• ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ
  • " />

     

    কেমন করবে ওয়েঙ্গারহীন আর্সেনাল?

    কেমন করবে ওয়েঙ্গারহীন আর্সেনাল?    

    ১৯৯৬-এর গ্রীষ্মে যখন আর্সেনালের কোচ হয়ে আসলেন, তখন খোদ ‘গানার’ সমর্থকেরাই ঠিক চিনতেন না তাকে। অবশ্য না চেনাটাও খুব বিস্ময়কর ছিল না তখন। ছোট এক চারাগাছের সমতুল্য কোচিং ক্যারিয়ারের আর্সেন ওয়েঙ্গার খুব পরিচিত কেউ নন তখনও। ২২ বছর পরের গ্রীষ্মে সেই চারাগাছ পরিণত হয়েছে ইংলিশ ফুটবলের সবচেয়ে বড় মহীরূহতে। এরপর আর্সেনাল ছেড়ে গেছেন তিনি, পুরাতনকে পেছনে ফেলে নতুনকে বরণ করে নিয়েছে আর্সেনালও। উনাই এমেরির হাতে এখন নতুন দিনের সূচনা দেখতে চায় গানাররা। কোচিং ক্যারিয়ারের বিচারে তো ওয়েঙ্গারের সামনে ‘শিশু’ই উনাই এমেরি। চৌকস কিছু সাইনিং এবং পিএসজি, অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ এবং চেলসির বিপক্ষে প্রাক-মৌসুমের জয় আশা দেখাচ্ছে আর্সেনাল সমর্থকদের। হয়ত, নতুন দিনের সূচনাই ইতি টানবে এক যুগেরও বেশি সময়ের হতাশার।

     

    গোলবারের নিচে তারুণ্য? নাকি অভিজ্ঞতা?

    ২০১৭-১৮ মৌসুমটা খুব একটা ভাল যায়নি পিটার চেকের। বদলি গোলরক্ষক ডেভিড ওসপিনার কাছে জায়গাও হারাতে হয়েছে তাকে। ওসপিনা নিজেও তেমন সুবিধা করতে পারেননি। গোলরক্ষকদের একাধিক ভুলের মাশুলে পয়েন্ট খুইয়েছে আর্সেনাল।

    নতুন গোলরক্ষক খুঁজছে আর্সেনাল- এমন গুঞ্জন দলবদলের শুরু থেকেই ডালপালা ছড়িয়েছে বেশ। শেষমেশ সত্যিই হয়েছে সেটা। বায়ার লেভারকুসেন থেকে তরুণ জার্মান গোলরক্ষক বার্নড লেনোকে দলে ভিড়িয়েছে আর্সেনাল। এমেরি ‘নাম্বার ওয়ান’ কে হবেন- তা নিয়ে আছে সংশয়। দলের তিন গোলরক্ষকই দারুণ। প্রাক-মৌসুমে এমেরির দল বাছাই দেখেও অবশ্য বলা যাচ্ছে না কিছুই। কারণ প্রাকমৌসুমের ৪ ম্যাচের মধ্যে লেনো এবং চেক দুজনই খেলেছেন দুটি করে ম্যাচ। চেক না লেনো? নাকি ওসপিনা? গোলরক্ষকদের মধ্যে এমেরির প্রথম পছন্দ জানতে তাই অপেক্ষা করতে হবে প্রিমিয়ার লিগ শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত।

     

    ‘নেতৃত্বহীন’ রক্ষণের হাল ধরবেন কে?

