• অন্যান্য

"ব্র্যাডম্যানকে দেখিনি, শচীনকে দেখেছি"

পোস্টটি ৪১৬০ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

১৫ নভেম্বর, ১৯৮৯। তাঁর অভিষেকটা হয়েছিল মাত্র ১৬ বছর বয়সে। ওয়াসিম-ইমরান-ওয়াকারদের পেস অ্যাটাকের বিপক্ষে খেলতে গিয়েছিলেন পাকিস্তানের মাটিতে। কিশোর শচীনকে প্রথম দর্শনে ওয়াসিম আকরামের মনে হয়েছিল ১৪ বছরের বাচ্চা ছেলে। পাকিস্তান দলে তখন বলাবলি চলছে, ওয়াসিম-ওয়াকার-ইমরানের পেস এই বাচ্চা খেলবে কি করে!

কিশোর শচীনের প্রথম ইনিংসেই পরীক্ষার শুরু; ওয়াসিম-ওয়াকাররা একের পর এক বাউন্সার দিলেন তাঁকে। অভিষেক সিরিজের শেষ টেস্টে ওয়াকার ইউনুসের একটা বাউন্সার এসে নাকে লাগলো শচীনের। হেলমেট খুলেই নাক ধরে বসে পড়লেন টেন্ডুলকার; দু’ ফোটা জলও গড়িয়ে পড়লো তাঁর চোখ দিয়ে। পাক দলের খেলোয়াড়রা মনে করলো ছেলেটা বুঝি প্যাভিলিয়নে ফিরে যাবে। কিন্তু, শচীন তো থামার পাত্র নন! উঠে দাড়ালেন এবং ওয়াকার ইউনুসের বল একের পর এক সীমানা পার করলেন! সেই সাথে ক্যারিয়ারের প্রথম হাফ সেঞ্চুরিটাও বাগিয়ে নিলেন।

পরের বছর ইংল্যান্ড সফরে গেল ভারত। ওল্ড ট্র্যাফোর্ড টেস্টের চতুর্থ ইনিংসে ব্যাট করতে নেমে পরাজয়ের শঙ্কায় ধুঁকছিল ভারতের ব্যাটিং লাইন আপ। ইংলিশ অধিনায়ক যখন অ্যাটাকিং ফিল্ডিং সাজিয়ে ম্যাচ জেতার কৌশল আঁটছেন, শচীন শুরু করলেন তাঁর ব্যাটিং তাণ্ডব! দশ রানের মাথায় জীবন দান করা এডি হেমিংসের বলে ডাউন দ্য উইকেটে এসে করা শট। আর আনগুস ফ্রেজারের বলে কাভার দিয়ে করা ব্যাকফুট ড্রাইভে ইংলিশদের জানিয়ে দিয়েছিলেন ক্রিকেটের শাসন তিনিই করবেন! ওল্ড ট্র্যাফোর্ডের সেই ইনিংসেই প্রথম সেঞ্চুরি হাঁকালেন ১৭ বছরের শচীন; ইংল্যান্ডের মাটিতে কনিষ্ঠ খেলোয়াড় হিসেবে। ওল্ড ট্রাফোর্ড টেস্টে প্রথম ম্যান অব দ্য ম্যাচের পুরস্কার পান টেন্ডুলকার। পুরস্কার হিসেবে দেয়া হয়েছিল ম্যাগনাম কোম্পানির আস্ত একটি শ্যাম্পেনের বোতল। তবে বয়স ১৮ পূর্ণ না হওয়ায় শ্যাম্পেনের বোতলটি খোলেননি শচীন!

দু’বছর পর ভারত দল উড়ে গেল অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে। বলা হলো শচীনের আসল পরীক্ষাটা হবে অজি পেসারদের বিপক্ষে। এসসিজি’র মাঠে নতুন বছরের প্রথম টেস্টেই ১৪৮ করলেন লিটল মাস্টার। ফলে পার্থের ওয়াকাতে করা হলো পেস বান্ধব উইকেট। পাকিস্তান, ইংল্যান্ডের পিচ কিংবা কংক্রিটের উপর ভেজা টেনিস বলে শচীনের ব্যাটিং প্র্যাকটিস; কোনটাই সমতুল্য ছিল না সেই পিচের! তবে থামবার পাত্র যে টেন্ডুলকার নন! তড়িৎ গতির সেই বোলিং ট্র্যাকেই খেললেন ১১৪ রানের ইনিংস। মাইক হুইটনি, ম্যাকডার্মট, পল রাইফেল এবং মার্ভ হিউজেসের মত বোলারদের বল খেললেন অসাধারন দক্ষতার সাথে। দুর্দান্ত কিছু কভার ড্রাইভ, হুক এবং ব্যাকফুট ড্রাইভে নিজের জাত ঠিকই চিনিয়েছিলেন শচীন টেন্ডুলকার।

