• ক্রিকেট

এক শচীনভক্তের খোলা চিঠি

পোস্টটি ১৯৬৯ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

প্রিয় শচীন,

আমাদের ড্রইংরুমের শোকেসের কাঁচটায় আপনার একটা স্টিকার লাগিয়েছিলাম ক্লাস থ্রি-ফোরে পড়ার সময়। ১৬-১৭ বছর পরে স্টিকারটা এখন পুরনো হয়ে গেছে, কিন্তু পুরনো হয়ে যাননি আপনি। ছোটবেলা থেকে পেপার কাটিং জমানো শখ আমার - পুরনো কাগজগুলোর বেশিরভাগ জুড়েই আপনার ছবি আর খবর। আমার কাছে পৃথিবীতে দুই ধরণের ব্যাটসম্যান আছে - এক, পৃথিবীর শুদ্ধতম ব্যাটসম্যান শচীন টেন্ডুলকার; দুই, বাকি সবাই।

আপনার ব্যাটিং আর রেকর্ড নিয়ে তো আর কিছু বলার নেই,ওগুলো সবারই জানা। আর পরিসংখ্যান তো কেবলই কিছু সংখ্যা, আপনাকে প্রকাশ করার সাধ্য কোথায় তাদের! আপনার ব্যাটিং তো শুধু চার-ছয় ছিল না, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল- আপনার আনন্দদানকারী ব্যাটিং। অনেক সময়ই পরিসংখ্যান বিরক্তিকর ক্রিকেটারদের ‘গ্রেট’ বানিয়ে দেয়। কিন্তু আপনার ব্যাটিং এর চেয়ে বড় বিনোদন যদি কিছু থেকে থাকে, তবে এর সাথে আমার খুব কমই পরিচয় হয়েছে। হাজার হাজার রান, রেকর্ডের পর রেকর্ড- কিন্তু আমি আপনাকে মনে রাখব আমার শৈশব-কৈশোরের বিনোদন সরবরাহকারী হিসেবেই। 

কেউ কেউ বলে, আপনি নাকি ম্যাচ জেতাতে পারেন না। যারা বলে, তারা কোনদিন শচীন হওয়ার যোগ্যতা রাখে না, পারবে না আরো কয় জনমেও। এরা ভুলে যায়, ২০০৩ বিশ্বকাপে পাকিস্তানের বিপক্ষে ৭৫ বলে ৯৮ রানের কথা, ১৯৯৮-এ চেন্নাই টেস্টে অষ্ট্রেলিয়ার সাথে অপরাজিত ১৫৫ রান,২০০৮-এ ইংল্যান্ডের সাথে ৪র্থ ইনিংসে ৩৮৭ রান চেজের সময় অপরাজিত ১০৩ রানের কথা, ২০১০-এ দক্ষিণ আফ্রিকার সাথে ওয়ানডেতে অপরাজিত ২০০ রানের কথা, ১৯৯৮-এ অষ্ট্রেলিয়ার সাথে শারজাতে পর পর দুই ম্যাচে ১৪৩ আর ১৩৪ এর কথা, ঢাকায় ১৪১ রান, সাথে ৪ উইকেটের কথা। এরা মনে রাখে চেন্নাইয়ের ১৩৬ বা হায়দ্রাবাদের ১৭৫ এর কথা। টেষ্টে ১৩ বার আর ওয়ানডেতে ৬০ বার ম্যান অফ দি ম্যাচ দেখলেও যে কারো বোঝা উচিত, আপনি কতগুলো ম্যাচ জিতিয়েছেন। আপনার ৫১ টেষ্ট সেঞ্চুরীর ২০ জয়,২০ ড্র্‌,১১ পরাজয়।ওয়ানডের ৪৮ সেঞ্চুরীর ৩২ জয়, ১৩ পরাজয়। লারাকেও ৩টি ডাবল সেঞ্চুরী আর ৮ বার ম্যাচে দুইশর বেশি রান করার পরেও পরাজিত দলে থাকতে হয়েছে। আপনাকে ২১ বছর ধরে দলের ব্যাটিং একাই কাঁধে বয়ে নিয়ে বেড়াতে হয়েছে। যেকোনো সময়ের যেকোন বিশ্ব একাদশ গড়লে, এমন কোন অধিনায়ক নেই যে, তিনি বলবেন, আপনার দল বেশি জয় পায় না বলে আপনাকে দলে রাখবেন না, এজন্য তো আপনি না, দায়ী দলের অন্যরা, যারা আপনার কাছাকাছি অবদানও রাখতে পারেনি।  

আমাদের প্রজন্মটা খুব বেশি সৌভাগ্যবান, আপনার ব্যাটিং সেই ছোটবেলা থেকে দেখতে পেরেছি বলে। আমরা ব্র্যাডম্যান-রিচার্ডসকে দেখিনি, লোকের মুখে শুনেছি। তবে তাঁরা যদি আপনার মত খেলে থাকেন, তবে তাঁরা অবশ্যই বেশ ভালো খেলোয়াড়ই ছিলেন।