    গত মৌসুমে ইউরোপা লিগের ম্যাচে গুরুতর ইনজুরিতে পড়েন আর্সেনালের অধিনায়ক এবং সেন্টারব্যাক লরেন্ত কসিয়েলনি। ছিটকে পড়লেন বিশ্বকাপ থেকেও। এ বছর আর মাঠেই নামা হচ্ছে না তার। অবশ্য আর্সেনালও বসে নেই হাত-পা গুটিয়ে। বরুশিয়া ডর্টমুন্ড থেকে সক্রেটিস পাপাস্টাথোপোলাসকে দলে নিয়েছেন এমেরি। প্রাকমৌসুমের প্রতিটি ম্যাচেই খেলেছেন তিনি। সব ঠিক থাকলে ওয়েঙ্গারের শেষ মৌসুমে দুর্দান্ত খেলা স্কোদরান মুস্তাফির সাথে জুটি বেঁধে রক্ষণে থাকবেন সক্রেটিস। তাদের বদলি হিসেবে থাকবেন আরেক গ্রিক কন্সটান্টিনোস মাভ্রোপানোস এবং ইংলিশ তরুণ রব হোল্ডিং। আর রাইটব্যাক হিসেবে থাকবেন হেক্টর বেলেরিন। জুভেন্টাসে যাওয়ার কথা থাকলেও শেষমেশ লন্ডনেই থেকে গেছেন স্প্যানিশ এই ডিফেন্ডার। তার ‘আন্ডারস্টাডি’ হিসেবে সেই জুভেন্টাস থেকেই আনা হয়েছে স্টিফেন লিখস্টাইনারকে। ওয়েস্ট হাম থেকে ধারে খেলে আর্সেনালে ফিরেছেন কার্ল ইয়েনকিনসন। প্রাকমৌসুমের কথা আমলে আনলে রক্ষণের বাঁ-প্রান্তে সিড কোলাসিনাচের নামার সম্ভাবনাই প্রবল। তা বদলি হিসেবে আছেন নাচো মনরেয়াল। রক্ষণ বা মাঝমাঠ- দুই জায়গাতেই খেলতে সমান স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করা ক্যালাম চেম্বার্সও দুই মৌসুম মিডেলসব্রোতে ধারে খেলে ফিরেছেন ‘গানার’দের দলে। ফুলব্যাকদের গতি এবং প্রেসিংয়ের ওপর বেশি মনোযোগ দেওয়া এমেরির দলে তাই কোলাসিনাচ-বেলেরিন জুটিরই নামার সম্ভাবনা বেশি। 

     

    মধুর সমস্যার নাম মাঝমাঠ

    ওজিল, মিখিতারিয়ান, এলনেনি, তোরেইরা, গুয়েন্দুজি, রামসি, শাকা- আর্সেনালের মাঝমাঠ দেখে হিংসে হতে পারে যেকারো। নিজের পছন্দের ৪-২-৩-১ ফর্মেশনেই খেলাবেন আর্সেনালকে। ‘ডিফেন্সিভ মিডফিল্ড’-এ প্রতিবার মার খেয়ে যাওয়া আর্সেনালের এই সমস্যা সমাধানে উরুগুইয়ান লুকাস তোরেইরা এবং ফ্রেঞ্চ তরুণ মাতেও গুয়েন্দুজিকে দলে নিয়েছেন এমেরি। আগে থেকেই আছেন গ্রানিত শাকা এবং মোহাম্মদ এলনেনি। ‘নাম্বার টেন’ রোলে নিশ্চিতভাবেই নিজের করে নিয়েছেন মেসুত ওজিল। এমেরির ভাষ্যমতে, এই মৌসুমে আর্সেনালের অধিনায়কও হতে পারেন ওজিল। তার বিকল্প হিসেবে বা আর্সেনালের ডানপ্রান্তে খেলতে পারেন হেনরিখ মিখিতারিয়ান। ওজিলদের পেছনে ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডে তোরেইরা-শাকা জুটিকে দেখা সম্ভাবনাই প্রবল। এলনেনি এবং গুয়েন্দুজি থাকবেন বিকল্প হিসেবে।

    তবে এমেরি ৪-৩-৩ ফর্মেশনে খেলালে শাকার বদলে মাঝমাঠে মিখিতারিয়ানকেই দেখা যেতে পারে ওজিল-তোরেইরার সাথে। প্রাকমৌসুমে দারুণ খেলা গুয়েন্দুজিকেও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না সমীকরণ থেকে। তবে বড় এক মৌসুমকে সামনে রেখে দলের বদলি ফুটবলারদের মান দেখে নিশ্চয়ই সন্তুষ্টই হবেন এমেরি।

