• রাশিয়া বিশ্বকাপ ২০১৮
  • " />

     

    যে কারণে পারল না তিতের ব্রাজিল

    যে কারণে পারল না তিতের ব্রাজিল    

    বিশ্বকাপ সেমিফাইনালের চার দল নির্ধারণ হয়ে গেছে। জার্মানি আগেই বাদ পড়েছে, আর্জেন্টিনা ছিল অগোছালো। কিন্তু ব্রাজিলকে নিয়ে সন্দেহ করার লোক খুঁজে পাওয়াই ছিল দায়। কিন্তু বাকি প্রায় সব বড় দলের মতোই ব্রাজিলও হেঁটেছে উলটো পথে। পুরো টুর্নামেন্টে আশা জাগিয়েও কেন এমন অসহায়ের মতো ভেঙে পড়েছিল ব্রাজিল? লড়াই করে ফিরে আসতেও কি দেরি করে ফেলেছিল? ব্রাজিলের হারের কারণগুলো খুঁজে দেখা যাক।



    শুধুমাত্র নিজেদের গ্রুপের বাকি দলগুলো নয়, তিতের ব্রাজিল ‘পড়াশুনা’ করে এসেছিল বাকি ৩১ দেশের ফুটবল নিয়ে। অমন প্রস্তুতি নিয়ে বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনাল থেকেই বিদায় নেওয়াটা ব্যর্থতাই বটে। বিশেষ করে দেশটার নাম যখন ব্রাজিল, তখন শিরোপাই তো শেষ কথা।

    রাশিয়ায় ব্রাজিল এসেছিল সেই স্বপ্ন সঙ্গে করে নিয়ে। শুরুতেই অবশ্য একটা ধাক্কা খেয়েছিল সেলেসাওরা, সুইজারল্যান্ডের বিপক্ষে ড্র করে। কিন্তু দ্বিতীয় ম্যাচেই দেখা মিলল পুরনো ব্রাজিলের। আক্রমণ যাদের মূল শক্তি, রক্ষণ দুর্গ। কোস্টারিকার বিপক্ষে ওই ম্যাচটাই ছন্দে তুলে দিয়ে গেল ব্রাজিলকে, পরের ম্যাচে ব্রাজিল আরও ভয়ঙ্কর। সার্বিয়ার বিপক্ষে গ্রুপের শেষ ম্যাচের পর ব্রাজিলকেই মনে হলো বিশ্বকাপের সবচেয়ে গোছানো দলটা। প্রমাণ মিলল মেক্সিকোর বিপক্ষে দ্বিতীয় রাউন্ডের ম্যাচে। মেক্সিকোর রক্ষণকে ঠিকই ভোগালো ব্রাজিলের আক্রমণভাগ। শুরু থেকে অবশ্য মেক্সিকো ভীতি ছড়িয়েছিল ব্রাজিলের রক্ষণে। কিন্তু থিয়াগো সিলভা, মিরান্ডার ভরসা যুগিয়েছিল, সেটাই আশা জাগিয়েছিল ব্রাজিলকে, বেলজিয়ামের বিপক্ষে। এই দলের ভারসাম্য তো দারুণ!

     

     

    কিন্তু ব্রাজিল আসলে হারলো প্রতিপক্ষের কৌশলের কাছে। সেটা যত না ব্রাজিল, তার চেয়ে বেশি হারলেন তিতে। ৩১ দলকে পাঠ্যবইয়ের মতো পড়ালেন শিষ্যদের, কিন্তু কঠিন পরীক্ষার আগে বাস্তবতার চেয়ে বিশ্বাসের পাল্লা ভারী করে সিদ্ধান্ত নিলেন। বেলজিয়াম কোচ রবার্তো মার্টিনেজ কৌশল বদলে ৪ জনের ব্যাকলাইন নামালেন। খেললেন ৪-৩-৩। বিশ্বকাপ জিততে হলে শুধুমাত্র নিজেদের খেলা খেললেই যথেষ্ট হয় না, একটা সময়ে প্রতিপক্ষকে আটকানোর কৌশলও খুঁজে বের করতে হয়। সেই ম্যাচটাই ছিল বেলজিয়ামের বিপক্ষে। সেটাতেই হেরে বসেছে ব্রাজিল।

