• ক্রিকেট

বাঁধনছাড়া স্বপ্নদেখা

পোস্টটি ১৩১১ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

আমরা স্বপ্ন দেখি । অনেক বড় বড় স্বপ্ন দেখি । আমাদের ক্রিকেট কে নিয়ে অসম্ভব সব স্বপ্ন দেখি । অনেকে বলেন, এত বড় স্বপ্ন কেন দেখি ? বেশী মাত্রাছাড়া স্বপ্ন কেন দেখি ? বাড়াবাড়ি পর্যায়ের স্বপ্ন কেন দেখি ?

এই ধরণের সব প্রশ্নের উত্তর হলো, স্বপ্ন বলেই এমন দেখি । আমরা অনেকেই আশা-আকাংখার সাথে স্বপ্ন ব্যাপারটিকে গুলিয়ে ফেলি । স্বপ্ন এমন একটি বিষয়, যা সামর্থ্য-সক্ষমতার ধার ধারে না । স্বপ্ন স্বপ্ন-ই । বাস্তবতা কি বলছে, না-বলছে ব্যাপারটা সেখানে গৌণ হয়ে দাঁড়ায় ।

 

বাংলাদেশ ক্রিকেট যখন পাঁচ বছর ধরে পরাজয়ের বৃত্তে ধুঁকে মরছিল, তখনও আমরা বাঁধনছাড়া স্বপ্ন দেখেছি । প্রতিটি ম্যাচে জয়ের স্বপ্ন চোখে এঁকেই দেখতে বসেছি । মুলতান টেস্টে পৌছে গিয়েছিলাম, স্বপ্ন পূরণের অনেক কাছে । কিন্তু হয়নি । চোখের জলে হার মানলাম সেবার । শোক কাটিয়ে আবার বসলাম স্বপ্ন দেখতে, জয়ের স্বপ্ন । বিশ্বজয়ের স্বপ্ন ।

সেই স্বপ্ন-ই সত্যি হয়ে ধরা দিল একদিন । ফ্লাওয়ার ভাইদের শক্তিশালী জিম্বাবুয়েকে হারিয়ে দিলাম । ’৯৯ তে পাওয়া পাকিস্তানের বিপক্ষে সেই জয়ের পাঁচ বছর পর জিতলাম আমরা !

তারেক আজিজের সেই শেষ ওভারের দুর্দান্ত বোলিংয়ে আমরা স্বপ্ন দেখতে শুরু করি, মাশরাফির সাথে আরো একজন বিশ্বমানের ফাষ্ট বোলারের যেন পেয়ে গেছি । রাসেল, নাজমুল, বৈশ্য... প্রত্যেককে নিয়েই এমন স্বপ্ন দেখে গেছি বারবার । স্বপ্নভঙ্গ হয়েছে সত্যি, কিন্তু স্বপ্ন দেখা থামেনি ।

 

আমাদের বাঁধনছাড়া স্বপ্ন সত্যি হয়ে ধরা দিল আবার । এম এ আজিজ স্টেডিয়ামে পাইলটের ব্যাটে যখন জয়টা পেতে পেতেও পাইনি, তখনও স্বপ্ন দেখা থামিয়ে দিইনি । বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে তখনখার রানার্স আপ সৌরভের ‘টিম ইন্ডিয়া’ কে হারিয়ে দিলাম আমরা । শচীন-শেওয়াগ-সৌরভের ভারতের বিপক্ষে সমতায় ফিরলাম । আশরাফুলের থ্রোতে স্ট্যাম্প ভাঙল, আমরা উল্লাসে ফেটে পড়লাম । শীতের কাঁপুনির চেয়েও বেশী কাঁপলাম, জয়ের মহা আনন্দে । সিরিজ জয়ের স্বপ্ন দেখাও শুরু করে দিলাম আমরা । কিন্তু শেওয়াগের উলংগ ব্যাট আমাদের সিরিজ জয়ের স্বপ্ন ভেঙ্গে খানখান করলেও, দমাতে পারেনি আমাদের স্বপ্নদেখা ।

