রাশিয়ার হৃদয় ভেঙে স্বপ্নের সেমিফাইনালে ক্রোয়াটরা
আগের ম্যাচের মতো শেষ পেনাল্টিটা নিতে আসলেন ইভান রাকিটিচ। গোলবারের নিচে পুরো রাশিয়ার প্রত্যাশা নিয়ে দাঁড়িয়েছেন ইগর আকিফেভ, রাশিয়ার অধিনায়ক। স্বপ্ন বাঁচিয়ে রাখতে ঠেকাতেই হবে, আর গোল করলেই রাকিটিচ দলকে নিয়ে যাবেন সেমিফাইনালের। স্বপ্ন আর স্বপ্নভঙ্গের ওই দূরত্বটুকু আগেই নির্ধারণ হয়ে গেছে। নাটকের পর অতিরিক্ত সময়ে খেলা শেষ ২-২ গোলে। রাকিটিচই জিতলেন স্নায়ু যুদ্ধে। গোলরক্ষককে উলটো পাশে পাঠিয়ে বল জড়ালেন জালে। রাশিয়ার হৃদয় ভেঙে, টাইব্রেকারে ৪-৩ ব্যবধানে জিতে ২০ বছর পর আবারও বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে উঠল ক্রোয়েশিয়া।
৯০ মিনিটের খেলা শেষ হয়েছিল ১-১ গোলে। তার আগেই চোট নিয়ে খোঁড়াচ্ছিলেন ক্রোয়েশিয়া গোলরক্ষক ড্যানিয়েল সুবাসিচ। ক্রোয়াট কোচ তাকে রেখেই দিলেন, আরও ৩০ মিনিট খেলালেন। আগের ম্যাচের জয়ের নায়ককে হাতছাড়া করতে চাইলেন না। ১০১ মিনিটে যখন ডমাগো ভিদার গোলে ক্রোয়েশিয়া এগিয়ে গেল, তখন সুবাসিচকে আর দরকার হবে না বলেই মনে হচ্ছিল। কিন্তু রাশিয়ার প্রাণ তাতেও গেল না। রাশিয়া ফিরে আসলো সেখান থেকেও। ১১৫ মিনিটে মারিও ফার্নান্দেজের গোলে সোচির গ্যালারি ছাপিয়ে উৎসব আছড়ে পড়েছিল মস্কো, কাজানে। এরপরই খেলা গড়াই টাইব্রেকারে। সেই সুবাসিচই রাশিয়ার প্রথম শটটা ঠেকালেন, সেটা ফেদোর স্মলভকে পোড়াবে বাকি জীবন। আকিনফেভ ক্রোয়েশিয়ার দ্বিতীয় পেনাল্টিটা দুর্দান্তভাবে ঠেকিয়ে দিয়ে অবশ্য স্বস্তি দিয়েছিলেন স্মলভকে। কিন্তু ফার্নান্দেজ ভূপাতিত হলেন নিমিষেই। একটু আগেই যিনি গোল করেছিলেন, তিনিই পেনাল্টিটা মারলেন বাইরে দিয়ে, অদ্ভুত এক মিস! স্নায়ুর যুদ্ধে অবশ্য দোষ চাপানোটা অমানবিকই হয়ে যায়, লুকা মদ্রিচই তো আরেকটু হলে ফার্নান্দেজের দলেই যোগ দিতে পারতেন। আকিনফেভ ঠেকিয়েও দিয়েছিলেন তার নেওয়া স্পটকিক। কিন্তু ভাগ্যপরীক্ষা তো শুধু আর নামেই নয়, কাজেও। সেই বল লাগল ডান পাশের বারপোস্টে, বেরিয়ে যেতে যেতে ঢুকেও পড়ল আকিনফেভের জালে। আক্ষেপ আর আনন্দ। টাইব্রেকার ম্যাচটার নাটকীয়তাকে দিল পূর্ণতা।
ঘরের মাঠে গ্যালারির সমর্থনটা যেমন হওয়ার কথা আজ যেন তার চেয়েও বেশি পেল রাশিয়া। দেশের মানুষের প্রত্যাশা ছাপিয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে ওঠা দলটার তো প্রাপ্যই ছিল সেটা। ডেনিস চেরিশেভের দারুণ এক গোলে এগিয়ে যাওয়ার পর স্বপ্নের পালে লাগল হাওয়া। ৩১ মিনিটে আক্রমণটা শুরু করেছিলেন চেরিশেভই, আরতেম যুবার সঙ্গে ওয়ান টু করে ডিবক্সের সামনে গিয়ে নিলেন শট, টপ কর্নারে জড়ালো বল। সুবাসিচ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলেন শুধু। রাশিয়া বিভোর সেমিফাইনালের স্বপ্নে। ম্যাচের প্রথম শট অন টার্গেটেই গোল আসলো, সেটা রাশিয়ার।