    সার্বিয়ার সঙ্গে ম্যাচের পর মার্সেলো ইনজুরি নিয়ে মাঠ ছেড়েছিলেন। এরপর ফিলিপে লুইজ তার অভাবটা বুঝতে দেননি। শেষ ষোলর ম্যাচে মেক্সিকো যখন দারুণ শুরু করেছিল, তখন বাকি সেন্টারব্যাকদের সঙ্গে কাঁধ মিলিয়ে লুইজই রক্ষণে দুর্গ হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। মার্সেলোর খেলার ধরন জানা। তিনি লেফটব্যাক হলেও, আক্রমণেই মনোযোগি বেশি। বেলজিয়াম যখন কৌশল বদলে রোমেলু লুকাকুকে রাইট উইংয়ে ঠেলে দিল তখন মার্সেলোর সমস্যাটা ধরা পড়ল আরেকবার। সেটা ব্রাজিল হোক, রিয়াল মাদ্রিদ হোক দুই দলেই আক্রমণেই প্রাণের সঞ্চার করেন মার্সেলো। কিন্তু রক্ষণের ভুলগুলো ক্লাবের দুই লেগের খেলায় শোধরানোর সুযোগ থাকলেও, বিশ্বকাপে তো সেটি নেই। প্রথমার্ধে যতবার লুকাকু ডান প্রান্ত দিয়ে দৌড়েছেন, মার্সেলোকে খুঁজেই পাওয়া গেল না। আর এতোদিন রক্ষণে দুর্গ হয়ে থাকা সিলভা আর মিরান্ডারা পড়ে গেলেন ধন্ধে। লুকাকুকে আটকাতে গিয়ে বারবার খালি জায়গা ফেলে আসলেন গোলরক্ষক অ্যালিসনের সামনে।

    এক মুহুর্তের ভুলে বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে পড়তে হয়, ব্রাজিল অবশ্য প্রথমার্ধে সেই তুলনায় নিজদের ভাগ্যবানই ভাবতে পারে। প্রতি-আক্রমণে বেলজিয়াম আরও দু'-একটি গোল করে বসলে লড়াইয়ের মানসিকতাটাও হয়ত বাকি থাকত না ব্রাজিলের। যে দলের আক্রমণভাগে লুকাকু, হ্যাজার্ড, ডি ব্রুইনদের মতো বিধ্বংসী খেলোয়াড়েরা খেলেন, তাদেরকে কি একটু ছোট করেই দেখেছিলেন তিতে? আরেকটু সাবধানী হলেই কি ভুলটা হত না? বেলজিয়ামের বিপক্ষে আলাদা কোনো কৌশল ছিল তার? সেটা থাকবেই না বা কেন?

    তিতে একজন দার্শনিকও বটে। এই বয়সেও কোচিং থেকে বছর খানেকের ছুটি নিয়েছিলেন। ফুটবল সম্পর্কে তার জ্ঞানটা আরও বাড়িয়ে নিতে। বেশিরভাগ সময় কাটিয়েছেন ইউরোপেই। বেলজিয়ামের বিপক্ষে ম্যাচের আগে বারবার বলেছেন, “সময়মত মাথা ঠান্ডা রাখাটাই সবচেয়ে বড় কাজ।” কিন্তু দলের মানসিকতায় বোধ হয় সেই মন্ত্র সঞ্চার করাতে পারেননি। বেলজিয়ামের বিপক্ষে ব্রাজিল তাদের নিজস্ব রূপে ফিরতে একটু বেশিই দেরি করে ফেলল। দুই গোল হজমের পর খেলোয়াড়দের চোখে মুখে অবিশ্বাস, চাপে ভেঙে পড়েছিলেন, সেটা চেহারা দেখে না বোঝার কারণ নেই। গত বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে জার্মানির বিপক্ষে বিপর্যয়ের পর দলের দরকার ছিল একটা মানসিক পরিবর্তন। ব্রাজিলের প্রথমার্ধের খেলায় সেই পরিবর্তন দেখা গেল কই?

    ব্রাজিল বেলজিয়ামকে নিয়ে যদি পড়াশুনা করে থাকে, তাহলে বেলজিয়াম ব্রাজিলকে নিয়ে চালিয়েছে গবেষণা। আর সেখানেই হেরেছে ব্রাজিল। সিলভা, মিরান্ডা, মার্সেলোরা একেকদিন একেকজন পরেন অধিনায়কের আর্মব্যান্ড। দলকে নেতৃত্ব দেওয়ার মতো খেলোয়াড় বেশ কয়েকজন। কিন্তু ভঙ্গুর সময়ে আসলে দলকে নেতৃত্ব দিলেন কে? প্রতি ম্যাচে অধিনায়ক বদলের সেই দর্শনটা তিতের ভুল প্রমাণিত হলো বিশ্বকাপে এসে।

