ব্রাজিলকে বিদায় করে সেমিফাইনালে বেলজিয়াম
প্রথমার্ধেই দুই গোলে পিছিয়ে পড়েছিল ব্রাজিল। ইতিহাস তো আছেই, সঙ্গে দলের ভারসাম্যটাও ভরসা যোগাচ্ছিল। লড়াই করে ফিরেও এসেছিল ব্রাজিল। কিন্তু পাহাড়সমান বাধাটা আর জয় করা হয়নি। হেক্সা মিশন আরও একবার থেমে গেছে ইউরোপিয়ান দলের কাছে হেরেই। বেলজিয়ামের সোনালী প্রজন্ম স্বপ্নজয়ের পথে এগিয়েছে আরেক ধাপ। তাতেই মলিন নেইমার, কৌতিনহোরা। বেলজিয়ামের কাছে ২-১ গোলে হেরে বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে বিদায় নিয়েছে ব্রাজিলও।
কাজানের এই মাঠেই বিদায় নিয়েছিল জার্মানি, এরপর আর্জেন্টিনা। ব্রাজিলের বিদায় ভাগ্য লেখা হলো সেই মাঠেই। অথচ শুরুটা মন্দ ছিল না তিতের দলের। ৮ মিনিটেই কর্নার থেকে বেলজিয়ামের বারপোস্ট কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন থিয়াগো সিলভা। ফ্লিকটা অবশ্য মনমতো হয়নি সিলভার, নিশানা ঠিক করতে পারলে হয়ত শুরুতেই গল্প বদলে যায় ম্যাচের। এরপরের প্রায় ১০ মিনিটও চললো ব্রাজিলের আক্রমণ। আবার কর্নার থেকেই পাউলিনহো বল পেয়ে গেলেন ফাঁকায়, তিনি শটই করতে পারলেন না।
গতবার কোয়ার্টার ফাইনালে শুরুতেই গোল হজম করে আর ফেরা হয়নি বেলজিয়ামের, বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নিয়েছিল তারা। রেড ডেভিলরা এবার আর ভুল করলো না। শুরুর ধাক্কা সামলে উঠে তিতেকে ভুল প্রমাণ করে দিলেন রবার্তো মার্টিনেজ। মারুয়ন ফেলাইনি আর নাসের চাডলিকে আজ শুরু থেকেই নামিয়েছিলেন বেলজিয়াম কোচ। কেভিন ডি ব্রুইন ঠিক রোমালু লুকাকুর পেছনে। বিশ্বকাপের অন্যতম সেরা ব্রাজিলিয়ান রক্ষণ তাতেই রঙ হারিয়ে ফেলল। প্রতি আক্রমণে প্রতিবারই ভয়ঙ্কর হয়ে উঠল বেলজিয়াম। ব্রাজিলের সমস্যা ছিল আরও, হলুদ কার্ডের খড়্গে ছিলেন না কাসেমিরো, তার জায়গায় নামা ফার্নান্দিনহোর শুরুটা এর চেয়ে খারাপ হতে পারত না। ১৩ মিনিটে কর্নার ক্লিয়ার করতে লাফিয়ে উঠেছিলেন, তার বাহুতে লেগে বল ঢুকে গেল অ্যালিসনের জালে। ফার্নান্দিনহোর জন্য দুঃস্বপ্ন, বেলজিয়ামের স্বপ্নের শুরু।
