ছেলেবেলার এক রমজানের কয়েকটি বিকেলবেলা
পোস্টটি ১১৩০ বার পঠিত হয়েছেবয়স তখন কত... নয় কি দশ। নাজাতের দশ মানে রোযার শেষ দশ দিন সবে শুরু হয়েছে। আমার বন্ধ চলছে শুনে, দিদার ভাইয়া জিজ্ঞেস করলেন গ্রামের বাড়ি যাব কি না? আমি সম্মতির আশায় আম্মুর দিকে তাকালাম। আম্মুও সম্মতি দিলেন। আমিও চলে গেলাম ভাইয়ার সাথে ফুফুর বাড়ি।
দিদার ভাইয়া আমার ফুফাতো ভাই। ভাইয়া তখন চুয়েটে পড়তেন, সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে।
ভাইয়া খুব খেলা দেখতেন, ক্রিকেটটা একটু বেশীই দেখতেন। শৈশবে উনার সাথে ক্রিকেট দেখার সময়গুলো সবসময়ই আনন্দের ছিল।
তো পুরানগড় স্কুলের মাঠে ভাইয়ারা খেলতে যেতেন। আমিও যেতাম সাথে। বিকেলবেলা একে একে জড়ো হতো সবাই। শুনতাম কেউ কেউ খেলার জন্য রোযা রাখেনি। সেটা নিয়ে হাসাহাসি চলত, বেরোযাদারকে ক্ষ্যাপানোও হতো খুব।
দিদার ভাইয়া বল করতেন কোনাকুনি দৌড়ে এসে, এ্যাংগেল রান আপ নিয়ে। গ্রামে তো দূরের শহুরে অনেকজনও তখন এই ধরণের রান আপে চমকে যেতেন। শুধু মাত্র যারা নিয়মিত ক্রিকেট দেখতেন তারা চমকাতেন না বোধহয়। ভাইয়ারা খেলতেন, আমি বসে থাকতাম মাঠের একপাশে 'অস্থায়ী প্যাভিলিয়ন' আকৃতির জায়গায়। দিদার ভাইয়ার বোলিংয়ের সময় পাশ থেকে অনেককেই বলতে শুনতাম, 'কিরে, ও এভাবে বল করে কেন?' 'কোনাকুনি দৌড়ে কেন?'
আজকাল অবশ্য আন্তর্জাতিক ক্রিকেটেও আড়াআড়ি রান আপে বোলিং খুব একটা দেখা যায় না। আমরা ছোট থাকতে ইংল্যান্ডের ডমিনিক কককে দেখতাম কোনাকুনি করে দৌড়ে আসতেন। স্টিভ ওয়াহও মিডিয়াম পেসের সময় সম্ভবত আড়াআড়ি রান আপ নিতেন। আরো কয়েকজন ছিল, নাম মনে নেই। ডমিনিক ককের কথা মনে থাকার কারণ আছে। ভদ্রলোক মাঠে চলনে-বলনে 'আমি আর সবার চেয়ে আলাদা' এই ধরণের একটা ভাব নিতেন বলে মনে হতো। এ্যালান মুলালিও কিছুটা অ্যাংগেল করে রান আপ নিতেন। এখন সোহাইল তানভীরও কিছুটা এ্যাংগেল রান আপ নেন। স্মৃতিশক্তির দূর্বলতায় কিছু নাম মনে পড়ি পড়ি করেও কেন যেন মনে পড়ছে না!
ভাইয়াদের খেলার মধ্যে একটা সুন্দর ব্যবস্থা দেখেছিলাম। ডায়রী মেইনটেইন করা। প্রতি দিনের ম্যাচ-স্কোর, ম্যান অব দ্য ম্যাচ সব লিখে রাখা হতো সেখানে। ভাইয়ার সাথে স্কুলের মাঠে যেতে যেতে, ভাইয়া আমাকে শোনাতেন কোন এক ম্যাচে তাঁর 'একা হাতে' ম্যাচ বের করার কীর্তিগাঁথা।
প্রতিদিন বিকেলে কি এক অমোঘ আকর্ষণে ছুটে যেতাম সেখানে, স্কুল মাঠে। কখনো-সখনো দুপুরে ঘুমিয়ে গেলে, উঠেই হন্তদন্ত হয়ে দৌড় দিতাম মাঠের দিকে। বসে থাকতাম একপাশে, খেলা দেখতাম। খেলিনি কখনো। ভাইয়ার বোলিং দেখতাম, ব্যাটিং দেখতাম। তখন তো ভাইয়ার বন্ধুদের অনেকের বোলিং-ব্যাটিং স্টাইল সব মুখস্তও হয়ে গিয়েছিল।
ভাইয়া এখন অনেক পরিণত। পিতৃত্বের দায়িত্বও চেপেছে কাঁধে। মাঝে মধ্যে বাসায় আসেন, একসাথে খেলা দেখাও হয়। শুধু দেখা হয় না, তাঁর সেই আড়াআড়ি রান আপের বোলিং। রমজান মাস আসে, বিকেলগুলোও আসে। শুধু আসে না কেবল, ছেলেবেলার সেই রমজানের সেই বিকেলগুলো।
সময় এমনই... চলে যায়। শুধু রেখে যায় কিছু অম্ল-মধুর স্মৃতি!
- 0 মন্তব্য