• অন্যান্য

বিরক্তিকর থেকে মনোমুগ্ধকর

পোস্টটি ১৮৫৫ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

গ্রামে নানু বাড়ি যাব বলে বাসায় তখন গোছগাছ চলছিল। টিভিতে চলছিল বাংলাদেশের খেলা। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে খেলছিল। ফিল্ডিংয়ে নেমেছে বাংলাদেশ। বোলিংয়ে কি করবে, তার আগেই 'ব্রায়ান লারা' নামের এক লোক শুরু করে দিলেন কি সব তামাশা ! হ্যাঁ, বাংলাদেশ বোলিংকে নিয়ে তামাশাই শুরু করেছিলেন 'ক্রিকেটের বরপুত্র'।

 

লোকটার নাম শুনেছি। টেস্টে নাকি ৩৭৫ করে অপরাজিত ছিলেন। তা টেস্টের প্লেয়ার টেস্টের মতোই তো খেলবেন। কোন ছক্কা নেই, মাটি কাঁমড়ে কি সব খেলছেন। তখন ক্রিকেট সুধায় মজেছি ঠিকই, ক্রিকেটের অমৃত-সুধার সন্ধান পাইনি। তাই লারা’র কাভার ড্রাইভ তখন আমার কাছে চূড়ান্ত বিরক্তিকর!

বাসায় ছিলেন দিদার ভাইয়া। লারার এক একটা শট দেখার পর উনার সে কী উচ্ছ্বাস! বুঝতে পারছিলাম না, চার মারলে অত উচ্ছ্বাস করার কী আছে! তাও আবার তুলে-টুলে তো মারছেন না।

ভাইয়ার কাছে লারার এক ইনিংসের গল্প বহুবার শুনেছি। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে কোন এক ম্যাচে ওয়ালশ কে সাথে নিয়ে নাকি একা হাতে ম্যাচ বের করে ফেলেছিলেন। সেই ইনিংসটার মাহাত্ন্য বয়সকালে এসে বহু জায়গায় পড়েছি, দেখেছি ইউটিউবে। স্টীভ ওয়াহ যে টেস্টকে বলেছিলেন, তাঁর জীবনের সেরা টেস্ট।  অনেকে সেটাকে লারার অন্যতম ক্যারিয়ার সেরা ইনিংস বলেও অভিহিত করেন। কি এক ইনিংস ছিল! 

 

স্মৃতির উপর ভরসা করে লিখছি বলে ঠিকঠাক পরিসংখ্যান বলতে পারব না। তবে সম্ভবত সে ইনিংসে কোন ছয় ছিল না, চার ছিল শুধু।

চারগুলোও কি যেই সেই চার। ক্রিকেটীয় ব্যকরণ থেকে তুলে আনা সব শট। যদ্দূর মনে পড়ে ড্রাইভেই ব্যস্ত ছিলেন বেশী। যদিও তখন অতশত ক্রিকেটীয় শট বুঝতাম না, কিন্তু মনে পড়ছে অফ সাইডের বৃত্তাকার অঞ্চলের ফিল্ডারদের আশপাশ দিয়ে ছুটে যাচ্ছিল একটার পর একটা বল।

একটা পর্যায়ে একটু ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম, না-জানি এই লোক বাংলাদেশের বিপক্ষে সবচেয়ে কম বলে সেঞ্চুরীর রেকর্ড টেকর্ড করে ফেলেন কি না! কিন্তু নাহ, তিনি আমাকে তো বটেই আশ্বস্ত করলেন শহীদ আফ্রিদীকেও, কেবল রেহাই দিলেন না সনাৎ জয়সুরিয়াকে  ৩৭ বল পেরোলো, ৪৮ বল পেরোনোর আগেই তিনি করলেন ৪৫ বলে সেঞ্চুরী!

সেই লারা-তান্ডবে ভর করে বাংলাদেশের জন্য বিশাল টার্গেটই সেট করেছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ।

 

তারপর সময় পেরিয়ে গেছে। সেই চূড়ান্ত বিরক্তিকর মনে হওয়া লোকটিকেই মুগ্ধতার অপর নাম জেনেছি একটা সময়ে এসে। ছয় মাসের ব্যবধানে রাজার আসন পুনরুদ্ধার করে নিজের 'জাত' চিনিয়েছেন। এক যুগ হয়ে গেল, তিনি এখনো সেখানে অধিষ্ঠিত আছেন বহাল তবিয়তে। আরো কত যুগ থাকবেন কে জানে!

শারজার ১২৯ বলে ১৬৯ জেনেছি, '৯৬ বিশ্বকাপে ক্রনিয়ের দঃ আফ্রিকাকে বাড়ির পথ দেখানো সেই ১১১ জেনেছি, জেনেছি তাঁর উন্মত্ত ব্যাট নামক লাগামহীন চাবুকের কথা। যে চাবুক রক্ত ঝরানোর মতো করে বোলারদের প্রতিটি বল কে নিজের ইচ্ছামতো সীমানা দড়ির ওপারে পাঠাতো।

ঘরোয়া ক্রিকেটের সেই নট আউট ৫০১ কিংবা ক্লাসিক ২৭৭ বা ২১৩, প্রত্যেকটা ইনিংস তাঁর প্রতি উত্তরোত্তর মুগ্ধতা-ই বাড়িয়ে গেছে। একটা সময় যে 'বিরক্তিকর' মনে হতো সেটাকে এখন পাপ মনে হয়! লারার ব্যাটিং আবার বিরক্তিকর হয় কি করে! ফর্মহীন লারার ব্যাটও তো একটা ক্লাস মেইনটেইন করে।

 

আমি নিজেকে একজন হতভাগ্য ক্রিকেট-দর্শক মনে করি। কি এক অজানা কারণে গ্রেট সব ইনিংসের চাক্ষুষ স্বাক্ষী হতে পারি না। ব্যতিক্রম কেবল শচীন টেন্ডুলকারের ওডিয়াই ডাবল। শেওয়াগের থার্ড ট্রিপল দেখার জন্য মুখিয়ে ছিলাম। কিন্তু পরদিন সকালে মুরালী কি করেছিল তা তো জানেনই। একইভাবে 'বরপুত্র' যে চারশ করল সেটাও দেখতে পারিনি, পারিনি হেইডেনের ৩৮০ দেখতেও। এমনকি জয়াবর্ধনের ৩৭৪-ও মিস হয়ে গেছে।

তাই ব্রায়ান লারার 'ডিড আই এন্টারটেইন ইউ?' সরাসরি দেখা বা শোনা কোনটাই হয়নি। কেন সেটা আজ আর মনে নেই। সেদিন যদি শুনতাম, তাহলে আপনমনেই হয়তো বলে উঠতাম, 'ইয়েস, মিঃ লারা ইউ এন্টারটেইনড মি।'

আপনি আমার কাছে চূড়ান্ত বিরক্তিকর থেকে রুপান্তরিত হয়েছেন একজন মনোমুগ্ধকর এ। তারপরও কি 'এন্টারটেইন' করতে পেরেছেন কি না সে সংশয়ে ভুগবেন?

 _______