• ক্রিকেট

'দ্বাদশ' ব্যাক্তি হবেন অ্যালিষ্টার কুক

পোস্টটি ১৭০০ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

এক

চেহারা সুরত তাঁর অনেকটা হলিউডের নায়কের মতো । চাইলে অনায়াসেই ব্যাট বলের ঠোকাঠুকি বাদ দিয়ে নাম লেখাতে পারতেন হলিউডের রঙিন দুনিয়ায় । কিন্তু কি আশ্চর্য্য দেখুন, সেসব বাদ দিয়ে রাজপুত্রের মতো চেহারা নিয়ে অ্যালিষ্টার কুক এলেন ক্রিকেট খেলতে ! আরও আশ্চর্য্যের হলো, ক্রিকেটে তিন ফরম্যাটের মধ্যে অনাড়ম্বর এবং অন্য ফরম্যাটের তুলনায় অনেকটা সাদামাটা 'টেস্ট' ফরম্যাটেই তিনি মানিয়ে গেলেন সবচেয়ে ভালভাবে। চাকচিক্য, গ্ল্যামার, আড়ম্বর, জৌলুস কিংবা রঙচঙে রঙিন এ সবের সাথে তাঁর আড়ি আছে বুঝি । নাকি মুখশ্রীতে দেবদূতের মতো স্বর্গীয় আভা আছে বলে আজকের যুগে হয়েছেন বিশুদ্ধ ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপণ ?

আচ্ছা সেসব কথা আপাতত থাক । শিরোনাম প্রসংগে আসি । এতদিন গর্ভভরে যে টেস্ট ক্রিকেট খেলে এসেছেন কুক, সেই টেস্ট ক্রিকেটেই তিনি হয়ে যাচ্ছে 'টোয়েলেভথ ম্যান' বা দ্বাদশ প্লেয়ার । নাহ, চমকানোর কিছু নেই । সনাতনী ক্রিকেটে ইংলিশ নেতৃত্বের ভার এখনো তাঁর কাঁধেই আছে । ফর্মের অবস্থাও বেশ ভাল । এই তো চলমান কাউন্টি চ্যাম্পিয়নশিপেই করেছেন দুটি করে সেঞ্চুরী ও ফিফটি । শ্রীলংকার বিপক্ষে চলমান সিরিজের প্রথম টেস্টে তাঁর নেতৃত্বেই মাত্র '২৯৮' রান সত্ত্বেও দল জিতেছে ইনিংস ও ৮৮ রানে । তাহলে দ্বাদশ ব্যাক্তি কেন হচ্ছেন কুক ?

উত্তরটা খুবই সহজ । গত এক দশক ধরে ক্রিকেট খেলার পুরস্কার পাচ্ছেন ক্রিকেটের এই 'শেফ' । ৯৯৮০ রান নিয়ে তিনি দশহাজারী এলিট ক্লাব থেকে নিঃশ্বাস দূরত্বে দাঁড়িয়ে আছেন । আর মাত্র কুড়ি রানে যে তিনি হয়ে যাবেন দশহাজারী এলিট ক্লাবের 'দ্বাদশ ব্যাক্তি' ।

 

দুই

সুনীল মনোহর গাভাস্কার ছিলেন এই দশহাজারী ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য । কাগুজে কলমে টেস্ট ক্রিকেটের ১১০ বছর পর, ১৯৮৭ সালে ক্রিকেট পায় একজন দশহাজারী । তার ছয় বছর পর গাভাস্কার পান তাঁর ক্লাবের দ্বিতীয় সদস্য । বোর্ডার-গাভাস্কার নামাঙ্কিত সিরিজের  অংশীদার, এ্যালান বোর্ডার ১৯৯৩ তে পৌছান এই এলিট ক্লাবে । তিনি আবার অবসরের আগে আরো এক ধাপ এগিয়ে, এলিট ক্লাবের আরো উন্নত পর্যায় 'এগারো হাজারী ক্লাব' প্রতিষ্ঠা করে যান । বলাই বাহুল্যা সে ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য বোর্ডারই ছিলেন ।

