• রাশিয়া বিশ্বকাপ ২০১৮
  • " />

     

    দিদিয়ের দেশম: 'গণশত্রু' থেকে ফ্রান্সের 'নয়নের মণি'

    দিদিয়ের দেশম: 'গণশত্রু' থেকে ফ্রান্সের 'নয়নের মণি'    

    ১.

    ৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৬। বেলারুশের বিপক্ষে বাছাইপর্বে নিজেদের প্রথম ম্যাচে গোলশূন্য ড্র করল ফ্রান্স। বোরিসভ অ্যারেনাতে বেলারুশ সমর্থকেরা যখন উল্লাসের কোরাস গাইছেন, তখন ডাগআউটের ঠিক ওপরে প্রায় হাজার দুয়েক ফ্রেঞ্চ সমর্থকদের দুয়োধ্বনিও শোনা যাচ্ছিল স্পষ্ট। দুয়োটা অবশ্য দলের জন্য যতটা, তার চেয়ে ঢের বেশি ডাগআউটে স্যুট-প্যান্ট পড়া কেতাদুরস্ত লোকটির প্রতি। দিদিয়ের দেশম। মাস দুয়েক আগে যিনি ফ্রান্সেই রোনালদোবিহীন পর্তুগালের কাছে হেরেছেন ইউরো ফাইনাল। ২০১৪ সালের বিশ্বকাপটাও ছিল হতাশার,  শেষ আট থেকেই বিদায়। মেগাডেথ ব্যান্ডের ‘পাবলিক এনেমি নাম্বার ওয়ান’ যেন ফ্রান্সে দেশমই। 

     

     

    চাপটা যে কমছিল এমনটা নয়। উলটো সময়ের সাথে আরও গভীরে তলিয়ে যাচ্ছিলেন দেশম। বাছাইপর্বে হারলেন সুইডেনের কাছে, আর শেষদিকে ড্র করলেন পুঁচকে লুক্সেমবার্গের বিপক্ষে। ইউরোপের ‘এ’ গ্রুপ থেকে চ্যাম্পিয়ন হয়েই রাশিয়া টিকেট কাটলেন। কিন্তু সমর্থকদের মন যে ভরাতে পারলেন না! গ্রিযমান-পগবা-এম্বাপ্পেদের মত ফুটবলার নিয়েও ফ্রান্স বাছাইপর্বের ১০ ম্যাচে করল মাত্র ১৮ গোল! দেশমের উপর দিয়ে যা বইছিল, তাকে সমালোচনার ঝড় না বলে সাইক্লোন বললেও ভুল হবে না খুব একটা। লুক্সেমবার্গের সাথে ড্রয়ের পরদিন দেশমের ছবি প্রচ্ছদে ‘লেকিপ’-এর শিরোনাম, “আবেগ দিয়ে বিশ্বকাপ জেতা যায় না।” ১৯৯৮-এ নিজ দেশেই ১৮ ক্যারেটের স্বর্ণশিরোপায় অধিনায়ক হওয়ার সুবাদে সবার আগে চুমু এঁকেছিলেন দেশমই। টানা এরকম গড়পড়তা পারফরম্যান্সের পরও তাকে বরখাস্ত না করার পেছনে ফ্রেঞ্চ ফেডারেশনের আবেগটাই ডোবাবে তাদের- ফ্রান্সের অন্যতম প্রধান সংবাদপত্র বোঝাচ্ছিল এমনটাই।

    ২.

    ‘লেকিপ’-এর এমন দাবির পালে আরও হাওয়ার যোগান হয় এ বছরের মার্চে। মাস তিনেক পরই বিশ্বকাপ, নিজেদের ঝালিয়ে নেওয়ার সময়টা এখনই। কলম্বিয়ার বিপক্ষে ঘরের মাঠ স্তাদ দে ফ্রান্সে প্রীতি ম্যাচে মাঠে নামল দেশমের দল। সব ঠিকঠাক, দুর্দান্ত ফুটবলের পসরা সাজিয়ে ২৬ মিনিটেই ২-০ গোলে এগিয়ে ফ্রান্স। পুরো স্টেডিয়াম পগবাদের প্রত্যেক পাসে সমর্থন যোগাচ্ছিল ‘ওলে! ওলে!!’ গর্জনে। কিন্তু এরপর যা হলো, সেটা দূরতম দুঃস্বপ্নেও ভাবেনি ফ্রান্স। ২-০ তে পিছিয়ে থেকেও সেদিন ৩-২ গোলের জয় ছিনিয়ে আনলেন ফালকাও-হামেসরা। রাতটা শুরু হয়েছিল ‘ওলে’ হর্ষধ্বনি দিয়ে, আর শেষ হল ক্রোধান্বিত সমর্থকদের দেশম এবং ফুটবলারদের উদ্দেশ্যে বোতল ছুঁড়ে মারা দিয়ে। দল ‘অন পেপার’ যতই দুর্দান্ত হউক, মাঠের খেলায় যে একেবারেই নস্যি!