এর আগে ক্রোয়েশিয়ার শুরুটা অনুমিতভাবেই ভালো ছিল। রাকিটিচ শুরুতেই পরীক্ষা নিয়েছিলেন আকিনফেভের। রাইটব্যাক ভ্রাসালকো ছিলেন বেশিরভাগ আক্রমণের উৎস। তার দুইটি ক্রস দুইবার ডিবক্সের ভেতর ভালো জায়গায় খুঁজে পেয়েছিল মারিও মাঞ্জুকিচ আর ইভান পেরিসিচকে। দুইজনের কেউই কাজে লাগাতে পারেননি। তাই চেরিশেভেই মলিন হয়ে গেল ক্রোয়েশিয়া। কিন্তু গোল হজমের পর প্রথমার্ধেই ম্যাচে ফিরল তারা। আগের ম্যাচে পিছিয়ে পড়ার পর ক্রোয়াটরা সময় নিয়েছিল ৩ মিনিট, আজ নিল ৮ মিনিট। মাঞ্জুকিচের ক্রস থেকে হেডে গোল করে আন্দ্রে ক্রামারিচ দলকে ফিরিয়ে আনলেন ম্যাচে।
রাশিয়া পায়ে বল ছাড়াই বেশি স্বাছন্দ্যে ছিল। ক্রোয়েশিয়া বল পায়ে। দ্বিতীয়ার্ধেও খেলা চললো একই তালে। ঘন্টা পেরুতেই রাশিয়া পিছিয়ে পড়তে পারত। ভাগ্যও রাশিয়ানদের সহায় হলো সে দফায়। বক্সের ভেতর ক্রামারিচের এলোমেলো শট পড়ল পেরিসিচের পায়ে। এমন এক জায়গায় বল পেলেন, সেখান থেকে গোল না করাই কঠিন। মারলেনও, তখনই একবার রাশিয়ানদের হৃদকম্পন থেমে গিয়েছিল। কিন্তু পেরিসিচের শট লাগলো বারপোস্টে, ফেরত আসলো গোললাইন ঘেঁষে, হৃদকম্পন স্বাভাবিক হওয়ার পর রাশিয়ানরা পেল মুক্তির আনন্দ।
বাকি আধঘন্টায় ক্রোয়েশিয়াই আক্রমণে উঠলো বেশি। কিন্তু সেরা সুযোগটা পেলেন স্মলভ। ৭২ মিনিটে ফার্নান্দেজের ক্রস থেকে হেডটাই ঠিকঠাক করতে পারলেন না। মিনিট চারেক পর সব শক্তি দিয়ে আবার আক্রমণে ক্রোয়েশিয়া, মদ্রিচ, ভ্রাসালকোরা সবাই চেষ্টা করলেন ডিবক্সের ভেতর থেকে, রাশিয়ার রক্ষণই জয় করা হলো না কেবল।
অতিরিক্ত সময়ের আগেই সুবাসিচকে হারানোর শঙ্কা ভর করেছিল ক্রোয়াটদের। অতিরিক্ত সময়ের আগেই তাই কয়েকবার রাশিয়াও শট চালালো দূর থেকে। কিন্তু সুবাসিচ দলের জন্য থাকলেন শুভাশীষ হয়ে। ৯৯ মিনিটে লভ্রেনের একটা ভুলও তাই শাস্তি না পেয়েই পার হলো স্মলভের পা থেকে। এর দুই মিনিট পরই মদ্রিচের কর্নার থেকে ভিদার গোল। জার্সিই খুলে ফেলেছিলেন তখন ক্রোয়াট ডিফেন্ডার, কিন্তু নাটকের শেষ যে তখনও হয়নি সেটা বুঝেছেন পরে। যদিও ম্যাচ শেষে ভিদাই শেষ হাসি এসেছেন। আর রাশিয়ানরা লড়াইয়ে করেই রাশিয়ানদের শঙ্কা তো দূর করেছেনই, ভালোবাসাও কুড়িয়েছেন।
প্রথমবার বিশ্বকাপ খেলতে এসেই ক্রোয়াশিয়া চমকে দিয়েছিল বিশ্বকে। ১৯৯৮ এর মতো আবারও সেমিফাইনালে তারা। এবার প্রতিপক্ষ ইংল্যান্ড। সেবার স্বাগতিকদের কাছে হার মেনেই শেষ হয়েছিল ডেভর সুকারদের স্বপ্নযাত্রা। ক্রোয়াটদের "দ্বিতীয় সোনালী প্রজন্ম" এবার সবকিছুর বিরুদ্ধে গিয়ে সেই স্বাগতিকদেরই হারালো। ফাইনালের আগে প্রতিপক্ষ ইংল্যান্ড, ক্রোয়েশিয়া কি পারবে?