পাকো গেন্তোঃ অচেনা এক কিংবদন্তী
পোস্টটি ২০৫২ বার পঠিত হয়েছে১৯৫৬ থেকে ১৯৬০-টানা পাঁচ বছর ইউরোপীয়ান কাপ (বর্তমানের ইউয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ) জেতা রিয়াল মাদ্রিদ দলের সেরা তারকাদের নাম বলতে বলা হলে ঘুরেফিরে প্রায় সবার মুখেই ডি স্টেফানো, পুসকাস, কোপাদের নামই ঘুরবে। একমাত্র খেলোয়াড় হিসেবে ছয় ছয়টি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ, একমাত্র খেলোয়াড় হিসেবে বারটি স্প্যানিশ লিগ জেতা ফ্রান্সিসকো পাকো গেন্তোর নাম জানা লোকের সংখ্যা এখনো একেবারেই হাতেগোনা। অথচ পুসকাস, ডি স্টেফানো এবং গেন্তো-এই দূর্ধর্ষ ত্রয়ীর কল্যাণেই পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে এতটা সাফল্য পেয়েছিল রিয়াল।
১৯৩৩ সালের ২১ অক্টোবর স্পেনের ক্যান্টাব্রিয়ার গুয়ারনিজো গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন ফ্রান্সিসকো ‘পাকো’ গেন্তো। জাদুকরী বাঁ-পা, অসাধারণ গতি ও ভিশন, পিনপয়েন্ট ক্রসিং ক্ষমতা-এগুলো ছিল তাঁর খেলার সবচেয়ে উপভোগ্য বিষয়। মাত্র ১১ সেকেন্ডে (কোনো কোনো সময় এর-ও কিছু কম সময়ে) ১০০ মিটার দৌঁড়ানোর রেকর্ডও আছে তার। বল পায়ে থাকা অবস্থাতেও তিনি প্রায় একই গতিতে দৌঁড়াতে পারতেন। সাফল্য এবং গেন্তো-এরা যেন একে অপরের পরিপূরক। তাঁর দলগত অর্জন যেকারো চোখ কপালে ওঠানোর সামর্থ্য রাখে। মাদ্রিদের হয়ে ১৭ বছরের ক্যারিয়ারে তিনি জিতেছেন ১২টি লা লিগা!! সাথে আছে ৬টি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ,যা এখন পর্যন্ত কোনো প্লেয়ারের জেতা সবচেয়ে বেশি ইউরোপিয়ান কাপের রেকর্ড । বিপক্ষদলের ফুলব্যাকদের নাকানি-চুবানি খাইয়ে লেফট উইং দাপড়ে বেড়ানোতে তার কোনো জুড়ি ছিল না। মাদ্রিদের সর্বজয়ী টিমের এই সদস্য যে তাঁর নিখুঁত ক্রসিং দ্বারা সতীর্থদের দিয়ে কত গোল করিয়েছেন,তার ইয়ত্তা নেই । দুঃখজনক হলেও সত্য যে তাঁকে এখনো অনেক মাদ্রিদিস্তারাই ঠিকমত চিনে না কিন্তু ফুটবলবিশ্বের কাছে,বিশেষত ওই আমলের ফুটবল-অনুরাগীদের কাছে তিনি এখনো চরম শ্রদ্ধার পাত্র ।
১৯৫২-৫৩ মৌসুমে রেসিং সান্তান্দেরের হয়ে ক্যারিয়ার শুরু করেন গেন্তো। রিয়ালের তখনকার প্রেসিডেন্ট সান্তিয়াগো বার্নাব্যু ইয়েস্তে হীরা চিনতে ভুল করেননি। গেন্তোকে দলে ভিড়িয়ে নেন ১৯৫৩-৫৪ মৌসুমের দলবদলে। ১৯৫৩-৫৪ মৌসুম থেকে শুরু হয় তাঁর পথচলা মাদ্রিদের ১১ নম্বর জার্সি গায়ে চাপিয়ে। ১৯৫৪-১৯৭১ সাল-এই ১৮ বছর পুরো বিশ্বকে তিনি মাতিয়ে রাখেন তার জাদু দিয়ে। রিয়ালের হয়ে ৪২৮ ম্যাচে তিনি করেছেন ১২৮টি গোল । স্টেফানো,পুসকাস,গেন্তো-এই ত্রিফলার আঘাতে প্রতিপক্ষকে দুমড়ে-মুচড়ে আগাতো মাদ্রিদ । তাঁরা একত্রে রিয়ালের ইতিহাসের সবচেয়ে সোনালী অধ্যায় রচনা করেছেন।
