• রাশিয়া বিশ্বকাপ ২০১৮
  • " />

     

    ইংল্যান্ডকে বাড়ি পাঠিয়ে স্বপ্নের ফাইনালে ক্রোয়েশিয়া

    ইংল্যান্ডকে বাড়ি পাঠিয়ে স্বপ্নের ফাইনালে ক্রোয়েশিয়া    

    ইংল্যান্ড যখন শেষ সেমিফাইনাল খেলেছে, ক্রোয়েশিয়ার দেশ হিসেবে তখন জন্মই হয়নি। সেই ক্রোয়েশিয়ারও এতোদিন ধরে বিশ্বকাপে সেরা সাফল্য ছিল ওই একটা সেমিফাইনাল, ওই ১৯৯৮ সালের সেমিফাইনাল। এরপর আর গ্রুপ-পর্বই পেরুনো হয়নি তাদের। আর ইংল্যান্ড প্রতিবার আশার বেলুন নিয়ে এসে চুপসে ফিরে গেছে আগেভাগেই। এই রাশিয়া বিশ্বকাপ দুই দলের সেসব ঘটনাকে অতীত বানিয়ে দিল আজ। ক্রোয়েশিয়ার সোনালী প্রজন্ম তাদেরকে অনেক বড় কিছুর স্বপ্ন দেখিয়েছে ধীরে ধীরে, ধাপে ধাপে। আর ইংল্যান্ড টাইব্রেকার-জুজু কাটিয়ে স্বপ্ন দেখিয়েছে যেন হুট করেই! সেই দুই স্বপ্নের মিলল আজ, লুঝনিকিতে। দারুণ এক চিত্রকর্মে তুলির শেষ আঁচড়টা বাকি রাখলো ক্রোয়েশিয়া। আর হঠাৎ মাস্টারপিস হয়ে উঠতে বসা এক চিত্রকর্ম ইংল্যান্ডের চোখের সামনেই যেন নষ্ট হয়ে গেল বাড়তি রঙ পড়ে। 



    মস্কোতে পিছিয়ে থেকেও ফিরে এসে অতিরিক্ত সময়ের গোলে জিতে প্রথমবারের মতো স্বপ্নের বিশ্বকাপ ফাইনালে পৌঁছে গেছে ক্রোয়েশিয়া। আর ইংল্যান্ড শুধু তাদের সমর্থকদের জন্য রাখছে সেমিফাইনাল খেলার গর্ব, যে দলকে নিয়ে প্রত্যাশা শূন্য ছিল, সেই প্রত্যাশাটা নতুন করে ফিরিয়ে আনার গর্বটা।  

    আগের দুই ম্যাচ টাইব্রেকারে জিতে এসেছে ক্রোয়েশিয়া, এ ম্যাচও গড়ালো অতিরিক্ত সময়ে। টাইব্রেকারে জিতেছে ইংল্যান্ডও। যে চারটি ম্যাচ অতিরিক্ত সময়ে গেছে এ বিশ্বকাপে, তার তিনটিতেই ছিল এই দুই দল। এবার তারা মুখোমুখি। 

    সেই অতিরিক্ত সময়ের প্রথমার্ধেরই যোগ করা সময়ে ক্রোয়েশিয়াকে স্বপ্নের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে পারতেন মারিও মানজুকিচ। ১-১ গোলে সমতা তখন, ইভান পেরিসিচের বাড়ানো ক্রসে পা বাড়িয়েছিলেন মানজুকিচ। জর্ডান পিকফোর্ড যেন হয়ে দাঁড়ালেন অভেদ্য এক দেয়াল, যে দেয়াল আবার এগিয়ে আসে! সে দেয়ালেই আটকে গেলেন মানজুকিচ, আটকে গেল ক্রোয়েশিয়া, অন্তত তখন পর্যন্ত। মানজুকিচের আগে, পেরিসিচের জন্য দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়েছিল গোলবারের পোস্ট। ৭২ মিনিটে হঠাৎ এলোমেলো হয়ে পড়া ইংলিশ রক্ষণকে অনেক বড় মাশুল গুণতে হয়েছিল প্রায়, পেরিসিচের শট ফিরে এলো পোস্টে লেগে। ইংল্যান্ড সে যাত্রায় বেঁচেছিল। পিকফোর্ড আর পোস্ট বাঁচিয়ে দিয়েছিল তাদের। 

    ১০৯ মিনিটে গিয়ে অপমৃত্যু ঘটেছে ইংলিশ স্বপ্নের। সে সমাধির পাশে দাঁড়িয়ে নতুন এক ফুলের সুবাস ছড়িয়েছেন মানজুকিচ, ক্রোয়েশিয়ার ফুটবল-বাগানে। ট্রিপিয়েরের কাছে একটা হেড জিতেছিলেন পেরিসিচ, সেটাই এসে পড়েছিল মানজুকিচের সামনে। তাকে মার্ক করার দায়িত্বে থাকা স্টোনস যেন পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেন, পিকফোর্ডের দেয়াল, পোস্টের চোখ-রাঙানি কাটিয়ে মানজুকিচের পা ছোঁয়া বল চলে গেল ক্রোয়াট স্বপ্নের সপ্তম স্বর্গে। সপ্তম না হলেও অন্তত ষষ্ঠ স্বর্গে তো বটেই! অথচ এই মানজুকিচ খোঁড়াচ্ছিলেন, ফিজিও এতো স্প্রে করলেন, তা দিয়ে যেন রাশিয়ার সব পোকা ভয় পেয়ে যাবে! সেই পায়েই ভর করলো ক্রোয়েশিয়ার স্বপ্ন!  