আপনাকে এবার একটু বিরক্ত করি। জানি, এই তুলনায় আপনিও বিব্রত হবেন, তবুও বলি- ব্র্যাডম্যানের সেই সময়টায় এত প্রযুক্তি ছিল না যে, ব্যাটসম্যানদের দুর্বলতা দুদিনেই ধরে ফেলবে। সেকালের খোলা পিচে আর হেলমেট-গার্ড ছাড়া খেলা ব্র্যাডম্যানের সাথে কারো তুলনা হয়না এটাও জানি খুব ভাল করে, তুলনা হয়না এক যুগের গ্রেটের সাথে আরেক যুগের গ্রেটের। ব্র্যাডম্যান ২০ বছরের ক্যারিয়ারে ৪ দলের বিরুদ্ধে মাত্র ৫২ টেষ্ট খেলেছেন আর আপনি ২১ বছরে ১৭৭ টেষ্ট, ৪৫৩ ওয়ানডে। তাঁর অতিমানবীয় ৯৯.৯৪ গড় অবশ্যই নমস্য, কিন্তু এখনকার এই ব্যস্ত শিডিউল, প্রতিটি বলের নিখুঁত টেকনিক্যাল অ্যানালাইসিসের যুগে তাঁর এই গড় থাকত না বলেই বোধ করি। তাঁর ১০০ গড় হওয়ার ম্যাচ যখন সবাই দেখছিল, তিনি হয়ত চাপ সইতে না পেরেই প্রয়োজনীয় চারটি রান করতে পারেননি। আর বছরের পর বছর ধরে আপনার সাথে ছিল শতকোটি মানুষের প্রত্যাশার চাপ। যেখানে ব্র্যাডম্যানের ৬৯৯৬ রানের ৫০২৮ রানই এসেছে কেবল ইংল্যান্ডের সাথে, সেখানে আপনাকে খেলতে হয়েছে নানা দেশের ভিন্ন ভিন্ন পিচে, পড়তে হয়েছে ওয়াসিম, ওয়াকার, ম্যাকগ্রা, লিলি, অ্যামব্রোস, ওয়ালশ, ডোনাল্ড, পোলক, ওয়ার্ণ, মুরালি, সাকলায়েন-এর মুখোমুখি।

সময়ের সাথে সাথে আপনার টুপিতে একটির পর একটি পালক যুক্ত হয়েছে। কিন্তু একটা ব্যাপার এখনো বদলায়নি - সাফল্যকে সহজভাবে নেয়ার ক্ষমতা। আপনার হাজারো কীর্তির মধ্যে সবচে বড় তো আসলে এটাই। শুধু ব্যাটিং নয়, ভদ্রতা-বিনয় শিখতেও আপনার কাছে যাওয়া উচিত একটা-দুটা সেঞ্চুরী করে ধরাকে সরা জ্ঞান করা ক্রিকেটারদের। ব্র্যাডম্যান-রিচার্ডস-লারাকে বোলাররা ভয় পেত। আপনাকে যত না পেতো ভয়, তারচেয়েও বেশি করতো শ্রদ্ধা। এটা বোধ হয় শুধু ভাল ব্যাটিং করলেই পাওয়া যায় না। এখনো আপনি ‘ওয়াক’ করার মত সৌজন্য দেখান। প্রতিবছর ২০০ সুবিধাবঞ্চিত শিশুকে সাহায্য করেন। বাবাকে কথা দিয়েছিলেন বলে আপনি অ্যালকোহল প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপনের ২০ কোটি রূপি দূরে ঠেলে দেন। মানুষটা আপনি বলেই নিজের মনের কাছেই বেশি দায়বদ্ধ।

আপনি ক্রিকেট বিশ্বের সবচেয়ে ধনীদের একজন। অথচ আপনার কাছে সবচে অমূল্য সম্পদ- আপনার গুরু রমাকান্ত আচরেকারের দেওয়া ১৩টি এক রূপীর কয়েন- নেটে সারাদিন আউট না হলে আপনি উপহার পেতেন একটি করে। অথচ ঘটতে পারত একেবারে উলটো। এত অল্পবয়সে এত খ্যাতি, এত প্রাচুর্য যে পায়, তার মাথা ঠিক থাকে না, থাকার কথাও না। কিন্তু অন্য অনেক ব্যাপারের মত এখানেও আপনি ভিন্ন। আপনাকে ঘিরে কোন স্ক্যান্ডাল নেই, ম্যাচ পাতানোর বিষবাষ্প আপনাকে ধূমায়িত করতে পারেনি। আপনার জীবনের গল্প একেবারেই পরিবারকেন্দ্রিক।

আজ থেকে অনেক বছর পরে আপনাকে ঘিরে থাকা নাতি-নাতনিদের যখন আপনার গৌরবের গল্প বলতে বসবেন, তখন একটি রাতের স্মৃতিচারণ আপনাকে একদম অন্যরকম করে তুলবে, হয়তো নিয়ে যাবে এক ঘোরের মধ্যে- সেই রাত, একুশ বছরের ক্যারিয়ারের একমাত্র অতৃপ্তি ঘুচানোর রাত,আপনার জীবনের সবচে গর্বের রাত, মুম্বাইয়ে নিজের ঘরের মাঠে বিশ্বকাপ ট্রফিতে চুমু খাওয়ার রাত...

শচীন,আপনার হাতে বিশ্বকাপ দেখার জন্য অনেকদিন স্বপ্ন দেখেছি...

আপনাকে ভালবাসতাম, ভালবেসে যাব...

 

ইতি,
আপনার গুণমুগ্ধ
প্রিয়ম

৪-৪-১১