     

     

    দেশব্যাপী দেশমের জনপ্রিয়তা তখন শূন্যের কোঠায়। বিশ্বকাপের ঠিক আগে দিয়ে পদত্যাগ করলেন রিয়াল মাদ্রিদকে টানা ৩ চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতানো কোচ জিনেদিন জিদান। ফ্রান্সের নয়নের মণি জিদান ‘ফ্রি এজেন্ট’, দেশের দায়িত্বের ডাক পড়লে নাকচ না করার সম্ভাবনাই প্রবল। আবার দুর্দান্ত সব ফুটবলার নিয়েও নিষ্প্রাণ ফুটবলের কারণে ধুঁকছেন দেশম। দুয়ে দুয়ে চার মিলিয়ে ফেললেন অনেকেই। দুই সপ্তাহের নোটিশেও জিদানকে কোচ বানিয়ে বিশ্বকাপে পাঠানোর জোর দাবি পুরো ফ্রান্সজুড়ে। ব্রাজিলের বিপক্ষে ২০ বছর আগে ফাইনালে জোড়া গোল করা জাদুকরকে মনে রাখলেন সবাই, কিন্তু ভুলে গেলেন সদা হাস্যোজ্জ্বল অধিনায়ককে; যিনি নেতৃত্বের এক দুর্দান্ত উদাহরণ রেখে দলকে গেঁথেছিলেন এক সূতোয়।

    দেশম হাসেন, হতাশ হন না। মনে কষ্ট পেলেও চেপে যান। নিজেও জানেন, দেশবাসীর জায়গায় থাকলে হয়ত তাদের সাথেই গলা মেলাতেন তিনি নিজেও।কিন্তু আবেগটাকে গ্রাস করতে দিলেন না নিজেকে, চোয়ালবদ্ধ প্রতিজ্ঞাই করলেন। যেভাবেই হোক, এবার এমন কিছু করতে হবে- যাতে গ্রিযমান-পগবাদের নয়, ফ্রান্সের পরিচিতিটা হয় দেশমের দল হিসেবেই।  ফ্রান্স বিশ্বের ভোজনরসিকদের অন্যতম তীর্থস্থান। আর বিশ্বসেরা অনেক পাচকের ভিটেবাটিও সেখানেই। সে হিসেবে দেশম নিজেও জানেন, কেবল মালমসলা ভাল থাকলেই খাবার সুস্বাদু হয় না, লাগে নিজের ‘সিগনেচার টাচ’ও। ফ্রান্সবাসীকে দারুণ কিছু উপহার দেওয়ার অনুপ্রেরণাকেই শক্তি বানালেন। আর সেই শক্তির জোরে এক সূতোয় গাঁথলেন পগবাদের, ঠিক যেমনটা করেছিলেন ২০ বছর আগে জিদানদের সাথে।

    ৩.

    সমর্থকেরা দেশমের সামর্থ্যে পুরোপুরি বিশ্বাসী না হলেও নিজেদের ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ ফুটবলীয় মুহূর্তের সেনাপতির ওপর পূর্ণ আস্থাই রাখলেন পগবা-গ্রিযমানরা। মাঠের বাইরে থেকে প্রতিনিয়তই ইতিবাচক সমর্থন যোগালেন ফেডারেশন প্রেসিডেন্ট ফার্নান্দ দুশাই, মার্কো রিওলাচ্চির মত বোর্ড মেম্বাররা। দুয়ো শুনেছেন অনেক, তবে সমর্থনও পেয়েছেন বেশ। আর নিজের ওপর বিশ্বাসটা তো ছিলই।

     

     

    কিন্তু বিশ্বকাপের শুরুতে আবারও জেঁকে বসল সেই পুরনো ‘জুজু’। গ্রুপপর্ব তো রীতিমত কেবল ফলাফল নির্ভর খেলাই খেলল তারা। হারাতে পারল না ডেনমার্ককে। আবারও সমালোচনার ঝড় বইতে লাগল। বিভিন্ন পন্ডিতেরা বলে বসলেন, জিদানকেই দায়িত্ব দিয়ে দেওয়া উচিত ছিল আগেই। দেশমের সাথে শূলে চড়লেন পগবা, যাকে মূল একাদশেই দেখতে চাচ্ছিলেন না অনেকেই। তরুণ দল, দলে এক লরিস বাদে নেতাসুলভ ভূমিকা পালনের সামর্থ্য নেই প্রায় কারোই। এই অবস্থায় যদি নেতিবাচকতার সামনে ভেঙ্গে পড়ে দল, তাহলে আবারও বরণ করে নিতে হবে ব্রাজিল বিশ্বকাপের পরিণতি।

    ৪.