স্পেনের হয়ে ১৪ বছর খেলেছেন এই কিংবদন্তী লেফট-উইঙ্গার । স্পেনের হয়ে তিনি ১৯৬৪ ইউরো জিতেছেন তিনি এবং ঐ টুর্নামেন্টের অন্যতম সেরা খেলোয়াড় ছিলেন তিনি।
গেন্তোর সবচেয়ে বড় ক্ষমতা ছিল তার বিদ্যুতগতি। এই গতিশীলতার কারণেই রিয়াল সমর্থকদের কাছে তিনি ‘এল সুপারসনিকো’ খেতাবপ্রাপ্ত হন। গেন্তোর জন্ম স্পেনের ক্যান্টাব্রিয়া গ্রামে। সেখানে প্রায়-ই ঘূর্নিঝড় হত এবং তাতে বাতাসের বেগ-ও থাকতো প্রচন্ড। আর ‘গেল্’ শব্দের অর্থ ‘ঝড়’। এজন্যই রিয়াল সমর্থকদের কাছে সুপারসনিকের পাশাপাশি ‘লা গালেরনা দেল ক্যান্টাব্রিকো’ (‘ক্যান্টাব্রিয়ার ঝড়’) খেতাবপ্রাপ্ত হন তিনি। তার গতির ধারণা দেওয়ার জন্য ডি স্টেফানো বলেছিলেন, ‘‘সে এতো জোরে দৌঁড়াতে পারতো যে কাউন্টার-অ্যাটাকের সময় আমাদেরকেই রীতিমত হিমশিম খেতে হত"। অবশ্য এরকম গতির কারণটা জানা গিয়েছিল তার মায়ের মুখ থেকেই। মার্কাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে গেন্তোর মা বলেছিলেন, ‘ফুটবলের পর অ্যাথলেটিকস তার সবচেয়ে প্রিয় ছিল। অবসর সময়গুলো সে এই দৌড়ানোর উপর জোর দিত বেশি। এজন্যই এখন অন্যান্যদের চেয়ে তার গতি কিছুটা হলেও বেশি’।
ফুটবলের মাঠের গেন্তো আর সাধারণ জীবনের গেন্তোর মধ্যে আছে ব্যাপক পার্থক্য। খেলার মাঠে তিনি যতটা বিধ্বংসী ছিলেন,খেলার বাইরে তিনি ততটাই নম্র-ভদ্র। সর্বদা এক চিলতে হাসি থাকতো তার মুখে। পুসকাস এজন্যই একবার বলেছিলেন, ‘ওর সাথে কথা বলে বোঝার উপায় নেই যে এই সেই ব্যক্তি যে খেলার মাঠে প্রতিপক্ষকে সর্বদা ভীত-সন্ত্রস্ত রাখে। সে একজন অসাধারণ ফুটবলার এবং এক অসাধারণ বন্ধু’ । গেন্তোরা তিন ভাই ছিলেন । মজার ব্যাপার হল,তার ছোট ২ ভাই হুলিও এবং অ্যান্টোনিও-উভয়েই মাদ্রিদের হয়ে খেলেছেন। যদিও তারা কেউই তাদের বড় ভাইয়ের মত সফল হতে পারেননি।
১৯৭১ সালে ফুটবল থেকে অবসর গ্রহণের পর তিনি রিয়াল মাদ্রিদ কাস্তিয়া সহ স্পেনের ক্লাব ক্যাস্টেলন,প্যালেন্সিয়া এবং গ্রানাডার ম্যানেজার ছিলেন। এরপর ১৯৮২ সাল থেকে বেশ অনেকখানি সময় তিনি ইউরোপে রিয়াল মাদ্রিদের অ্যাম্বাসেডরের দায়িত্ব পালন করেন। এরপর ২০১৪ সালে প্রিয় বন্ধু ও সতীর্থ আলফ্রেডো ডি স্টেফানোর মৃত্যুর পর তাকেই রিয়ালের অনারেরী প্রেসিডেন্ট পদভুক্ত হন গেন্তো।
বর্তমানে গ্যারেথ বেলের গতিতে মুগ্ধ মাদ্রিদ সমর্থকদের অনেকেই বেল ও গেন্তোর মধ্যে সাদৃশ্য খুঁজে পান। ১১ নম্বর জার্সি, অসাধারণ গতি, উইঙ্গার- বেশ কিছু সাদৃশ্য পাওয়া যায় এই দুজনের মধ্যে। তবে গেন্তোর মত অর্জনের ঝুলি বানাতে হলে যে বেলকে আরো অনেক কাঠখড় পোড়াতে হবে, তা বলাই বাহুল্য। তবে মাদ্রিদ সমর্থকদের মনে ফ্রান্সিসকো ‘পাকো’ গেন্তো ভালবাসার আলাদা এক জায়গা নিয়ে আছেন এবং থাকবেন।
- 0 মন্তব্য