'মানসিক' বা 'টেকনিক্যাল' নয়, শেষের সমস্যা আরও গভীরে
মাশরাফি বিন মুর্তজার অসহায়ত্ব দেখে আপনার মায়াই হতে পারে। এই প্রসঙ্গে এত কথা বলতে হয়েছে বাংলাদেশের ওয়ানডে অধিনায়ককে, পুরনো টেপ রেকর্ডারের মতো একই কথাই বার বার বলতে হয়েছে। শেষে গিয়েও কেন পারে না, বার বার কেন তীরে এসে তরী ডোবে,, এমন প্রশ্নের জবাবে মাশরাফি কাল ম্যাচ শেষের পর যেন খেই হারিয়ে ফেললেন। সমস্যাটা টেকনিক্যাল না মানসিক, সেটাও এখন বুঝতে পারছেন না বাংলাদেশ অধিনায়ক।
কাল গানায়া ৩ রানে হারের পর প্রশ্ন উঠবেই, এভাবে আর কত একই চিত্রনাট্য হবে? মাশরাফি যেমন বলছেন, ‘ভুল থেকে শিখছে না ক্রিকেটারেরা’; সেই ভুল কেন বার বার হবে? তার মানে ভুলগুলো ঠিক করার জন্য যে পরিকল্পনা দরকার, সেখানেই গলদ আছে। আপনি চাইলে মুশফিকুর রহিমের ওপর দোষ চাপিয়ে দিতে পারেন, আরও একবার শেষ করেও করতে পারলেন না। বা তামিম ইকবালের বেশি ডট বল খেলা বা রুবেল হোসেনের ওই খরুচে ওভারের কথা বলতে পারেন। আর ভাগ্যের ওপর দোষ দিতে চাইলে মুশফিকের এলবিডব্লু না হয়েও আম্পায়ারের ওই আউটের কথা বলতে পারেন, যেটা থেকে চার রান পেলে বাংলাদেশ ম্যাচটা জেতে। কিন্তু আম্পায়ার আউট দিয়ে দেওয়ায় বলটা হয়ে যায় ডট। এসব আসলে বিশাল একটা বরফখণ্ডের জলের ওপর ভেসে থাকা ওপরের দিকে ছোট্ট অংশ, ভেতরের সমস্যাটা আরও অনেক বেশি গভীর।
সেই গভীর সমস্যাটা আসলে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ভরসার জায়গাটাই। বাংলাদেশের ব্যাটিং মানেই গত এক যুগ ধরে তামিম ইকবাল, সাকিব আল হাসান, মুশফিকুর রহিম, আর নইলে মাহমুদউল্লাহ। তাঁদের অভিষেকের পর থেকে বাংলাদেশের ব্যাটিং মানেই এই চতুর্বর্গ। বাংলাদেশের হয়ে ব্যাটিংয়ের যেসব রেকর্ড আছে, তার সবকিছুই প্রায় এই চার জনের দখলে। কিন্তু সেটা এখন ভরসার চেয়ে বেশি শঙ্কাই জাগাবে। বাকিরা কেউ তাদের সঙ্গে তাল মেলানো দূরে থাক, অনেক কদম পেছনেই যে পড়ে আছে!
