কে বল হায়, তৃতীয় হতে চায়!
গ্রুপ ‘জি’ এর শেষ ম্যাচ এই দুই দলকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল অদ্ভুত এক সমীকরণের সামনে। দুই ম্যাচ শেষে পয়েন্ট, গোলব্যবধান সব সমান। যে জিতবে সে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন, হারলে রানার আপ। তার ওপর নির্ভর করবে কার রাস্তা নক আউট পর্বে কতো সহজ! ওই ম্যাচে তাই দুই দলই বাজিয়ে দেখল নিজেদের দ্বিতীয় সেরা একাদশটা। শেষ পর্যন্ত অবশ্য দুই দলই সব বাঁধা অতিক্রম করে সেমিফাইনালে, দুই দলই বাদ। আবার এক বিন্দুতে দুই দল। এবার তৃতীয় স্থান নির্ধারনী ম্যাচে, দুই দলের কেউই হয়ত এই ম্যাচটাও খেলতে চায়নি!
তৃতীয় স্থান নির্ধারনী ম্যাচটা শুধুমাত্র আনুষ্ঠানিকতার। কখনও কখনও সেটা গলার কাঁটাও। গত বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে আর্জেন্টিনার কাছে টাইব্রেকারে হেরে বাদ পড়ার লুই ফন হালের কথায়ও যুক্তি খুঁজে পাওয়া যায়। “এই ম্যাচের আগে দুই দল দুইরকম ছুটি পায়। যে একদিন আগে সেমিফাইনাল খেলে তারা একটা দিন বেশি বিশ্রাম পাচ্ছে। এখন যদি আপনি তৃতীয় স্থান নির্ধারনী ম্যাচেও হেরে যান, তাহলে আপনি পরিণত হবেন ‘লুজারে’। কারণ আপনি টানা দুই ম্যাচ হেরে দেশে ফিরছেন।“ ম্যাচটা জিততে পারলে তাই সেটা হয় অনেকটা স্বান্ত্বনা পুরস্কার জেতার মতো। আর হেরে গেলে বড় দলগুলোর জন্য সেটা আরও বড় অভিশাপ। যারা বিশ্বকাপ জিততে আসে, তাদের কাছে শিরোপাটাই শেষ কথা। তাই সেমিফাইনালে হারের বেদনার পর তৃতীয় স্থানের ম্যাচ খেলার মানসিকতাটাও হারিয়ে ফেলেন অনেকে। ১৯৯৮ আর ২০০২ বিশ্বকাপে একই পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছিল গাস হিডিঙ্ককে। প্রথমবার নেদারল্যান্ডস পরেরবার দ.কোরিয়ার কোচ ছিলেন, দুইবারই তার দল চতুর্থ। এবার তিনি কোচ নন, কিন্তু তৃতীয় স্থান নির্ধারনী ম্যাচের ঘোর বিরোধীতা করেছেন এবারও।
তবে বেলজিয়াম-ইংল্যান্ডটা ম্যাচটা যে এবার ম্যাড়মেড়ে হবে না, সেটার একটা নিশ্চয়তা দেওয়া যায় ইতিহাস থেকেই। পরিসংখ্যানও তাই বলছে। এই ম্যাচে গোল হয় ভুরি ভুরি! তৃতীয় স্থান নির্ধারনী ম্যাচের শুরু বিশ্বকাপের দ্বিতীয় আসর থেকে। ১৯৩০ এর প্রথম বিশ্বকাপে এই রীতি ছিল না। সেই থেকে ১৯৭০ আর ১৯৭৪ বিশ্বকাপ বাদ দিলে বাকি ১৭ আসরের এই ফিক্সচারের প্রতিটি ম্যাচ নূন্যতম ৩ টি করে গোল দেখেছে। সেমিফাইনাল গড়াতে গড়াতে যখন দলগুলো রক্ষণে নামে আটসাঁট বেঁধে, সেখানে তৃতীয় স্থানের এই ম্যাচটা আবার মনে করিয়ে দেয় গ্রুপপর্বের দিনগুলি! বিশ্বকাপ শেষের আগে, ক্ষণিকের একটা বিনোদনের ব্যবস্থা হয় তাতে।
অবশ্য দর্শকদের জন্য বিনোদন হলেও, অনেক দলের কাছে এই লড়াইটাও সম্মানের। ১৯৯৪ সালে সুইডেন তৃতীয় হয়ে দেশে ফেরার পর তাদেরকে দেওয়া হয়েছিল বীরের সম্মাননা। সেনাবাহিনীর সেলুট পেয়ে দেশে ঢুকেছিল সুইডিশরা। পরের বিশ্বকাপে প্রথমবারের মতো খেলতে এসেই ক্রোয়েশিয়া তৃতীয় হলো। পৃথিবীর বুকে জন্ম নেওয়া নতুন একটা দেশের জন্য এর চেয়ে বেশি সম্মান আর কী বা হতে পারত! সাম্প্রতিক সময়ে অবশ্য তৃতীয়স্থান নির্ধারনী সেরা ম্যাচটা দেখেছিল বোধ হয় ২০০২ বিশ্বকাপ। ৫ গোলের থ্রিলারে স্বাগতিক দ.কোরিয়াকে হারিয়েছিল তুরস্ক। কিন্তু ম্যাচ শেষে দুইদলের খেলোয়াড়দের এক হয়ে গ্যালারির দর্শকদের কাছ থেকে বিদায় নেওয়ার দৃশ্যটা মনে গেঁথে গেছে ফুটবল বিশ্বের। বিশ্বকাপের একটা মানে তো সম্প্রীতিও। সেটা মাঠের খেলায় বোঝা না গেলেও, ফাইনালের আগের এই ম্যাচটা মনে করিয়ে দেয় পুরনো সত্যটাও।
বিশ্বকাপে এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ গোলদাতা হ্যারি কেইন। তার চেয়ে দুই গোল কম দিয়ে দ্বিতীয় বেলজিয়ামের রোমেলু লুকাকু। ইংল্যান্ড-বেলজিয়াম ম্যাচ তাই গোল্ডেন বুট নিশ্চিত করার বা ছিনিয়ে নেওয়ারও একটা প্রতিদ্বন্দ্বীতা এবার। এই ঘটনা অবশ্য এবারই প্রথম নয়। ১৯৯০ বিশ্বকাপে সিলভাতর শিলাচি, ১৯৯৮ এ ডেভর সুকার, ২০১০ এ থমাস মুলার- সবাই নিজের গোল সংখ্যাটা বাড়িয়ে নিয়েছিলেন এই ম্যাচ দিয়েই। পরে গোল্ডেন বুটও জিতেছিলেন। এবার ব্যতিক্রম হলো যে দুইজন গোল্ডেনবুটের দৌড়ে এগিয়ে আছেন তাদের দুই দলই মুখোমুখি তৃতীয় স্থানের ম্যাচে। সেটাও বাড়তি একটা মাত্রা যোগ করছে রাশিয়ার বিশ্বকাপে।
সেমিফাইনাল শেষ হয়েছে বুধবারে, এরপর বাংলাদেশের হিসাবে প্রায় আড়াই দিনেরও বেশি সময় চলে গেছে। গত একমাসে ফুটবল ছাড়া এতোখানি সময় কাটেনি আপনার! রবিবার ফাইনাল, সেটা যতখানি ফুটবল, ততোখানি স্নায়ুর লড়াইও। তার আগে চিন্তাহীন একটা ম্যাচ দেখে প্রস্তুতিটা আপনি সেরে নিতেই পারেন। হতাশ যে হবেন না, সেই নিশ্চয়তা দেওয়া যায় শতভাগ!