    দুই গোলে পিছিয়ে পড়ার পর অবশ্য ব্রাজিলের সামনে আর গতিও ছিল না। মার্সেলো-নেইমার-কৌতিনহোরা মিলে যথেষ্ট সুযোগ তৈরি করেছেন। কিন্তু বিশ্বকাপে প্রথমার্ধে দুই গোলে পিছিয়ে পড়েও ম্যাচ জয়ের রেকর্ড নেই, ইতিহাস নতুন করে লেখাও হয়নি ব্রাজিলের। ঘুমটা ভাঙতে দেরি হওয়াতেই কি মাশুল গুণতে হল? গ্যাব্রিয়েল হেসুস হতাশ করেছেন। প্রথম ৪ ম্যাচের একটিতেও গোল পাননি ব্রাজিলের নাম্বার নাইন। অবিশ্বাস্য! রবার্তো ফিরমিনো যতবার নেমেছেন, ব্রাজিলের আক্রমণ তাতে আরও ভয়ঙ্কর হয়েছে। বিশেষ করে জমাট বাঁধা রক্ষণ ভাঙতে তার জুড়ি নেই। সেই প্রমাণ রেখেছেন বেলজিয়ামের বিপক্ষের ম্যাচেও। তার তৈরি করা ফাঁকা জায়গায় ঢুকেই রেনেটো আগুস্তো গোলটা করেছিলেন। প্রমাণটা ফিরমিনো আগেই করেছিলেন। ভুরি ভুরি সুযোগ পেয়েও কাজে লাগাতে না পারলেও তিতে ভরসা রাখলেন সেই হেসুসের ওপরই। ভরসাটা হয়ত কোনো কোনো পর্যায়ে গোয়ার্তুমিতেও পরিণত হল।

    বদলি হয়ে নামার পর ডগলাস কস্তাও গতি বাড়িয়েছিলেন ব্রাজিলের আক্রমণে। কিন্তু তিনিও ভুল করলেন একটা। বেলজিয়াম তাদের রক্ষণের দুই প্রান্ত প্রায় ছেড়েই দিয়েছিল। লক্ষ্য ছিল, মাঝ বরাবর ব্রাজিলের কৌতিনহো, নেইমারদের আটকে দেবে তারা। কস্তাকেও ডান প্রান্ত দিয়ে ক্রস করার চেয়ে বরং কাট করে ভেতরে ঢোকার দিকেই আগ্রহী মনে হলো বেশি। ব্রাজিল আর ব্রাজিলের খেলোয়াড়েরা নিজেদের ধাঁচেই খেলতে চাইল, অবস্থাভেদে কৌশল বদলেও খেলার যোগ্যতা তাদের আছে সেটা তারা বিশ্বাস করতে চাইল না। মাঠে একজন নেতার অভাব এখানেই আরেকবার স্পষ্ট হল। কস্তাকে ওয়াইড স্পেস কাজে লাগানোর পরামর্শটা কি কেউ সময়মত দিয়েছিলেন?

     

     

    নেইমারকে নিয়ে এই বিশ্বকাপে অনেক কথা! সেটা তার পায়ের জাদুকেও ছাপিয়ে গেল। ব্রাজিলের জয়ে যে তার বড় অবদান ছিল - সেটাও অনেককে ভুলিয়ে দিতে বাধ্য করল। অখেলোয়াড়সুলভ এই আচরণের দায়ভারও কেউ নিলেন না, ব্রাজিল দলের কেউ তাকে অভ্যাস বদলানোর পরামর্শও দিলেন না। হাস্যকর কারণে শিরোনাম হওয়া আর যাই হোক নেইমারের প্রাপ্য ছিল না। একজন নেতার অভাব সত্যিই খুব ভুগিয়েছে ব্রাজিলকে। দলটাকে যত বেশি ভারসাম্যপূর্ণ মনে হয়, আসল সময় ঠিক ততোটাই ছন্নছাড়া দেখাল।

    খেলোয়াড়ের ওপর, নিজের কৌশলের ওপর ভরসা রাখা দোষের কিছু নয়। কিন্তু তিতে আসলে হাল ধরেছিলেন একটা এলোমেলো দলের। সেই দলটাকেই এই পর্যন্ত এনেছেন, যাদেরকে দেখে আবারও বিশ্বকাপের স্বপ্ন দেখতে পেরেছিল ব্রাজিল সমর্থকেরা। দক্ষিণ আমেরিকার বাছাইপর্বে তাদের তেমন পরীক্ষা দিতে হয়নি। যাদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার কথা ছিল, সেই আর্জেন্টিনা উরুগুয়ের বেহাল দশা ব্রাজিলকে আরও শক্তিশালী বানিয়ে দিল। নিজের কৌশলে বিশ্বাস রাখার আগে সেটাকে ঝালাই দিয়ে পরখ করে নিতে হয়। সেই সুযোগটাও তিতের হয়নি। কিন্তু এই ভুল ঢাকতে গিয়ে আরেকটা ভুল করে বসলে ব্রাজিলের ফুটবলকে আবারও শূন্য থেকেই শুরু করতে হতে পারে। তিতেকে বরখাস্ত করা হলে সেটা বুমেরাং হওয়ার সুযোগই বেশি। বিশ্বকাপে নিজের দলটা অন্তত ঝালাই করার সুযোগ পেয়েছেন। তাতে বিশ্বাসে একটা ধাক্কা খেয়েছে, পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী। কারণ তিনি তো পরিবর্তনেও বিশ্বাসী! তিতের হাতেই তাই থাকুক ব্রাজিল দল, আরেকটা সুযোগ তার পাওনাই হয়ে গেছে। এবার বিশ্বাসটা বরং তার ওপরই করুক ব্রাজিলিয়ানরা।