ক্রিকেটের দীর্ঘ সংস্করণে শুরু থেকেই পারফর্ম করে গেলেও ওয়ানডেতে সাফল্য পেতে শচীনকে অপেক্ষা করতে হয়েছে বেশ কয়েক বছর। ৭৯টি ওয়ানডে খেলার পর দেখা পেয়েছিলেন আরাধ্য সেঞ্চুরির। ওয়ানডে ক্রিকেতে শচীন টেন্ডুলকারের সেরা কয়েকটি ইনিংসের মধ্যে অন্যতম দু’টি এসেছিল ’৯৮ এর শারজায় কোকাকোলা কাপে; অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে। ফাইনালে উঠার লড়াইয়ে গ্রুপ পর্বের ম্যাচে অজিদের বিপক্ষে পাঁচ ছক্কা ও নয় চারে ১৩১ বলে করেছিলেন ১৪৩ রান। এরপর ফাইনালেও আবার অজিদের মুখোমুখি ভারত; আবারো জেগে উঠলো ‘মরুভূমির ঝড়’। নিজের ২৫তম জন্মদিনে ১৩৪ রানের ক্যামিও ইনিংস খেললেন শচীন; ভারতকে উপহার দিলেন কোকাকোলা কাপের ট্রফি। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে তাঁর সেই ইনিংসটি ছিল দৃষ্টিনন্দন। মাইকেল ক্যাস্প্রোউইজের বলে টাওয়ার সমান উঁচু সেই স্ট্রেইট ছক্কা দেখে শচীনের প্রশংসা করে টনি  গ্রেগ বলেছিলেন, “এই ছোট্ট মানুষটাই ব্র্যাডম্যানের ধারেকাছে থাকার মত কেউ; কি অসাধারন খেলোয়াড়!”

১৯৯৯ সালটা ছিল শচীনের জন্য সবচেয়ে কঠিনতম বৎসর। বছরের শুরুতেই চেন্নাইয়ে পাকিস্তানের বিপক্ষে সেঞ্চুরি করার পথেই পিঠে ব্যথা পান টেন্ডুলকার। তবে ব্যথা সত্ত্বেও বিশ্বকাপ খেলতে ইংল্যান্ড গেলেন তিনি। কিন্তু, নিজেদের দ্বিতীয় ম্যাচের আগে দেশ থেকে খবর আসলো, টেন্ডুলকারের পিতা ইহকাল ত্যাগ করেছেন; দেশে ছুটে গেলেন শচীন। টানা দুই পরাজয়ে বিপর্যস্ত ভারত দল। বাবার শেষকৃত্য করেই মায়ের কথায় ফেরত গেলেন ইংল্যান্ডে। কেনিয়ার বিপক্ষে খেললেন ১৪০ তানের অপরাজিত ইনিংস; বাবাকে উৎসর্গ করে!

 

টেন্ডুলকারের ব্যাটিংয়ের ফুলঝুরি চলতেই থাকলো। দক্ষিন আফ্রিকায় অনুষ্ঠিত ‘০৩ বিশ্বকাপে ছয় অর্ধশতক ও একটি সেঞ্চুরিতে সর্বমোট ৬৭৩ রান করেছিলেন মুম্বাইয়ের ছেলে; পেয়েছিলেন ম্যান অব দ্য টুর্নামেন্টের পুরস্কারও। পরের বছর অর্থাৎ ২০০৪ সালটাও ছিল তাঁর ব্যাটিং তান্ডবে পরিপূর্ণ। ‘০৪ সালের শুরুতেই প্রিয় এসসিজি’তে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে খেললেন ২৪১ রানের এক অনবদ্য ইনিংস। তারপর মার্চে পাকিস্তান সফরে ১৯৪ রানের সেই অপরাজিত ব্যাটিং। এবং বছরের শেষদিকে ঢাকার বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে ক্যারিয়ার সেরা ২৪৮ নট আউট! হিন্দুস্তানে ততদিনে শচীন হয়ে উঠেছেন ক্রিকেট দেবতা!

 

শচীনের ব্যাট চলতে থাকলো। আর একের পর এক সাফল্য ধরা দিল তাঁর ব্যাটে। ওয়ানডে ক্রিকেটের প্রথম দ্বিশতক, ১৭ হাজার রানের মাইলফলক, ২০০তম টেস্ট, একশ’ সেঞ্চুরি সহ আরো কত কি! তবে তাঁর সাফল্যের মুকুটের সবচেয়ে উজ্জ্বল পালকটি এসেছিল ২০১১ বিশ্বকাপে। সেবারই তো প্রথম বিশ্বকাপ ট্রফি হাতে নিলেন তিনি। তারপরই তো উত্তরসূরি কোহলি-হরভজনরা তাঁকে কাধে বসিয়ে চক্কর দিল সারা মাঠ! আসলেই বিশ্বকাপটা না হলে কি যেন নেই মনে হত শচীনের।

 

এরপর… ১৬ নভেম্বর, ২০১৩। সিক্ত নয়নে এদিন শেষবারের মত ক্রিকেট খেলে প্যাভিলিয়নে ফিরেছিলেন এই কিংবদন্তি। সেদিন মানব প্রাচীরের মাঝ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় তাঁর চোখের জল মনে থাকবে তাঁর সকল কীর্তিগুলোর মতই। কারণ, ব্যাট হাতে শচীন টেন্ডুলকার যতটা দুর্দান্ত ছিলেন তারচেয়েও বেশি অসাধারন ছিল তাঁর মানসিকতা ও মানবিকতা। ক্রিকেটার শচীনের চেয়ে একজন ভালো মানুষ হয়ে উঠাই ছিল তাঁর লক্ষ্য। আর এ জন্যেই তো তিনি প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়দের কাছেও সবচেয়ে ‘প্রিয়’ এবং ‘আদর্শ’। গর্ব করে তাই বলতেই পারি, “আমি ব্র্যাডম্যানকে দেখিনি তবে শচীন টেন্ডুলকারকে দেখেছি”!