বেলজিয়ামকে হারিয়ে এক যুগ পর বিশ্বকাপের ফাইনালে ফ্রান্স
ম্যাচের আগে নিশ্চয় ছক কষেছেন, কাকে কোন কৌশলে খেলাবেন এই নিয়ে নির্ঘুম রাত গেছে দুই কোচের। বিশ্বকাপ সেমিফাইনাল। এমন ম্যাচের আগে এসব তো সাধারণ ঘটনা। সেই ম্যাচের ফল নির্ধারণ হলো একটা কর্নার থেকে, একটা হেডে। এই দৃশ্যটাও এমন ম্যাচে অনিয়মিত নয়! ৫১ মিনিটে অলিভিয়ের জিরু একটা শট নিয়েছিলেন। সেই শটের দিক দারুণভাবে পরিবর্তন করে দিয়েছিলেন ভিনসেন্ট কোম্পানি। কর্নার, ফ্রান্স। কর্নার নিলেন আঁতোয়া গ্রিযমান, লাফিয়ে উঠলেন স্যামুয়েল উমতিতি। হেড, গোল! সেন্ট পিটার্সবার্গে তখন ফিরে আসলো প্যারিসও। ১৯৯৮ বিশ্বকাপের সেমিফাইনালটাও তো জিতিয়েছিলেন এক ডিফেন্ডারই, লিলিয়ান থুরাম। এবার উমতিতির, ওই একটা গোলই যথেষ্ট হলো । বেলজিয়ামকে ১-০ ব্যবধানে হারিয়ে এক যুগ পর আবারও বিশ্বকাপের ফাইনালে উঠে গেল ফ্রান্স।
সেন্টপিটার্সবার্গে বেলজিয়াম-ফ্রান্সের ম্যাচে যারা ভুরি ভুরি গোল আশা করেছিলেন তারা হতাশই হয়েছেন শেষ পর্যন্ত। হতাশ হয়েছে আসলে বেলজিয়ামও। এবারের আসরের সবচেয়ে বেশি গোল করেছে তারাই, আজ একটা গোল দিতে পারলে হয়ত গল্পটা আলাদাও হতে পারত। সেটাই পারল না রেড ডেভিলরা। কৃতিত্বটা অবশ্য পুরোপুরি ফ্রান্সের। এক গোল দেওয়ার পর যেভাবে খেলার নিয়ন্ত্রণ নিয়েছিল দিদিয়ের দেশমের দল সেটার প্রাপ্য ফলটাই পেয়েছে তারা।
ম্যাচের শুরুটা অবশ্য রোমাঞ্চকর ছিল বেলজিয়ামের জন্য। ব্রাজিলকে হারানোর স্মৃতিটা যে তরতাজা সেটা বোঝাও যাচ্ছিল শুরুতে। ডানদিক দিয়ে এডেন হ্যাজার্ড শুরু থেকেই ভীতি ছড়াচ্ছিলেন ফ্রান্সের রক্ষণে। অন্যপ্রান্তে অবশ্য কিলিয়ান এমবাপ্পেও ইঙ্গিত দিয়ে রেখেছিলেন বেলজিয়ামের ডিফেন্ডারদের। একেবারে শুরুর মিনিটেই তো দৌড়ে ঢুকে পড়েছিলেন তাদের ডেরায়, এরপর ১২ মিনিটে আরেকবার। সেগুলো অবশ্য ভালোভাবেই সামাল দিয়েছিলেন ইয়ান ভের্টোনহেনরা।
গোল লক্ষ্য করে প্রথম শটটাও নিয়েছিলেন হ্যাজার্ডই। ডিবক্সের ভেতর কোণাকুণি জায়গা থেকে শট করেছিলেন, কিন্তু লক্ষ্য মিস করেছে তার ১৩ মিনিটের ওই চেষ্টা। মিনিট পাঁচেক পর প্রায় একইরকম জায়গা থেকে আবারও মারলেন, এবার উড়িয়ে মেরেছিলেন, লক্ষ্যও ছিল ঠিক। রাফায়েল ভারান আলতো এক হেড করলেন, গোলের পরিবর্তে হ্যাজার্ড পেলেন কর্নার। মিনিট দুই পরে পাওয়া আরেক কর্নার থেকেই অবশ্য গোলটা পেয়ে যেতে পারত বেলজিয়ামই। কিন্তু উগো লরিস সেটা হতে দেননি। টবি অ্যাল্ডারওয়াইরেল্ড বাঁ পায়ে শট করেছিলেন, বাঁ দিকে ঝাঁপিয়েই দুর্দান্তে সেভে সে শট আর গোলে পরিণত হতে দেননি লরিস। ম্যাচ শেষে উমতিতিকে দেখে নিশ্চয়ই আফসোস করেছেন অ্যাল্ডারওয়াইরেল্ড। নায়কটা তো তিনিও হতে পারতেন!