শুরু থেকেই দুই দল খেলেছে আক্রমণাত্মক মেজাজে। বেলজিয়াম এক গোলে এগিয়েও তাই খুব বেশি স্বস্তিতে থাকতে পারল না। দুই মিনিট পরই নেইমার ঢুকে পড়লেন বক্সে, হেসুস বল পেলেন সেখান থেকে। প্রায় ফাঁকা বারেও তার শট ব্লকড হলো, গোল পাওয়া হলো না ব্রাজিলের। সেলেসাওদের নাম্বার নাইন শেষ পর্যন্ত বিশ্বকাপ শেষ করেছেন গোলশূন্য থেকে। হেসুস সেরা সুযোগটা পেয়েছিলেন ৩৫ মিনিটে। পুরো ফাঁকায় দাঁড়িয়ে থেকেও হেডে লক্ষ্যই ভেদ করতে পারেননি তিনি।
অবশ্য তার আগেই ব্রাজিলের সর্বনাশ ডেকে এনেছিলেন কেভিন ডিই ব্রুইন। প্রথম গোলের কর্নারটাও তারই নেওয়া। ৩১ মিনিটে ব্রাজিলের আক্রমণ থেকেই মাঝমাঠে বল পেয়েছিলেন লুকাকু, এরপর সব শক্তি দিয়ে সেটা নিয়ন্ত্রণে আনলেন, সামনে বাড়ালেন ডি ব্রুইনকে। বেলজিয়ান মিডফিল্ডার ডিবক্সের কোণাকুণি জায়গায় গিয়ে করলেন শট, সেটা গোলার মতো গিয়ে ধ্বংস করলো ব্রাজিলের জাল। ৩১ মিনিটেই বেলজিয়াম ২, ব্রাজিল ০।
কোম্পানি, ভেট্রোনহেন, অ্যাল্ডারুইরেল্ডের রক্ষণ তো ছিলই, তাদের পেছনে থিবো কোর্তোয়া হয়ে গেলেন আরেক দুর্গ। সবকিছু জয় করা গেলেও ব্রাজিল পারল না কোর্তোয়াকে টলাতে। প্রথমার্ধেই দুটো দারুণ সেভ করে বেলজিয়ামকে স্বস্তি দিলেন কোর্তোয়াই।
দ্বিতীয়ার্ধে শুরু ব্রাজিলের আসল লড়াই, আর কোর্তোয়াদের দিতে হলো আসল পরীক্ষা। তাতে জয়ীই হয়েছেন তারা, কিন্তু পথটা সহজ ছিল না মোটেই। বিরতির পরই তিতেকে বদলে ফেলতে হয়েছিল কৌশল। উইলিয়ানকে বসিয়ে নামালেন রবার্তো ফিরমিনোকে। তিনিই ব্রাজিলের প্রাণটা ফিরিয়ে দিচ্ছিলেন প্রায়। ৫১ মিনিটে মার্সেলোর মাপা ক্রসে পা ছোঁয়ালেই হয়ত হয়ে যেতে, সবকিছুই ঠিক করেছিলেন, ফিরমিনো শুধু বলের গতির সঙ্গে পায়ের ছন্দ মেলাতে পারলেন না। ব্রাজিলের আক্রমণে একসময় কোনঠাসাই হয়ে পড়েছিল বেলজিয়াম। প্রতি আক্রমণেও তেমন সুবিধা করতে পারছিল না। ৬২ মিনিটে এডেন হ্যাজার্ডের একটা চেষ্টা বাদ দিলে দ্বিতীয়ার্ধে তেমন সুযোগ কমই এসেছে বেলজিয়ানদের। তবে হ্যাজার্ড খেলেছেন অধিনায়কের মতোই। তার ডায়াগোনাল রান বারবারই বিপদে ফেলেছে ব্রাজিলের রক্ষণকে। তাতে অন্যপ্রান্তে ছন্দ কেটেছে ব্রাজিলের আক্রমণে।