গত পাঁচ বছরে বাংলাদেশের ওয়ানডেতে প্রায় ৭০ শতাংশ রান এসেছে এই চার জনের ব্যাট থেকে। এই সময়ে এই চার জন সেঞ্চুরি করেছেন ১৫টি, আর তাদের বাইরে তিন অঙ্ক ছুঁতে পেরেছেন শুধু সৌম্য সরকার, এনামুল হক বিজয় ও ইমরুল কায়েস। এদের মধ্যে বিজয় শুধু দুইবার সেঞ্চুরি পেয়েছেন। কিন্তু তামিমের সঙ্গী হিসেবে তাল মেলানো দূরে থাক, দলে এখনো নিজের জায়গাই পাকা করে নিতে পারেননি। যেমন পারেননি সৌম্য বা ইমরুলরাও। কালও যেমন বিজয় দারুণ শুরুর পরেও উইকেট ছুঁড়ে দিয়ে এসেছেন। সৌম্যকে অসংখ্যবার সুযোগ দেওয়ার পরেও এখনও সেই আস্থার প্রতিদান দিতে পারেননি, কায়েসের টেকনিক্যাল খুঁত এখন আর কোনো অপ্রকাশ্য কিছু নয়।
তবে এসবের চেয়ে বাংলাদেশকে বেশি ভুগতে হয়েছে ফিনিশিং সমস্যার কারণেই। হারারে থেকে মিরপুর, বেঙ্গালুরু, দেরাদুন থেকে এবার গায়ানা... বার বার বাংলাদেশ শেষে এসেও সহজ ম্যাচটা শেষ করতে পারেনি। সেটার দায় দৃশ্যত মুশফিকুর রহিমের ঘাড়েই বেশি বর্তাবে। এর মধ্যে প্রতিবারই ক্রিজে ছিলেন, কিন্তু শেষে গিয়ে আর জিতিয়ে আসতে পারেননি। তবে ভুলে যাওয়া উচিত হবে না, ২০১২ এশিয়া কাপ বা এই বছর নিদাহাসের মতো আরও বেশ কয়েক বার খেলাটা শেষ করেই এসেছেন। সিনিয়র হিসেবে তাঁর কাজটা শেষ করে আসা উচিত ছিল কাল, সেটা নিয়ে সন্দেহ নেই। তবে হাতে আরও ৫ উইকেট নিয়ে শেষ ওভারে ৮ রান না নেওয়ার জন্য শুধু মুশফিককে কাঠগড়ায় দাঁড় করানোটা সামরিক ক্যুর জন্য কেবলমাত্র একজনকে কোর্ট মার্শালে ওঠানোর মতো হয়ে যাবে।
সাব্বির রহমানের কথাই যেমন ধরা যাক। বাংলাদেশের ওয়ানডে দলের অবিচ্ছেদ্য অংশ মনে করা হচ্ছে অনেক দিন থেকে। কিন্তু গত ১৩ ইনিংসে তাঁর কোনো ফিফটি নেই। এর মধ্যে অবশ্য তাঁকে লোয়ার অর্ডারেই ব্যাট করতে হয়েছে বেশি, বড় ইনিংস না খেলার জন্য তাঁকে হয়তো খুব দায়ী করা যাবে না। কিন্তু ফিনিশারের ভূমিকাও যদি থাকে, সেটা কি আদৌ বুঝতে পারছেন ? বা টিম ম্যানেজমেন্ট কি তাঁকে ব্যাপারটা বোঝাতে পেরেছে? কাল যেমন তাঁর কাজ ছিল ঠাণ্ডা মাথায় খেলাটা শেষ করে আসা, সিঙ্গেল নিলেই যা হয়ে যেত। কিন্তু ফুলটস বলে আউট হয়ে প্যানিক বাটনে চাপ দিয়ে দিলেন। আগের ম্যাচের আউটটা দুর্ভাগ্যজনক বটে, কিন্তু ছয় সাতে যখন থেকে মোটামুটি নিয়মিত, এর মধ্যে একবার শুধু ইনিংস শেষে অপরাজিত থাকতে পেরেছেন। ছয় –সাতে তাঁর কী ভূমিকা, এই জায়গায় খেলতে তিনি মানসিকভাবে প্রস্তুত কি না, সেটা নিয়েও আছে প্রশ্ন। সাব্বির একবার নিজেই বলেছিলেন, তিনি তিনে খেলতে পছন্দ করেন। সেক্ষেত্রে আদৌ খেলা শেষ করে আসার মতো মানসিক দক্ষতা আছে কি না, সেটা নিয়ে শক্ত একটা সিদ্ধান্ত এখন সময়ের দাবি।
