• রাশিয়া বিশ্বকাপ ২০১৮
  • " />

     

    মরিয়াও যখন মরছে না লাতিন ফুটবল

    মরিয়াও যখন মরছে না লাতিন ফুটবল    




    চাইলে ব্যাপারটা কাকতাল হিসেবে ধরে নিতে পারেন। ২০০২ সালের পর লাতিন আমেরিকার কোনো দল বিশ্বকাপ জিততে পারেনি, ২০০৬ সালের পর আরও একবার শেষ চারের সব দলই ইউরোপের, ইউরোপ থেকে আরও একবার শিরোপা পাচ্ছে না লাতিন আমেরিকা- চাইলে এসব উদাহরণ থেকে একটা স্বতঃসিদ্ধান্তেও আসতে পারেন। লাতিন ফুটবলের এপিটাফের সামনে কয়েক ফোঁটা চোখের জল ফেললে আপনাকে এখন দোষও বোধ হয় দেওয়া যাবে না। কিন্তু প্রশ্নটা হচ্ছে, আসলেই লাতিন ফুটবল বলে কি কিছু আছে?

    অনেকেই হা রে রে করে তেড়ে আসতে পারেন। লাতিন ফুটবল বলতে চোখের সামনে ভেসে ওঠে ছোট ছোট পাস, চোখ জুড়ানো সব মুভমেন্ট, দারুণ কিছু ড্রিবল- এমন ‘নান্দনিক’, ‘শৈল্পিক’ কিছু। ব্রাজিলের ক্ষেত্রে সেটার নাম যেমন হয়েছে জোগো বোনিতো। কিন্তু এই ফুটবলীয় সংজ্ঞা অসার হয়ে গেছে আসলে অনেক আগেই। সেই ধ্রুপদী লাতিন ফুটবল এখন শাংগ্রিলার মতো ইউটোপিয়ান কিছু একটা, বাস্তবে যার অস্তিত্বের কথা ভেবে একটু আত্মপ্রসাদই পাওয়া যায়। অনেক দিন থেকেই সেটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা বা অন্যরা। এবার দেখাল আরও একবার।

    সত্যিটা হচ্ছে, কৌশলের সঙ্গে সৌন্দর্য দক্ষিণ আমেরিকায় আপোস করেছে অনেক অনেক আগেই। এক গোল খেলে দুই গোল দিতে হবে, এমন দর্শনেও আজকাল কারও বিশ্বাস নেই। লাতিন আমেরিকার দলগুলোও কমবেশি সবাই মেনে নিয়েছে, ‘আক্রমণ ম্যাচ জেতায়, কিন্তু ট্রফি জেতায় রক্ষণ’।  এই ব্রাজিলকেই দেখুন, রক্ষণই ছিল তাদের সবচেয়ে বড় শক্তি। দ্বিতীয় রাউন্ড পর্যন্ত চার ম্যাচে যারা মাত্র এক গোল হজম করেছিল, কোয়ার্টার ফাইনালে এসে তারা প্রথমবারের মতো দুই গোল খেল। তার চেয়েও বড় বিস্ময়, তিতে দায়িত্ব নেওয়ার পর এই প্রথম ব্রাজিলের জালে ঢুকেছে দুই গোল। তিতের ব্রাজিল যদি শিরোপা জিতত, সেটা যতটা না আক্রমণের জন্য, তার চেয়েও অনেক বেশি হতো রক্ষণের জন্য।

     

     

    একই কথা অন্যদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। আর্জেন্টিনার রক্ষণ চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, শুধু তিন গোল দিলেই ম্যাচ জেতা যায় না। আর আর্জেন্টিনাও এমন কোনো দৃষ্টিনন্দন ফুটবল খেলতে পারেনি। উরুগুয়ে-কলম্বিয়া অবশ্য সে চেষ্টার ধারেকাছ দিয়েও যায়নি। লাতিন আমেরিকার হয়ে এই দুই দলই অনেক বেশি ইউরোপীয়। দুই দলই শারীরিকভাবে বেশ আগ্রাসী, গোল করার চেয়ে গোল ঠেকানোতেই তাদের মনযোগটা বেশি। উরুগুয়ে গ্রুপ পর্বের একমাত্র দল হিসেবে পরের পর্বে উঠেছিল কোনো গোল না খেয়ে। আর কলম্বিয়া তো গা জোয়ারি ফুটবল খেলে ইংল্যান্ডের কাছ থেকে ইংলিশ স্টাইলেই প্রায় বের করে নিচ্ছিল ম্যাচ। শেষ পর্যন্ত টাইব্রেকারে গিয়েই আটকা পড়তে হয়েছে।

    যদি ‘ধ্রুপদী’ লাতিন ফুটবল বলে কিছু থেকেই থাকে, সেটা এবার খেলেছে পেরুই। প্রথম ম্যাচে গতিময় অলআউট ফুটবল খেলতে গিয়ে হেরে গেছে ডেনমার্কের কাছে, পরের ম্যাচেও ফ্রান্সের সাথে কপাল পুড়েছে। নিজেদের দর্শন থেকে তারা সরে আসেনি বটে, তবে সেটার মূল্য দিতে হয়েছে চড়া।