    সেভিয়া বা পিএসজি- দুই ক্লাবেই এমেরির একটি ট্যাকটিক্স বেশ চোখে পড়েছে। তা হল 'শিল্ডিং মিডফিল্ডার'-এর ব্যবহার। মাঝমাঠে ৩জন মিডফিল্ডারের দুজন উপরে উঠে গেলে অন্যজন নিচে নেমে রক্ষণে সাহায্য করেন। অনেক সময় তিন নম্বর সেন্টারব্যাকের কাজটাও করতে দেখা যায় তাকে। পিএসজিতে এই কাজ করতেন থিয়াগো মোত্তা বা আদ্রিয়ান রাবিওত। আর সেভিয়াতে এমেরির হয়ে কাজটি করতেন ভিচেন্তে ইবোরা। আর্সেনালকে পছন্দের ৪-২-৩-১ ফর্মেশন খেলালে তোরেইরাি খুব সম্ভবত হবেন আর্সেনালের ইবোরা বা রাবিওত। আর দূরপাল্লার শটে পারদর্শী শাকা উপরে উঠে যাবেন ওজিলের সাথে। অ্যাটাকিং দল সাজালে মিখিতারিয়ানকেও নামাতে পারেন শাকার জায়গায়। সেক্ষেত্রে তোরেইরা থাকবেন 'শিল্ডিং মিড' হিসেবে। মাঝমাঠের দখল নিজেদের করতে তোরেইরা ওপরই অনেকাংশে নির্ভরশীল আর্সেনাল।

     

    লাকাজেত, অবামেয়াং- কে কোথায়?

    দুজনই ইউরোপের অন্যতম দুর্ধর্ষ দুই স্ট্রাইকার। গোল করায় জুড়ি মেলা ভার তাদের। এমনকি এই প্রাকমৌসুমেও পাল্লা দিয়ে গোল করেছেন আলেকজান্ডার লাকাজেত এবং পিয়ের-এমেরিক অবামেয়াং। দলের দুই স্ট্রাইকারই ফর্মে থাকলেও এমেরির দুশ্চিন্তা অন্য জায়গায়। ‘নাম্বার নাইন’ হিসেবে কাকে খেলাবেন? গতি এবং বল বানিয়ে দেওয়ার ক্ষমতার বিচারে গেলে হয় অবামেয়াংকেই দেখা যাবে আর্সেনালের বাঁ-প্রান্তে। প্রাকমৌসুমে ৪ গোল করেছেন গ্যাবনের এই স্ট্রাইকার। কম যাননা লাকাজেতও। তিনিও করেছেন ৩ গোল।

    তবে পজিশন নিয়েই দুশ্চিন্তায় আছেন এমেরি। দুজনের কেউই উইঙ্গার হিসেবে তেমন স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না। আবার এমেরি নিজেও দুই স্ট্রাইকার তত্ত্বে বিশ্বাসী নন। সব মিলিয়ে এমেরির দল বাছাই এবং লাকাজেত-অবামেয়াংয়ের পজিশনের ওপর নির্ভর করছে অনেক কিছু। ডানপ্রান্তে মিখিতারিয়ানকেই পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। কিন্তু রোটেশনের কথা চিন্তা করলে এমেরির অধীনে ঠিকই পরিমিত সু্যোগ পাবেন বাকি ফরোয়ার্ডরা। লুকাস পেরেজ, অ্যালেক্স ইওবি এবং ড্যানি ওয়েলবেকরা।