    দেশম জানতেন, ‘কমফোর্ট জোন’-এ পড়ে থাকলে বিশ্বকাপ জেতা কঠিন হয়ে উঠবে আরও। নিজের পছন্দের ৪-২-৩-১ ফর্মেশন থেকে সরে আসতেও দ্বিধান্বিত হলেন না। পগবাকে ‘নাম্বার টেন’ থেকে একটু নিচে নামিয়ে খেলালেন কান্তে-মাতুইদিদের সাথে। তবে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের মিডফিল্ডারকে উপরে উঠার ‘লাইসেন্স’টাও দিয়ে রেখেছিলেন তিনি। এম্বাপ্পে ‘নাম্বার নাইন’ না খেলিয়ে খেলালেন উইঙ্গার হিসেবে। নিজের দুর্দান্ত গতি দিয়ে যেকোনো দলকে ঝামেলায় ফেলাতে সক্ষম। দেশম চালটা চাললেন আর্জেন্টিনার বিপক্ষে, নকআউট পর্বে। কিন্তু কথায় আছে না, “ভাগ্য সাহসীদের সহায় হয়?” কাজানে সেই বেদবাক্যই ফলল দেশমের ভাগ্যে। এম্বাপ্পের গতির কাছে অসহায় আত্মসমর্পণ করল মেসির আর্জেন্টিনা। গ্রিযমান, পগবারাও ফিরলেন স্বরূপে। ম্যাচের একটা সময় পিছিয়ে পড়া ফ্রান্স দেখাল, হার না মানার মানসিকতাটা তাদের মধ্যে বিদ্যমান, ঠিক সেই ১৯৯৮-এর ‘অল স্টার’ দলটির মতই। ভাল খেলেই জিততে হবে- এমন তত্ত্বে বিশ্বাসী ছিলেন না কখনোই। বিশ্বাসী ছিলেন না পজেশনে। দলকে রক্ষণের দিক দিয়ে ইস্পাতদৃঢ় বানিয়ে প্রতি আক্রমণে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করাই তার মূল দর্শন। সফলও হয়েছেন এই তত্ত্বে। হচ্ছেন এখনও।

    উরুগুয়েকে হারানোর পর এল ফ্রান্সের সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষা। প্রতিপক্ষ বেলজিয়াম, যারা শেষ আটে বিদায় করে দিয়েছে ‘ফেভারিট’ ব্রাজিলকে। দেশম জানতেন, ট্যাকটিক্সের দিয়েই ঘায়েল করতে হবে প্রতিপক্ষকে। ১৯৯৬ সালে ফ্রেঞ্চ কিংবদন্তী এরিক ক্যান্টোনা খেলোয়াড় দেশমের ব্যাপারে বলেছিলেন, “ওর মত ফুটবলার ফ্রান্সে ভুরি ভুরি আছে। পানি টানার কাজের চেয়ে বেশি কিছু কখনোই সে করতে পারবে না।”

    শান্তশিষ্ট দেশম এবারও অপমানিত বোধ করেন না। “প্রত্যেক দলেই তো এরকম কাউকে লাগেই।” মূলত ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডারদের কাজটাকেই ‘পানি বহন’-এর সাথে তুলনা করেছিলেন ‘কিং এরিক’। নিজেও ছিলেন একজন, বেলজিয়ামকে হারানোর ক্ষেত্রে দলের দুই ‘পানি বাহক’ কান্তে-মাতুইদির ওপরই রাখলেন ভরসা। মাঝমাঠের ছকটা কষলেন তাদের কেন্দ্র করেই। আর তাতেই লেখা হল বেলজিয়াম বধের কাব্য। মাঝমাঠে একেবারেই সুবিধা করতে পারলেন না কেভিন ডি ব্রুইন, নাসের চাডলি, মারুয়ান ফেলাইনিরা। আক্রমণভাগে লুকাকুও হয়ে গেলেন ‘আইসোলেটেড’। পুরো টুর্নামেন্টে সেটপিস থেকে অসাধারণ বেলজিয়ামকে হারালেন কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার মতো করে। কর্নার থেকে উমতিতির গোলে ১২ বছর পর ফাইনালে চলে গেল ফ্রান্স। একমাত্র সাক্ষী হিসেবে থেকে গেলেন দেশম।

     

     

    ৫.