 

সেই স্বপ্ন-ই আবার সত্যি হলো, কার্ডিফের সোফিয়া গার্ডেনে । আশরাফুলের শতকে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন অস্ট্রলিয়া বধের মহাকাব্য রচিত করলাম আমরা । শাহরিয়ার নাফিসে খুঁজে পেলাম, ওপেনিংয়ের বহু পুরনো সমস্যার সমাধান । মাশরাফি-বৈশ্য-নাজমুল পেসত্রয়ীর সাথে, পেস-অলরাউন্ডার আফতাবে অনেক অনেক স্বপ্ন দেখলাম আমরা । সেই স্বপ্ন কখনো কখনো হোঁচট খেয়েছে, মুখ থুবড়ে পড়েছে । তাই বলে থেমে যায়নি আমাদের স্বপ্নদেখা ।

 

জিম্বাবুয়ের সাথে টেস্ট-ওয়ানডে দুটোই জিতলাম । স্বপ্ন দেখতে শুরু করলাম নাফিস ইকবালকে নিয়ে । একজন আদর্শ টেস্ট ব্যাটসম্যানের অভাব বুঝি ঘুচল ! বগুড়ায় হারালাম শ্রীলংকাকে । ফতুল্লায় প্রায় ফতুর করে দিতে বসেছিলাম পন্টিংয়ের বিশ্বজয়ী অস্ট্রলিয়াকে ! হায়, আফসোস ! পারলাম না, হেরে গেলাম সে টেস্ট-ও ।

সে বছর অনেক ম্যাচ জিতলাম আমরা । সাকিব, ফরহাদ, মুশফিকুর, মানজারুল, রাজ, রাসেল... এমন উঠতি অনেক তরুণে দেখলাম এক নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন । বাংলাদেশ ক্রিকেটের দূর্দশার দিন ফুরানোর ইঙ্গিত পেলাম যেন !

স্বপ্ন দেখা চলতে থাকল এক নতুন দিনের জন্য, বাংলাদেশ ক্রিকেটের সুদিনের জন্য ।

 

এলো অনেক কিছু বদলে দেয়া সেই ২০০৭ বিশ্বকাপ । প্রস্তুতি ম্যাচে হারিয়ে দিলাম, ফ্লেমিংয়ের নিউজিল্যান্ডকে । ভারতকে হারানোর স্বপ্ন আমাদের সকলের চোখেমুখে । আমরা পারব তো এরকম বলে-কয়ে দ্রাবিড-শচীন-সৌরভ-যুবি-শচীন এর ‘হট ফেভারিট’ কে ভারতকে হারাতে ? স্বপ্ন দেখলাম, পারব ।

মাশরাফি নামের এক তরুণ তৃতীয় বলেই শেওয়াগের স্ট্যাম্প উপড়ে ফেললেন । তামিম নামের এক ‘অকুতোভয়’ বাঁহাতি কে দেখলাম, জহির-মুনাফদের সপাটে হাঁকাচ্ছে, ডাউন দ্যা উইকেটে এসে । আমরা সেই তামিমেই স্বপ্ন দেখলাম একজন জয়সুরিয়ার, একজন বাঁহাতি শেওয়াগের !

সবাইকে চমকে দিয়ে সেবার খেললাম, সুপার এইট । দক্ষিন আফ্রিকাকেও হারিয়ে দিয়ে তাক লাগিয়ে দিলাম বিশ্বকে । রাসেল-রাজরা ক্যালিস-স্মিথদের ভূপাতিত করলেন অনায়াসে । আমাদের লিটল জিনিয়াস আশরাফুল করলেন ছেলেখেলা, নেল-এনটিনিদের নিয়ে ! সেমি ফাইনাল খেলারও স্বপ্ন দেখতে শুরু করে দিলাম আমরা ।

আইরিশদের কাছে হারলাম । স্বপ্ন ভঙ্গ হলো, লজ্জাও জুটল । তাই বলে স্বপ্ন দেখা থামেনি । আবার নতুন করে স্বপ্ন দেখা শুরু হলো আমাদের ।

