ক্রোয়েশিয়া মানেই ঘুরে দাঁড়ানো
সেমিফাইনাল, ১৯৯৮ বিশ্বকাপ, মুখোমুখি ফ্রান্স-ক্রোয়েশিয়া। ডেভর সুকারের গোলে এগিয়ে থেকে ফাইনালে স্বপ্ন দেখছে ক্রোয়াটরা। প্রথমবারের মতো সেমিফাইনালে ওঠা দলটির সেই স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে গেলো লিলিয়ান থুরামের জোড়া গোলে। দারুণভাবে ফিরে এসে ক্রোয়াটদের পেছনে ফেলে ফাইনালে চলে গেলো ফ্রান্স। স্বপ্নযাত্রা থেমে গেলো সুকারের ‘সোনালি প্রজন্মের’ ক্রোয়েশিয়ার।
ঠিক ২০ বছর পর, আবারও বিশ্বকাপের সেমিতে ক্রোয়েশিয়া, প্রতিপক্ষ এবার ইংল্যান্ড। ২৮ বছর পর সেমিফাইনালে ওঠা ইংলিশরাই মাত্র ৫ মিনিটের মাথায় এগিয়ে গেলো ম্যাচে। আবারও স্বপ্নভঙ্গের কালো মেঘ ঘুরপাক খাচ্ছে ক্রোয়েশিয়ার আকাশে। কিন্তু নাহ, এই ক্রোয়েশিয়া যে হার মানতে জানে না! নির্ধারিত সময়েই সমতা ফেরালেন পেরিসিচ। এই বিশ্বকাপে টানা তৃতীয়বারের মতো ক্রোয়েশিয়ার খেলা গড়াল অতিরিক্ত সময়ে। টানা তৃতীয় ট্রাইব্রেকার মনে হচ্ছিল সময়ের ব্যাপার, ঠিক তখনই এলো মারিও মানজুকিচের সেই জাদুকরী মুহূর্ত। ফিরে আসার এক দারুণ গল্প রচনা করে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপের ফাইনালে পৌঁছে গেলো ক্রোয়েশিয়া। এই বিশ্বকাপে অবশ্য ক্রোয়েশিয়ার ফিরে আসার কথা শুনলে এখন আর অবাক হন না কেউই। রাশিয়া বিশ্বকাপে ক্রোয়েশিয়া মানেই যে ঘুরে দাঁড়ানোর অবিশ্বাস্য এক রূপকথার গল্প!
****
রাশিয়া বিশ্বকাপটা কি আদতেই বাস্তব? নাকি একসাথে কোনো সুখস্বপ্ন দেখছেন ক্রোয়েশিয়ার সবাই? ক্রোয়েশিয়ার ফুটবলার ও সমর্থকরা এটা ভাবতেই পারেন! সেই গ্রুপ পর্ব থেকে সেমিফাইনাল, ক্রোয়েশিয়ার যাত্রাটা তো স্বপ্নের চেয়ে কম নয়। গ্রুপ পর্বের তিন ম্যাচেই দাপুটে জয়। বিশেষ করে লিওনেল মেসির আর্জেন্টিনাকে নিয়ে ছেলেখেলা করে যেভাবে ৩-০ গোলে হারাল লুকা মদ্রিচরা, সেটা অবাক করেছে বহু মানুষকেই।
গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে দ্বিতীয় রাউন্ডে ওঠা ক্রোয়েশিয়ার প্রতিপক্ষ ডেনমার্ক। খেলা শুরু হতে না হতেই ড্যানিশদের গোল। কিছু বুঝে ওঠার আগেই জর্জেনসেনের গোলে এগিয়ে ডেনমার্ক। এভাবে পিছিয়ে পড়েও ক্রোয়েশিয়ার আত্মবিশ্বাস একটুও নড়েনি। ৩ মিনিট পরেই গোল শোধ করে ক্রোয়েশিয়াকে ম্যাচে ফেরান মানজুকিচ। নির্ধারিত সময়ে আর গোল হয়নি, গোলশূন্য ছিল অতিরিক্ত সময়েও। ট্রাইবেকারে গোলরক্ষক সুভাসিচের অতিমানবীয় পারফরম্যান্সে কোয়ার্টারে পা রাখে মদ্রিচ-রাকিতিচরা।