আচ্ছা বারবার 'এলিট' শব্দের ব্যবহারে বুর্জোয়া বুর্জোয়া গন্ধ পাচ্ছেন না তো ? যদিও এলিট শব্দের আভিধানিক অর্থ বুর্জোয়া নয়, তবু 'এলিট ক্লাস' নাকি বুর্জোয়া শ্রেণীকেই বোঝায় । অবশ্য আপনি এই দশ হাজারী ক্লাবকে একদিক থেকে বুর্জোয়া বলতেই পারেন । ক্রিকেটের সুবিধাভোগী কি না সেই তর্কে যাব না, তবে শাসক তো বটেই । পেসারদের দেড়শ কিমি কিংবা নব্বই ডিগ্রী বাঁককে অনায়াসে সীমানাছাড়া করে দশহাজার পর্যন্ত পৌছেছেন তাঁরা । কত বোলারদের নাকের জল, চোখের জল এক করে ইচ্ছেমতো শাসন করেছেন এই এলিট ক্লাবের সদস্যরা । সবুজ মাঠে তাদের চোখ ধাঁধানো শটেই মুহুর্মুহু তালি পড়েছে বারংবার । বোলারদের যদি ক্রিকেটে ব্যাটসম্যান দ্বারা নিস্পেষিত শ্রেণী বলা হয়, তাহলে খুব একটা মিথ্যা বলা হয় না, নিশ্চয় !

আচ্ছা 'এলিট' শব্দটা বাদ দিই, কি বলেন ? তার চেয়ে বরং 'অভিজাত'-ই ব্যবহার হোক ।

 

তিন

১৮৭৭ থেকে এই ২০১৬ পর্যন্ত টেস্ট ক্রিকেটের পথচলা প্রায় ১৩৯ বছরের । এই সুদীর্ঘ ১৩৯ বছরে দশ হাজার দৌড় সারতে পেরেছেন মাত্র 'এগারো জন' ব্যাক্তি ! এর থেকে এই দশ হাজারের মাহাত্ন্য বোধগম্য হচ্ছে নিশ্চয় । পাকিস্তানের ক্রিকেট ইতিহাস প্রায় ৬৪ বছরের, তাও তাদের একজন সদস্যও নেই এই ক্লাবে । আচ্ছা পাকিস্তান বাদ দিই, ক্রিকেটের জনক ইংল্যান্ডেরই যে কেউ পৌছতে পারেনি এই চূড়ায় এই এত বছরেও ! নিউজিল্যান্ডেরও নেই কেউ । সঙ্গত কারণেই বাংলাদেশ ও জিম্বাবুয়ের কেউ আসতে পারেননি এর ধারে কাছে । অস্ট্রলিয়া ও ভারতের তিনজন করে, শ্রীলংকা ও ওয়েষ্ট ইন্ডিজের দুইজন করে এবং দক্ষিন আফ্রিকার আছেন একজন ।

 

leading run scorer

 

গত শতাব্দী পর্যন্ত দশহাজারী ক্লাবের সদস্য ছিলেন মাত্র দুজন, বোর্ডার-গাভাস্কার । এই শতকে ইস্পাত মানব স্টিভ ওয়াহ কে দিয়ে শুরু তারপর একে  একে 'বরপুত্র' ব্রায়ান লারা, 'ব্যাটিং-ঈশ্বর' শচীন টেন্ডুলকার, জ্যাক ক্যালিস, রাহুল দ্রাবিড, রিকি পন্টিং, মাহেলা জয়াবর্ধনে, শিবনারায়ন চন্দরপল ও কুমার সাঙ্গাকারা... স্পর্শ করেছেন আভিজাত্যের এই চূড়া ।

অবশ্য ক্রিকেট ইতিহাসে আলাদা এক অধ্যায় করে নেয়া 'নব্বই দশক' মাতানো ব্যাটসম্যানদের সমাপ্তি যে এমন এক চূড়ায় উঠে হবে, এতে আর বিস্ময়ের কি ! যদিও মাহেলার সূচনা ছিল নব্বই দশকের গোড়ায় আর সাঙ্গা তো শুরু-ই করেন এই একবিংশ শতাব্দীতে । ঠিক এক বছরের ব্যবধানে এই দুই শ্রীলংকান বন্ধু মাইলফলক ছুঁয়েছেন চলতি দশকের শুরুতে । তাদের সাথে এই দশকে দশহাজারী ক্লাবে প্রবেশ করেছেন চন্দরপলও ।

দশহাজারী ক্লাব থেকে আরো উন্নত, অধিকতর অভিজাত 'এগারো হাজারী' ক্লাব হয়েছে । সেখানখার সদস্যও চারজন, বোর্ডার কে সঙ্গ দিচ্ছেন লারা, চন্দরপল ও মাহেলা  । দশহাজারী ক্লাবে পড়ে আছেন কেবল দু'জন, গাভাস্কার ও স্টিভ ওয়াহ । আপডেট ভার্সনের মতো এই ক্লাবেরও উন্নত পর্যায় বের করেছেন এক-একজন মহারথী । আরো অভিজাত 'বারোহাজারী' ক্লাবে নিঃসঙ্গ অবস্থায় আছেন কুমার সাঙ্গাকারা । তার চেয়েও অভিজাত হয়ে 'তেরোহাজারী' ক্লাবে আছেন তিন-তিনজন, পন্টিং, দ্রাবিড ও ক্যালিস ।