    ফুটবলের যারা একটু খোঁজখবর রাখেন, একটা তথ্য তাদের কাছে অজানা থাকার কথা নয়। লাতিন আমেরিকার বড় দলগুলোর ফুটবলের সূতিকাগার অনেক আগে থেকেই ইউরোপ। ব্রাজিলে কালকের একাদশের শুধু ফ্যাগনারই খেলেছেন নিজেদের লিগে, বাকিরা সবাই খেলেন ইউরোপের কোনো না কোনো বড় ক্লাবে। আর্জেন্টিনার বরং এবারই স্থানীয় লিগের খেলোয়াড় বেশি ছিল, কিন্তু বাকিদের সঙ্গে তাদের মানের ব্যবধানটা টের পাওয়া গেছে ভালোমতোই। বসম্যান রুলিংয়ের পর ইউরোপিয়ান ক্লাব ফুটবলে ছোটখাটো একটা বিপ্লব যখন হয়ে গেল, আটলান্টিক পেরিয়ে আমেরিকা থেকে ইউরোপে ফুটবলারদের মিছিলও লম্বা হতে শুরু করল। আজকাল তাই ভিনিসিয়াস জুনিয়ররাও ১৭ বছর পার না হতেই ফ্ল্যামেঙ্গো থেকে নাম লিখিয়ে ফেলেন রিয়াল মাদ্রিদে। পেশাদার ক্যারিয়ারের হাতেখড়িও যখন হয়ে যাচ্ছে ইউরোপে, সেখানে লাতিন ফুটবলের ছাপ দেখতে যাওয়াটা কতটুকু যুক্তিযুক্ত?

    এখন আপনি প্রশ্ন করতে পারেন, লাতিন দলগুলো যখন ইউরোপিয়ানদের মতোই খেলছে, তাহলে জাতীয় দলের জার্সিতে ব্যবধান হয়ে যাচ্ছে কীভাবে? ২০০২ সালে ব্রাজিলের পর আর কেউ শিরোপা জিততে পারেনি, ফাইনালে উঠতে পেরেছে কেবল আর্জেন্টিনা, এটা কি শুধুই কাকতাল?

    আপনি হয়তো মনে করিয়ে দিতে পারেন, পেরু ছাড়া সবকটি দলই তো দ্বিতীয় রাউন্ডে উঠেছে। আর্জেন্টিনা না হয় খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে উঠেছে, উরুগুয়ে, ব্রাজিল ও কলম্বিয়া উঠেছে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হিসেবেই। নকআউট পর্বে গিয়ে কেন সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে? ইউরোপের কাছে সেখানে বার বার কেন মার খাচ্ছে আমেরিকা?

    দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তরটা সম্ভবত লুকিয়ে আছে মানসিকতায়। নকআউট পর্বের চাপটাই কি তাহলে বোঝা হয়ে দাঁড়াচ্ছে তাদের ওপর? গত বিশ্বকাপে ব্রাজিল নিজেদের মাঠে জার্মানির কাছে যেভাবে হারল, তা যতটা না ট্যাকটিক্যাল তার চেয়েও অনেক বেশি মানসিক কারণে। তিতের এই দল মানসিকভাবে একটু পরিণত বটে, কিন্তু পিঠ দেয়ালে ঠেকে যাওয়ার পর ঘুরে দাঁড়ানোর সেই খুনে মানসিকতা কই? চাপের মুখেও যেমন টাইব্রেকারে স্নায়ুর পরীক্ষায় ফেল করেছে কলম্বিয়া, আর্জেন্টিনাও পারেনি বড় ম্যাচের চাপ নিতে। তাহলে কি অতি আবেগটাই সর্বনাশ করছে তাদের? মাথা ঠাণ্ডা রেখে নিজেদের কৌশলে কাজ করে যাওয়াটা কি সেজন্যই বার বার ব্যর্থ হয়ে যাচ্ছে?

     

     

    তবে এটা কেবল মুদ্রার একটা পিঠ, মুদ্রার অন্য পিঠটাও এড়িয়ে যাওয়া ঠিক হবে না। ইউরোপের সব দেশ যখন ফুটবলটা আতশ কাচের নিচে দেখছে নিবিড়ভাবে, ফুটবলার তৈরির পদ্ধতিটাও যখন ঢেলে সাজাচ্ছে, লাতিন আমেরিকাকে সেখানে অনেকটুকুই নির্ভর করতে হচ্ছে প্রকৃতিপ্রদত্ত প্রতিভার ওপর। কিন্তু ছাই ওড়াতে ওড়াতে হীরা খুঁজে পাওয়া যতটা কঠিন, ততক্ষণে গুচ্ছের টাকা দিয়ে দোকান দিয়ে হীরের আংটি কিনে ফেলা যায়। ইউরোপের কমবেশি সব দেশ যখন শিশু-কিশোরদের একদম পরিকল্পনা করে ফুটবলার বানাচ্ছে, লাতিন আমেরিকার দেশগুলো পড়ে আছে সেই তিমিরেই।

    আর তরুণ প্রতিভায়ও যে ইউরোপ এগিয়ে যাচ্ছে, ফিফার যুব বিশ্বকাপ থেকেই একটা আঁচ পাওয়া যায়। ১৯৯৩ থেকে ২০১১, এর মধ্যে যুব বিশ্বকাপে বলতে গেলে একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার। দশটি প্রতিযোগিতার আটটিই জিতেছে দুই দল, অন্য দুবার জিতেছে স্পেন ও ঘানা। অথচ সর্বশেষ তিন আসরের একবারও শিরোপা জিততে পারেনি লাতিন আমেরিকার কেউ, ফ্রান্স-সার্বিয়া-ইংল্যান্ড জিতেছে ওই তিন বার। ইউরোপ যে কীভাবে তরতর করে এগিয়ে যাচ্ছে সেটা বলে না দিলেও চলে।

    শিল্প নয়, পরিকল্পনার কাছেই তাই মার খাচ্ছে লাতিন আমেরিকা। ইউরোপের সঙ্গে ব্যবধান হয়ে যাচ্ছে এখানেই।