কিছুক্ষণ পর হ্যাজার্ডের সঙ্গে আক্রমণে যোগ দিয়ে কেভিন ডি ব্রুইনও ভালো একটা ক্রস করলেন। ফ্রান্সের রক্ষণটা সম্ভবত এই বিশ্বকাপের সেরা। এবার সেটা প্রমাণ করলেন ভারানের ডিফেন্সিভ পার্টনার উমতিতি। সময়মতো ব্লক করলেন সেই ক্রস। ম্যাচে বেলজিয়ামের একচ্ছত্র আধিপত্য ওই পর্যন্তই। থমাস মুনিয়ের না থাকায়, দলে কয়েকটা পরিবর্তন এনেছিলেন বেলজিয়ান কোচ। তার প্রভাব প্রথমার্ধে বোঝা যায়নি তেমন। তবে প্রথমার্ধের মাঝামাঝি সময় পেরুনোর পরই বেলজিয়াম রঙ হারাতে শুরু করলো একটু একটু করে। আর দারুণভাবে ম্যাচে ফিরে আসলো ফ্রান্সও। এমবাপ্পে, জিরুর বোঝাপড়া ভালো হলে প্রথমার্ধে আরও কিছু সুযোগ তৈরি করতে পারত লা ব্লুজরা। সেটা হয়নি, তাই ৪০ মিনিটে বেঞ্জামিন পাভার্দের শটটাই হয়ে থেকে প্রথমার্ধে ফ্রান্সের সেরা সুযোগ। যদিও পাভার্দকে আর সেটা নিয়ে হাপিত্যেশ করতে হয়নি শেষে। কিন্তু কোর্তোয়া কিছুটা তৃপ্তি খুঁজতেই পারেন, পাভার্দের শটে তার সেভটাও তো দারুণ ছিল। লরিসের মতো তিনিও দলের জয়ের জন্য সবচেষ্টাই তো করে রেখেছিলেন।
বিরতি শেষ হওয়ার ৫ মিনিট পরই ওই গোল। উমতিতিকে ঠেকাতে লাফ দিয়েছিলেন মারুয়ন ফেলাইনি, আটকাতে পারেননি, উলটো তার চুলের গোছাও ছুঁয়ে গেছে উমতিতির হেডে করা বল, পরে জড়িয়েছে জালে। সেটা নিয়ে আক্ষেপ থাকতে পারে ফেলাইনির, তবে আরও বড় আক্ষেপ সঙ্গী হয়েছে তার। ড্রিস মার্টেনস নামার পর আক্রমণে ধার বেড়েছিল বেলজিয়ামের। সেটা অবশ্য অল্প সময়ের জন্যই। কিন্তু ওই সময়েই একটা গোল আদায় করে নিতে পারত তারা। বেশ কয়েকটি ভালো ক্রস করেছিলেন মার্টেনস, তার একটা ৬৬ মিনিটে ফেলাইনি জায়গামতোও পেয়েছিলেন, কিন্তু লক্ষ্যভেদ করা হয়নি আজ।
বেলজিয়ামের সর্বোচ্চ গোলদাতা রোমেলু লুকাকুর রাতটা গেছে ভুলে যাওয়ার মতো। গোলে কোন শটই নিতে পারেননি তিনি। সুযোগ যা পেয়েছিলেন, অন্যদিন হলে হয়ত সেগুলো থেকেই দারুণ কিছু করে দেখাতে পারতেন। ডি ব্রুইনও দ্বিতীয়ার্ধে হারিয়ে ফেলেছিলেন নিজেকে, ৬০ মিনিটে ডিবক্সের ভেতর পাওয়া বলে ভলিটা না হয় মিস হয় না তার!
এক গোলে পিছিয়ে পড়ার পর বেলজিয়ামের তাই মরণ কামড় দেওয়ার সুযোগ হয়নি। দিদিয়ের দেশম কৌশল দিয়েই আটকে দিয়েছেন রবার্তো মার্টিনেজকে। বেলজিয়ামের স্প্যানিশ কোচকে তিনি আটকে দিয়েছেন আরেকটা জায়গাতেও। ভিনদেশী কোচ হয়ে বিশ্বকাপ জেতার রেকর্ড নেই কারও, সেটা হলো না এবারও। বেলজিয়ামের সোনালী প্রজন্মের দৌড় থামল সেমিফাইনালেই, ১৯৮৬ এর মতো। আর দিদিয়ের দেশম নিজের জন্য একটা রাস্তা খুলেছেন তাতে। ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ার, মারিও জাগালোর পর খেলোয়াড় আর কোচ হিসেবে বিশ্বকাপ জয়ের খুব কাছাকাছি চলে গেলেন তিনি। দুই বছর আগে ঘরের মাঠে ইউরো হারের স্মৃতিটা এখনও তাজা ফ্রান্সে। সেটা ভুলিয়ে দিতে পারবেন তো?
বেলজিয়াম একাদশ
কোর্তোয়া, অ্যাল্ডারওয়াইরেল্ড, কোম্পানি, ভেট্রোনহেন, ডেম্বেলে, উইটসেল, ডি ব্রুইন, ফেলাইনি, চাডলি, হ্যাজার্ড, লুকাকু
ফ্রান্স একাদশ
লরিস, পাভার্দ, ভারান, উমতিতি, হার্নান্দেজ, কান্তে, তোলিসো, পগবা, গ্রিযমান, জিরু, এমবাপ্পে