কোয়ার্টার ফাইনালে মুখোমুখি স্বাগতিক রাশিয়া। বিশ্বকাপে স্বাগতিকদের মুখোমুখি হওয়ার স্মৃতিট খুব একটা সুখকর নয় ক্রোয়েশিয়ার। ১৯৯৮ বিশ্বকাপে স্বাগতিক ফ্রান্সের কাছে হেরেই থমকে গিয়েছিল সুকারদের বিশ্বকাপ স্বপ্ন। ৩১ মিনিটে রাশিয়ার চেরিশেভ যখন বল জালে জড়ালেন, ক্রোয়েশিয়ার সমর্থকদের চোখেমুখে দুশ্চিন্তার ছাপ। সেই দুশ্চিন্তা উবে গেলো কিছুক্ষণর মাঝেই, ক্রামারিচের গোলে ম্যাচে ফিরল তারা, অতিরিক্ত সময়ে আর দুই গোলের নাটকের পর ম্যাচ গড়াল ট্রাইবেকারে। দ্বিতীয় রাউন্ডের পর আবারও ট্রাইবেকারে মাথা অসম্ভব রকমের ঠাণ্ডা রেখে জয় ছিনিয়ে এনে ২০ বছর পর সেমিতে পৌছালো ক্রোয়াটরা।
****
২০ বছর পর সেমিতে উঠে নকআউট পর্বের দুই ম্যাচের মতো আবারও পিছিয়ে ক্রোয়েশিয়া। কিন্তু যে দলটি বারবার পিছিয়ে পড়েও ঘুরে দাঁড়িয়েছে, তাদের কাছে কি আর এটা বাধা হতে পারে? ১৯৯৮ সালের সেমিতে এগিয়ে গিয়েও ফাইনালে উঠতে পারেনি ক্রোয়াটরা, এবার পিছিয়ে পড়েও ফাইনালে উঠেছে তারা। ১৯৯৮ থেকে ২০১৮, মাঝের কোনও বিশ্বকাপের সেমিতেই পিছিয়ে পড়ে ফাইনালে উঠতে পারেনি কেউই!
বিশ্বকাপের ইতিহাসে ক্রোয়েশিয়াই ৭ম দল, যারা নাকি সেমিফাইনালে পিছিয়ে পড়ে ফাইনালে খেলবে। ১৯৩০ সালে উরুগুয়ে, ১৯৩৮ সালে হাঙ্গেরি, ১৯৫৮ সালে সুইডেন, ১৯৭০ সালে ইতালি ও ব্রাজিল ও সর্বশেষ ১৯৯৮ সালে ফ্রান্স সেমিতে পিছিয়ে পড়ে ফাইনালে উঠেছিল।
পিছিয়ে পড়ে সেমিতে ফিরে আসা ৭ম দল হলেও একটা জায়গায় ক্রোয়েশিয়া কিন্তু অনন্য। ১৯৮৬ সালে দ্বিতীয় রাউন্ডের প্রবর্তন হওয়ার পর কোনো দলই নকআউট পর্বে টানা তিন ম্যাচে পিছিয়ে পড়ে জয় ছিনিয়ে আনতে পারেনি। ডেনমার্ক, রাশিয়া ও ইংল্যান্ড; নকআউট পর্বে ক্রোয়েশিয়ার তিন ম্যাচই গেছে অতিরিক্ত সময়ে। এরকম ঘটনা আগে ঘটেছে মাত্র একবার। ১৯৯০ সালে ইংল্যান্ডের তিনটি ম্যাচ গিয়েছিল অতিরিক্ত সময়ে। বেলজিয়াম ও ক্যামেরুনকে হারালেও সেমিতে পশ্চিম জার্মানির কাছে হার মানতে হয় ইংলিশদের।
****
১৯৯১ সালে যুগোস্লাভিয়া ভেঙে জন্ম নিয়েছিল স্বাধীন ক্রোয়েশিয়া। বিশ্বকাপে যুগোস্লাভিয়ার সোনালি ইতিহাসের ধারা ধরে রাখে সদ্য স্বাধীন হওয়া দেশটিও। কিন্তু চূড়ান্ত সাফল্য যেন কিছুতেই ধরা দিচ্ছিল না। সুকারদের সেই সোনালি প্রজন্ম অল্পের জন্য পারেনি স্বপ্নের ফাইনাল খেলতে। স্বাধীনতার ২৭ বছর পর নিজেদের ফুটবল ইতিহাসের সবচেয়ে বড় অর্জনটি কাল পূর্ণ করল ক্রোয়েশিয়া। আর মাত্র একটা ম্যাচ, প্রতিপক্ষ সুকারদের স্বপ্ন ভাঙা সেই ফ্রান্স। রূপকথার গল্পের সুখী সমাপ্তির পথে বাধা থুরামের উত্তরসূরিরা। সুকারের উত্তরসূরিদের সামনে ‘বদলা’ নেওয়ার সুবর্ণ সুযোগ। সুযোগ বিশ্বকাপ উঁচিয়ে তুলে নতুন ইতিহাসে জন্ম দেওয়ারও। হার না মেনে বারবার ঘুরে দাঁড়ানো ক্রোয়েশিয়া কি পারবে?