ব্রাজিলের ছন্দে ফেরার অনুঘটক ছিলেন আরেক বদলি ডগলাস কস্তা। ডান প্রান্ত দিয়ে আক্রমণে গতি বাড়িয়েছিলেন তিনি। কিন্তু কাজের কাজটা করেছিলেন, রেনেটো আগুস্তো। মাঠে নামার ৩ মিনিটের মধ্যেই কৌতিনহোর উড়িয়ে মারা বলে হেড করে এক গোল শোধ করেন তিনি। এর কিছুক্ষণ পরই আগুস্তো হয়ে যেতে পারতেন ম্যাচের নায়কও। ডিবক্সের ঠিক বাইরে হুট করেই ফাঁকা জায়গা পেয়ে গিয়েছিলেন, জায়গা মতো বলও পেলেন। কিন্তু তার নেওয়া শটটা বিপদে ফেলতে পারল না কোর্তোয়াকে। বেলজিয়াম গোলরক্ষক অবশ্য শট ঠেকানোর আশা ছেড়েই দিয়েছিলেন, পায়ে বলটা ঠিকমতো লাগলে নাটকীয় ফিরে আসাটা হয়েই যেত ব্রাজিলের।
বিশ্বকাপের আগের ১৩০ ম্যাচে প্রথমার্ধে দুই গোলে পিছিয়ে পড়ে জেতা হয়নি কোনো দলের। তিতের দলেরও লেখা হয়নি ইতিহাস। শেষদিকে মার্টিনেজ আরও একজন ডিফেন্ডার নামিয়ে চার জনের ব্যাকলাইনে ফিরে গেলেন। এরপরও অবশ্য নেইমার দারুণ একটা শট নিয়েছিলেন, সেটা গোলেই পরিণত হত। কিন্তু দিনটা নেইমারের ছিল না, কোর্তোয়ার ফিঙ্গারটিপ সেভে গোলবঞ্চিত হলেন তিনি, গোলবঞ্চিত হলো ব্রাজিল।
হ্যাজার্ড, ডি ব্রুইন, লুকাকুরা ব্রাজিলের রক্ষণকে আরও ভুগিয়েছেন এক গোল খাওয়ার পর। প্রথমার্ধটা যদি ডি ব্রুইনের হয়, তাহলে হ্যাজার্ড সব আলো কেড়ে নিলেন দ্বিতীয়ার্ধে। পুরো ম্যাচে ১০ টি ড্রিবল করার চেষ্টা করেছিলেন হ্যাজার্ড, সফল হয়েছেন সবগুলোতে। পরিসংখ্যানের মারপ্যাঁচ শুরু হওয়ার পর এতোগুলো সফল ড্রিবল বিশ্বকাপে নেই আর কারও। হ্যাজার্ডের ওই খেলাই শেষদিকে ব্রাজিলকে আটকাতে সাহায্য করলো। এমন পারফরম্যান্সের পর অধিনায়ক হ্যাজার্ড তো বিশ্বকাপ শিরোপা উঁচিয়ে ধরার স্বপ্ন দেখতেই পারেন!
ইউরোপের বিশ্বকাপ তাই পাচ্ছে ইউরোপের কোনো দেশই। দিনের শুরুতেই লাতিন আমেরিকার উরুগুয়ে বাদ, এরপর ব্রাজিল। বাকি কোয়ার্টার ফাইনালেও ইউরোপেরই জয়জয়কার। ২০০৬ সালে জার্মানির মতো, রাশিয়ার বিশ্বকাপেও তাই সেমিফাইনালের ৪ দলই ইউরোপের।
ব্রাজিল একাদশ
অ্যালিসন, থিয়াগো সিলভা, মিরান্ডা, ফ্যাগনার, মার্সেলো, পাউলিনহো, ফার্নান্দিনহো, ফিলিপ কৌতিনহো, উইলিয়ান, গ্যাব্রিয়েল হেসুস, নেইমার
বেলজিয়াম একাদশ
থিবো কোর্তোয়া, টবই অ্যাল্ডারউইরেল্ড, ভিনসেন্ট কোম্পানি, ইয়ান ভেট্রোনহেন, থমাস মুনিয়ের, অ্যাক্সেল উইটসেল, কেভিন ডি ব্রুইন, মারুয়ন ফেলাইনি, নাসের চাডলি, এডেন হ্যাজার্ড, রোমেলু লুকাকু