    এর আগে ৬৮ মিনিট পর্যন্ত বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে পিছিয়ে থেকেও ক্রোয়েশিয়াকে পঞ্চম স্বর্গে এনেছিলেন পেরিসিচ। স্বর্গই ছুঁয়েছিল বটে তার পা। এমন গোলের পর আপনি ধন্দে পড়ে যেতে পারেন, আদতে গোলটা কিসে হয়েছে, পায়ে না মাথায়? ভ্রাসালকোর ক্রসের নাগাল পেতে পেরিসিচ ছুটে এসেছিলেন ট্রিপিয়েরের পেছন থেকে, কাইল ওয়াকারের সামনে। হঠাৎ করেই পেরিসিচ তুলে ধরলেন পা, বলপানে, গোলপানে, স্বর্গপানে! 


    ক্রোয়েশিয়া পেল প্রথমার্ধের বিবর্ণ ফুটবল ভুলে দ্বিতীয়ার্ধ থেকেই আক্রমণে মশগুল থাকার সুফল। ম্যাচের পাঁচ মিনিটেই পিছিয়ে পড়ে যেন খেই হারিয়ে ফেলেছিল ক্রোয়েশিয়া। 

    সেই পাঁচ মিনিটে ইংল্যান্ডকে স্বপ্নালু শুরু এনে দিয়েছিলেন কিয়েরন ট্রিপিয়ের। তার ফ্রি-কিকে লাফিয়ে উঠলো ক্রোয়েশিয়ার রক্ষণের দেয়াল, নাগাল পেল না। ঝাঁপিয়ে পড়লেন সুবাচিচ, তার হাতকে ফাঁকি দিল বল। ঢুকলো গোলে, ইংল্যান্ডের স্বপ্নটা যেন আরও অনেকদূরে এগিয়ে নিলেন ট্রিপিয়ের! তবে সেটাই যে এ বিশ্বকাপে অনেক বড় এক আক্ষেপের নাম হয়ে থাকবে ইংলিশদের জন্য, সেটা কে জানতো! সেই গোলটাই তো তাদেরকে ভাবাবে, "হয়েই গিয়েছিল প্রায়!"

    এরপর ক্রোয়েশিয়া সমতায় ফিরেছে, এগিয়ে যাওয়ার সুযোগও পেয়েছে। সুযোগ পেয়েছিল ইংল্যান্ডও। কর্নারে লাফিয়ে উঠে হেড করেছিলেন স্টোনস, সুবাচিচও ছিলেন অন্যদিকে। তবে লাইন থেকে হেড করে সেটা ফিরিয়েছেন ভ্রাসালকো। 

    আজ যে স্টোনসের পাথর হয়ে ভুলটা নিজ চোখের দেখার দিন। আজ মানজুকিচের শাপমোচনের দিন। পোস্টে লেগে ফিরে আসা স্বপ্নের পালে নতুন করে হাওয়া লাগানোর দিন পেরিসিচের। আর নিশ্চিত গোল বাঁচিয়েও ঘাম-অশ্রুতে মিশে একাকার হয়ে যাওয়ার দিন পিকফোর্ডের। আর স্বপ্নালু শুরুর পর অতিরিক্ত সময়ে চোট পেয়ে মাঠের বাইরে থেকেই স্বপ্নের অপমৃত্যু দেখার দিন ট্রিপিয়েরের। শুরুতে বেশ কয়েকটি হলুদ কার্ড দেখার মতো কিছু করেও বেঁচে যাওয়া ক্রোয়েশিয়া তাই শেষ কয়েক মিনিট খেলেছে দশজনের ইংল্যান্ডের বিপক্ষে, তাও আবার কোনও লালকার্ডের ঘটনা ছাড়াই! 

    আজ ক্রোয়েশিয়ার সোনালী প্রজন্মের অনেক বড় পুরষ্কার পাওয়ার পথে আরেকধাপ এগিয়ে যাওয়ার দিন, যে দিনটা মনে রাখবে তাদের ফুটবল। হয়তো মনে রাখবে ইংল্যান্ডও। তাদের ছবিটা রঙিন হয়েই উঠেছিল প্রায়। ক্রোয়েশিয়ার উজ্জ্বল রঙেই শুধু মিলিয়ে গেছে সেটা। 

    ইংল্যান্ড (৩-৫-২): পিকফোর্ড; ওয়াকার, ম্যাগুয়ের, স্টোনস; ট্রিপিয়ের, হেন্ডারসন, আলি, লিনগার্ড, ইয়ং; স্টার্লিং, কেইন

    ক্রোয়েশিয়া (৪-২-৩-১): সুবাসিচ; ভ্রাসালকো, ভিদা, লভ্রেন, স্ট্রিনিচ; ব্রোজোভিচ, রাকিটিচ; রেবিচ, মদ্রিচ, পেরিসিচ; মানজুকিচ