    মাস তিনেক আগেও তার মুন্ডুপাতেই ব্যস্ত ছিল সমগ্র ফ্রান্স। মাস তিনেক পর সেই দেশমের ট্যাকটিক্স এবং নেতৃত্বেই সওয়ার হয়ে এক যুগ পর ফাইনালে ফ্রান্স। বার্লিনের হতাশা ফিরল না এবার, ফিরল ২০ বছর আগে মাতৃভূমিতে মাতা বুনো উল্লাস। গতকাল শেষ বাঁশির পর লুঝনিকিতে শেষ হাসি হাসলেন দেশম, ফুটবলাররা তাকে ছুঁড়ে মারলেন আকাশে। তখন তো সপ্তম স্বর্গেই যেন পৌঁছে গেছেন দেশম। মারিও জাগালো এবং ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ারের পর খেলোয়াড় ও কোচ হিসেবে বিশ্বকাপ জেতার রেকর্ড গড়লেন। কিন্তু শান্তশিষ্ট দেশম উল্লাসে নিজের সত্ত্বা হারালেন না। ফরাসীদের মধ্যে সবার আগে তাকেই দেখা গেছে শূন্যদৃষ্টিতে শূন্যে তাকিয়ে থাকা মদ্রিচদের সান্ত্বনা দিতে। প্রতিপক্ষ ছিল ক্রোয়েশিয়া, ২০ বছর আগে যাদের সেমিতে হারিয়েই ফাইনালে এসেছিল ‘লা ব্লুজ;রা। সে সময় ফ্রান্সের কোচ ছিলেন আইমে-এতিয়েন জ্যাকে। ১৯৯৮ সালে অতিরিক্ত রক্ষণাত্মক হওয়ার কারণে কম সমালোচনা সইতে হয়নি জ্যাকেকে, বিশেষ করে মিডিয়া থেকে। কিন্তু জ্যাকে ভাঙ্গা তো দূরের কথা, মচকালেনও না। ফাইনালে ব্রাজিলকে হারিয়ে ফ্রান্সকে এনে দিলেন ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ মুহূর্ত। এরপরই তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে উঠে ফ্রেঞ্চ মিডিয়া। বিশ্বকাপ জিতলেও সমালোচনার সেই ঝড় ভোলেননি জ্যাকে, “মিডিয়া দলের ব্যাপারে যাচ্ছেতাই লিখেছে পুরোটা সময়। আমাদের মনোবল দুর্বল করে দিতে চেয়েছে তারা। কিন্তু আমরা হার মানিনি। তাদের এই লোক দেখানো সুশীলতা দরকার নেই আমার বা আমার দলের এখন।”

    মিলিয়ে দেখুন। যেন ১৯৯৮-এর ‘গুরু’র ভাগ্যই ফিরে এল দেশমের জন্য। এক অদ্ভুত চক্রপূরণ দেখল ফ্রেঞ্চ ফুটবল। তিন মাস আগে দেশম ছিলেন সমালোচনার মূলপাত্র, আর এখন পুরো ফ্রান্সের কাছে তার জনপ্রিয়তা আকাশ্চুম্বী। মার তিন মাসে 'জিরো' থেকে হয়ে গেলেন 'হিরো'। কিন্তু স্বভাবসুলভ লাজুকতা বজায়ে থাকল আবারও। সংবাদ সম্মেলনে এক ফোঁটাও কৃতিত্ব নিলেন না। জ্যাকের মত মিডিয়াকে আক্রমণও করলেন না, উলটো কৃতজ্ঞতা জানালেন ভুলগুলো চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়ায়। ১৯৯৮ এবং ২০১৮- অন্তত কোচের ভাগ্যের বিচারে বেশ সাদৃশ্যের দেখা মিলে। লুঝনিকিতে ফিরে এল স্তাদ দে ফ্রান্স। রাশিয়া পরিণত হল এক টুকরো ফ্রান্সে। আর সব কিছুর সামনে থাকলেন একজন। ২০ বছর পর যিনি মাঠে বধ করেছিলেন প্রতিপক্ষকে, ২০ বছর পর করলেন ডাগআউট থেকে। ফ্রান্সের 'পাবলিক এনেমি নাম্বার ওয়ান' হয়ে গেলেন 'অ্যাপেল অফ দেয়ার আইজ'।