আর 'ব্যাটিং-ঈশ্বর' তাঁর মতো করেই আছেন পনেরো হাজারী ক্লাবে, একমেবাদ্বিতীয়ম হয়ে ।

 

চার

আভিজাত্যের চূড়ায়, ব্যাটিং-কৌলিণ্যের ভাগীদার হতে ইংলিশদের প্রতিনিধি হয়ে আসছেন অ্যালিষ্টার কুক । এই তো আর কটা দিন ! পাকিস্তানের ইউনুস খানও আছেন পেছন পেছন । তবে বয়স হয়ে গেছে ৩৮, আভিজাত্যের নাগাল পেতে আরো দৌড় বাকী ৮৮৪ ! তবে অনিশ্চিত পাকিস্তান ক্রিকেটে যে কোন কিছুই হতে পারে ।

ডি ভিলিয়ার্স-আমলাও আছেন হাজার দুই-তিন দৌড় দূরে । কোহলি, স্মিথ, উইলিয়ামসন, রুট, ওয়ার্নাররা প্রবল সামর্থ্যের জানান দিচ্ছেন । তাদের সমাপ্তিতে অভিজাত দশহাজারী ক্লাব আরো ফুলে ফেঁপে, বড় হয়ে উঠবে না তা কে বলতে পারে !

সেখানে সাকিব-তামিম না-ও থাকতে পারেন, তবে মুমিনুলদের নিয়ে তো আশা করাই যায় । দশহাজারী ক্লাবের বন্ধ্যাত্ব ঘুচবে একদিন আমাদেরও । ইংলিশ ক্রিকেটের অপেক্ষাটা ক্রিকেটের সূচনা লগন থেকে, কিউই ক্রিকেটের ৮৬ বছরের অপেক্ষা, পাকিস্তান ক্রিকেটে ৬৪ বছরেও ঘুচেনি একজন দশহাজারীর আক্ষেপ !

আশা করি আমাদের অপেক্ষা অত দীর্ঘ হবে না, ইনশাআল্লাহ ।

 

পাঁচ

এই অভিজাত কূলীন সম্প্রদায়ের প্রত্যেক সদস্যই আভিজাত্যের স্বরুপ বহন করছেন ইনিংস-প্রতি পঞ্চাশ বা ততোধিক গড়ে । ভাবতে পারছেন, প্রতি ইনিংসেই একটি করে পঞ্চাশ ! সেদিক থেকে সেই কৌলিণ্যের স্বরুপ থেকে অনেকটা দূরে আছেন অ্যালিষ্টার কুক । মাত্র এক দশকের ক্যারিয়ারে তিনি পেয়ে যাচ্ছেন আভিজাত্যের নাগাল । কনিষ্ঠ ব্যাটসম্যান হিসেবেই পৌছবেন দশহাজারের অভিজাত মাইল ফলকে । কিন্তু কৌলিণ্যের স্বরুপ ইনিংস প্রতি গড় নেই তাঁর । তাকে ৪৬.৪২ গড়ে বড্ড সাদামাটা দেখায়, অন্য ক্লাব-সদস্যদের পাশে । অবশ্য মাহেলা জয়াবর্ধনের গড়ও পঞ্চাশের নীচে, ৪৯.৮৫ । কিন্তু তাঁর একটি অপরাজিত (একবার বাংলাদেশের বিপক্ষে ব্যাট করতে অনিচ্ছা প্রকাশ করে উঠে গিয়েছিলেন, সতীর্থদের ব্যাটিংয়ের সুযোগ দিতে) ইনিংস কে আউট ধরা হয়েছে ক্রিকেটের নিয়মে, সেটাকে অপরাজিত ধরলেই পঞ্চাশ পেরিয়ে যায় তাঁর গড় ।

গড়টা পঞ্চাশের আশে পাশে থাকলে কুকও নিশ্চয় কৌলিণ্যের অংশ হওয়াটা আরও বেশী উপভোগ করতে পারতেন । আগামী ২৭ তারিখেই হয়তো প্রথম ইংলিশ হিসেবে পা রাখবেন আভিজাত্যের দশহাজারী চূড়ায় । নয়তো তার পরদিন, নইলে ২৯,৩০ কিংবা ৩১ । আর যদি এই টেস্টে না-ই পারেন আরো একটি টেস্ট তো পাচ্ছেনই । যে ফর্মে আছেন মনে হয় না, কুড়িটি রানের জন্য অত সময় নিবেন !

তাই আগাম অভিনন্দন যদি জানিয়ে রাখি, খুব কি বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে ?

_______