সেই মানসিক দক্ষতা যাঁর আছে বলে মনে করা হচ্ছিল, সেই মোসাদ্দেক হোসেনও স্পষ্টতই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের সঙ্গে মানিয়ে নিতে হিমশিম খাচ্ছেন। ক্যারিয়ারের শুরুটা দারুণ ছিল, জয় এনে দিয়েছিলেন অভিষেক ওয়ানডেতেই। কিন্তু চোখের সমস্যায় গত বছর মাঠের বাইরে চলে যাওয়ার পর থেকেই মোসাদ্দেক দৃশ্যত খাবি খাচ্ছেন। ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে সেভাবে ভালো করেননি, বিপিএলেও নিজেকে হারিয়ে খুঁজেছেন। সাদা বলে ভালো কিছু করতে পারছেন না অনেক দিন ধরেই। ওয়ানডে ক্রিকেটের দাবি মিটিয়ে সাতে নামার জন্য যে সামর্থ্য দরকার, সেটা মোসাদ্দেকের কতটুকু আছে সেই প্রশ্ন এখন উঠতেই পারে।
তবে শুধু সাব্বির-মোসাদ্দেককে বলির পাঁঠা দাঁড় করানোটা কর্কশ হয়ে যাবে। একটা সময় ছয়-সাতে চোখ বুজে নাসির হোসেনের ওপর ভরসা করা যেত, সেই নাসির এখন দৃশ্যপটের বাইরে। আরিফুলদের মতো কেউ কেউ বিপিএলে শেষ দিকে জিতিয়ে আসার ক্ষমতা দেখালেও জাতীয় দলে এখনও সুযোগ মিলছে না। মাহমুদউল্লাহ-মুশফিক চার পাঁচে উঠে আসায় লোয়ার মিডল অর্ডারে একটা শূন্যতা হয়ে যাচ্ছে। অন্তত শেষ ওভারের দাবিও কেউ মেটাতে না পারেন, তাহলে সেটা বিশ্বকাপের আগে জাতীয় দলের জন্য অশনী সংকেতই।
আপনি হয়তো বলতে পারেন, তামিম শুরুতে ডট বলে চাপ না বাড়ালে শেষে এমন হতো না। ওই সময় দলের ওপর চাপটা বেশি হয়ে গিয়েছিল। সেটা নিয়ে কোনো তর্ক থাকার কথা নয়, ডট বলের সমস্যা অনেক দিন থেকেই গলার কাঁটা হয়ে আছে তামিমের। তবে চার সিনিয়রের ডট বল, শেষ দিকে আউট হয়ে যাওয়াটা সামনে আনলে আসল সমস্যাটা পেছনেই থেকে যাবে। যতক্ষণ না পর্যন্ত বাকিরা নিজেদের ভূমিকাটা ঠিকঠাক বুঝতে পারছেন, বা সেই জায়গায় বিকল্পদের নিয়ে টিম ম্যানেজমেন্টের একটা সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা আছে, ততদিন পর্যন্ত ক্ষতটা কমে গেলেও মাঝে মাঝে মাথাচাড়া দিয়ে উঠবেই। মুশফিক আজ পারেননি, পরের দিন হয়তো পারবেন। নিদাহাস ট্রফিতেই যেমন পেরেছিলেন, যেরকম পেরেছিলেন মাহমুদউল্লাহও। কিন্তু অন্য কেউ শেষ ওভারে ১২-১৩ না হোক, অন্তত ৭-৮ রান করেও যতদিন জিতিয়ে আনতে না পারবেন, শেষে এসে এমন দুঃস্বপ্নও আরও হতেই থাকবে। সেটা ব্যাটিংয়ে হোক বা বোলিংয়েও। মাশরাফি বিন মুর্তজা এই বয়সেও যেভাবে বল করছেন, তাঁর বিকল্প খোঁজা এখনও বাংলাদেশের কাছে দিল্লি দূর অস্ত।
মহাভারতে অঘোষিত ষষ্ঠ পাণ্ডব হয়েও কর্ণ সেই স্বীকৃতি পাননি কখনো, তবে শৌর্যে-বীর্যে পাল্লা দিতে পারতেন সবার সাথেই। ‘বিগ ফাইভের’ বাইরে বাংলাদেশের এখন দরকার একজন ষষ্ঠ পাণ্ডবকে। কর্ণ না হোক, আপাতত তাঁর ধারেকাছে কাউকে পেলেই চলবে।