্রস আর হেডের কৌশলটা প্রথম জন কাজে লাগিয়েছেন প্রায় সাথে সাথেই, আর দ্বিতীয়জন ম্যাচের শেষ মুহূর্তে করেছেন প্রতি আক্রমণে সেরা গোলগুলোর একটি। অবশ্য জাপানের সঙ্গে উচ্চতার সুবিধা কাজে লাগানোর কথা মার্তিনেজ শুরু থেকে কেন ভাবেননি, সেই প্রশ্নও উঠছে। ফ্রান্স কোচ দিদিয়ের দেশম প্রথম ম্যাচে একজন আউট অ্যান্ড আউট স্ট্রাইকার না খেলানোর সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসে ফল পেয়েছেন। এমবাপ্পে, গ্রিজমানের সঙ্গে এখন খেলছেন জিরু। তবে কোণঠাসা অবস্থায় দেশমের বিকল্প কৌশল কী, সেটার পরীক্ষা এখনো দিতে হয়নি। যেমন ইংল্যান্ডও এখন পর্যন্ত তিন সেন্টারব্যাক আর দুই উইংব্যাক নিয়ে ৩-৩-২-২ ফর্মেশনে উতরে গেছে। কিন্তু সামনে আরও কঠিন পরীক্ষা দিতে হতেই পারে।
'প্ল্যান বি' কারা ঠিকঠাক কাজে লাগাতে পারে কারা, সেটাই হয়তো ঠিক করে দিতে পারে সামনের ম্যাচগুলোর ভাগ্য।