 

প্রথম টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপে ক্যারিবীয়ানদের বিদায় করে দিলাম আমরা । আশরাফুলের ব্যাট আবারো উন্মাতাল হলো । ফিদেল এডওয়ার্ডস, ডোয়াইন স্মিথরা যেন চোখেমুখে অন্ধকার দেখলেন । কুড়ি ওভারের প্রথম আসরেই আমরা খেললাম সুপার এইট । স্বপ্নের ডালপালা যেন আরও ছড়িয়ে গেল আমাদের ।

 

আইসিএল ধাক্কায় বিপর্যস্ত দেশ । এই সময় এলো নিউজিল্যান্ড । তবু আমরা অসম্ভব এক স্বপ্ন দেখলাম, ভেট্টরীর নিউজিল্যান্ডকে হারিয়ে দেব । প্রথম ওয়ানডেতে ঠিক ঠিক হারিয়ে দিলাম । চট্টগ্রাম টেস্টেও চলে গেলাম জয়ের অনেক কাছাকাছি । সেবার হেরে গেলেও, আবার নতুন স্বপ্নে বুঁদ হলাম আমরা ।

তারপর সাকিব আল হাসান নামের এক বিশ্বমানের ক্রিকেটারের খোঁজ পেয়ে গেলাম । একজন পরিপূর্ণ অলরাউন্ডারের অভাবও ঘুচল । আমাদের বহু দিনের আরাধনা, বহু দিনের সাধনা পূরণ হতে চলেছে বুঝি এবার ! একজন বিশ্বমানের প্লেয়ারের স্বপ্ন দেখা যে আমাদের বহু দিনের ! সেই তিনি এনে দিলেন একের পর এক স্বপ্ন পূরণের উপলক্ষ্য ।

সুদূর ক্যারিবীয়ান দ্বীপপুঞ্জে, উড়ল লাল-সবুজের বিজয় পতাকা । কিউইদের করলাম ধবলধোলাই । বিশ্বসেরা হলেন আমাদের দেশেরই এক সূর্যসন্তান, সাকিব আল হাসান ।

তামিম ইকবাল রাজসিক ভঙ্গিমায় নাম তুললেন, লর্ডসের অনারারী বোর্ডে । সেই ‘ইংলিশ সামারে’ ইংলিশ বোলারদের তুলোধূনো করে, হলেন উইজডেনের বর্ষসেরা । আমাদেরই সন্তান ।

আমরা এমন স্বপ্ন-ই তো এতদিন ধরে দেখছিলাম, আমাদের ছেলেরা একের পর এক কুড়িয়ে আনবে সম্মান । বিশ্বসেরা হবে, বাংলাদেশের ক্রিকেট পৌছবে অন্য উচ্চতায় ।

 

স্বদেশের মাটিতে অনুষ্ঠেয় বিশ্বকাপে ওয়েষ্ট ইন্ডিজের কাছে হেরে দেশের ক্রিকেটে যুক্ত করলাম ‘ব্ল্যাক ফ্রাইডে’ নামক শব্দগুচ্ছ । আমরা হতাশ হলেও, স্বপ্ন দেখেছিলাম পরের শুক্রবারে ফিরে আসার । আমরা ফিরে এসেছিলাম । ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ১৬৯ এ ৮ উইকেট যাওয়ার পরও স্বপ্ন দেখা বন্ধ করিনি । স্বপ্ন সত্যি হয়ে গেল । শফিউল-রিয়াদে ভর করে জিতে গেলাম আমরা ।

 

মুশফিকের ছোট কাঁধে ভর দিয়ে এশিয়া কাপ জেতার স্বপ্ন দেখলাম সেবার । জিততে জিততে হেরে গেলাম । তাতে কী ! স্বপ্ন দেখা বন্ধ হয়নি । পরের বছর দ্বিতীয়বারের মতো নিউজিল্যান্ডকে করলাম ধবল ধোলাই । পূর্ণ শক্তির ওয়েষ্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে জিতলাম সিরিজ । মাহেলা-সাঙ্গার শ্রীলংকার বিপক্ষে, শ্রীলংকায় গিয়ে ড্র করলাম ওডিয়াই সিরিজ ।