    প্রতি-আক্রমণ এবং প্রেসিং- এমেরির ফুটবলীয় দর্শনের রীতিমত অবিচ্ছেদ্য অংশ দুটি। ৪-৩-৩ ফর্মেশনে দল সাজালে ফুলব্যাক এবং উইঙ্গারদের গতির ওপর নির্ভরশীল থাকেন তিনি। কিন্তু আর্সেনালে খুব সম্ভবত ৪-৩-৩ খুব বেশি খেলাতে পারবেন না এমেরি। গতিশীল উইঙ্গারের অভাব এবং ঐ ফর্মেশনে 'নাম্বার টেন' কে ব্যবহার করতে না পারা-ই হবে মূল কারণ। তাই ৪-২-৩-১ ফর্মেশনেই আর্সেনালকে দেখা যাবে হয়ত। গতির কারণে অবামেয়াং খেলবেন বাঁ-প্রান্তে। আর মাঝমাঠ থেকে উপরে এসে ডানপ্রান্তে মিখিতারইয়ানকেই হয়ত দেখা যাবে ফরোয়ার্ড হিসেবে। আর মাঝে থাকবেন লাকাজেত। আক্রমণে আর্সেনাল খেলবে ৪-২-৩-১ ফর্মেশনে, যেমনটা এমেরির প্রথম পছন্দ। আর রক্ষণের সময় যাতে মাঝমাঠের যুদ্ধে হেরে না যান, সেজন্য দল সাজাবেন ৪-৩-৩ ফর্মেশনে। 'ফ্রি রোল'-এর ওজিল নিচে নেমে সাহায্য করবেন তোরেইরা, শাকাদের।

     

    সেই ‘ইনভিন্সিবলস’-এর যুগের পর থেকে প্রায় প্রতিবারই স্কোয়াড নিয়ে আর্সেনাল সমর্থকদের অসন্তোষ যেন ধ্রুবকই হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তবে ওয়েঙ্গার-পরবর্তী যুগ সেই হতাশার পুনরাবৃত্তির ইঙ্গিত দিচ্ছে না, বরং জানাচ্ছে নতুন সম্ভাবনার আলো। আর্সেনালের ‘স্কোয়াড ডেপথ’ আছে- একটা সময় অবিশ্বাস্য মনে হওয়া এই কথাটিই এখন সত্য। আক্ষরিক অর্থেই মূল একাদশের প্রত্যেকের যোগ্য বদলি আছেন বেঞ্চে। রোটেশনেও তাই ফুটবলারদের মান নিয়ে তেমন ভুগতে হবে না এমেরিকে। চ্যাম্পিয়ন হওয়ার মত একটি স্কোয়াড হয়ত নেই তাদের, তবে এই আর্সেনাল কাউকে ছেড়ে কথা বলবে না- এমনটাই জানিয়েছেন এমেরি। এমন উক্তিকে সত্যিতে পরিণত করার মত রসদও আছে তার। চ্যাম্পিয়ন না হতে পারলেও ‘টপ ফোর’-এ মৌসুম শেষ করার স্বপ্ন তো ভালোমতোই দেখতে পারেন আর্সেনাল সমর্থকেরা।

     

    প্রেডিকশন: ৪র্থ 
    তারকা, স্কোয়াড ডেপথ, গোলদাতা- ভাগ্য গড়ে দেওয়ার সামর্থ্যের অধিকারী মিডফিল্ডার- দলে আছে সব কিছুই। কিন্তু বাকি দলগুলোর তুলনায় সেটা অপ্রতুলই। রক্ষণটা নিয়ে এখনও দুশ্চিন্তা থেকেই যাচ্ছে। মুস্তাফি নিজেও খুব স্থিতধী নন, আর সক্রেটিস প্রথম মৌসুমে কেমন করবেন তা নিয়েও আছে সংশয়। আর ওয়েঙ্গারের বদলি হিসেবে আসা প্রথম কোচ হিসেবে এমেরির উপর চাপটাও কম নয়। পিএসজিকে নিয়ে দুই মৌসুমে লিগ জিতেছেন একবার, সেভিয়াকে নিয়েও সর্বোচ্চ অবস্থান ৪র্থ। স্কোয়াড ভাল হলেও শীর্ষ ৬ দলের সাথে পাল্লা দেওয়া নিয়ে আছে প্রশ্ন। তবে শেষ পর্যন্ত এমেরি একটা চমকই দেখাবেন হয়ত! আপাতত চ্যাম্পিয়নস লিগে বাছাই করতে পারলে আর্সেনালের জন্য সেটাই হবে সেরা সাফল্য।