স্বপ্ন দেখা চলতে থাকল ।

 

ভুলে যাওয়ার মতো সেই ২০১৪তেও প্রতি ম্যাচে দেখে গেছি, জয়ের স্বপ্ন । স্বপ্নগুলো দুঃস্বপ্নের মতো মনে হয়েছে কখনো, তবুও দেখে গেছি সুখস্বপ্ন-ই । কখনো পোলার্ড, কখনো আম্পায়ার, কখনো আফ্রিদী, কখনো থিসারা পেরেরা হয়েছেন আমাদের স্বপ্ন হন্তারক ।

নিজেদের দেশে কুড়ি ওভারের বিশ্বকাপে হেরে গেলাম হংকংয়ের সাথে । হতাশ হয়েছি, শোকে কাতর হয়েছি । তবু স্বপ্ন দেখা বন্ধ করিনি । অসম্ভব সব স্বপ্ন দেখে গেছি, ম্যাচের পর ম্যাচ । দিনের পর দিন ।

 

মাশরাফির কাঁধে চড়ে বিশ্বকাপ খেলতে গেলাম তাসমান সাগর পাড়ে । ইতিহাস গড়ে খেলে ফেললাম কোয়ার্টার ফাইনাল । এত দিনের এত স্বপ্ন দেখা সব বুঝি স্বার্থক হতে চলল !

কি এক বছর কাটালাম আমরা । যেন আলাদীনের চেরাগ পেয়ে গেছি । তাতে ঘষা দিচ্ছি, আর সব স্বপ্ন পূরণ করছি । পাকিস্তানকে ধবল ধোলাই করলাম, দক্ষিন আফ্রিকা-ভারতের মতো প্রবল প্রতিপক্ষকে স্রেফ উড়িয়ে দিলাম ! চোখ কচলে বারবার দেখি, সত্যি তো ! এসব সত্যিই ঘটছে নাকি আমি বরাবরের মতো স্বপ্ন দেখছি ! এ যেন স্বপ্ন পূরণের বছর । এত বছরের স্বপ্ন দেখা স্বার্থক হওয়ার বছর ।

 

লি-টেইট-ম্যাকগ্রা-ব্রেকেন কি সুন্দর পেস আক্রমণ । আহা আমাদের কবে হবে ! কতকাল স্বপ্ন দেখেছি চার-পাঁচটা স্লিপ নিয়ে বঙ্গদেশীয় কেউ বোলিং করছেন, আর বুকটা তৃপ্তিতে ভরে উঠছে ! সেই স্বপ্নও পূর্ণ হলো । চার পেসার নিয়ে খেললাম । আমাদের একজন বোলারকে নিয়ে প্রতিপক্ষ নানান কাঁটাছেড়া করার পরও তথৈবৈচ অবস্থা, এমন সুখ দৃশ্যও দেখলাম আমরা ।

 

আবার এশিয়া কাপ এলো । আমরা স্বপ্ন দেখলাম এশিয়ান সুপ্রেমিসি অর্জনের । হলো না, হেরে গেলাম আমরা । তাতে কি স্বপ্ন দেখা থেমে গেছে ? মোটেই না । বরং আমরা আবার নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করে দিয়েছি । এবারের স্বপ্ন আরো বড়, আরো বৃহৎ । বিশ্বজয়ের স্বপ্ন এবার আমাদের । 

স্বপ্নভঙ্গের বেদনায় মুষড়ে পড়তে হবে ? তো কি হয়েছে, আবার স্বপ্ন দেখব ! অনেক স্বপ্ন যেমন পূর্ণ হয়েছে এই স্বপ্নও ঠিকই পূরণ হবে । একদিন না একদিন ঠিক বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হবোই হবো, ইনশাআল্লাহ । বিশ্বজয় করবোই, ইনশাআল্লাহ ।

 

(পূর্বে অন্যত্র প্রকাশিত)