অস্ট্রেলিয়া বধকাব্য -আততায়ী বাংলাদেশ
পোস্টটি ৩৫২৭ বার পঠিত হয়েছেসবচেয়ে সেরা সময় পার করা অস্ট্রেলিয়া দলের অধিনায়কের হতভম্ব হওয়ারই কথা। র্যাংকিং এ তখন তারা “নাম্বার ওয়ান”। অধিনায়ক হিসেবে রিকি পন্টিং ও সবার চেয়ে এগিয়ে তখন। ১৯৯৯ সালের অস্ট্রেলিয়া বিশ্বকাপজয়ী দলের সদস্য পন্টিং ২০০৩ সালে নিজে অধিনায়ক হিসেবে জয় করেন বিশ্বকাপ। এরপর ২০০৭ এ আবারো ওয়ানডে বিশ্বকাপের চ্যাম্পিয়ন দলের নেতা থাকেন তিনি। অথচ সেই পন্টিং-ই সেই ম্যাচ এর পরপরই বলেছিলেন, “এটা সম্ভবত ক্রিকেটের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় অঘটন,অধিনায়ক হিসেবে আমার সবচেয়ে বাজে হার।”
ওয়ানডে ক্রিকেটের ইতিহাসের ২২৫০ তম ম্যাচ সেটি। প্রতাপশালী অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে খেলতে নামছে হাবিবুল বাশার এর বাংলাদেশ দল। অস্ট্রেলিয়ার সেই দলের স্কোয়াড-টি মনে করিয়ে দেয়া প্রয়োজন। দুই দলের যোজন যোজন ব্যবধানটা ফুটে উঠবে এতে। গিলক্রিস্ট হেইডেন এর বিখ্যাত ওপেনিং জুটি। সাথে রিকি পন্টিং ডেমিয়েন মার্টিন এবং মাইকেল ক্লার্ক। এর সাথে মিস্টার ক্রিকেট মাইক হাসি এবং সাইমন ক্যাটিচ। বোলিং আক্রমনে সেদিন ছিলেন বোলিং লিজেন্ড গ্লেন ম্যাকগ্রা সাথে ছিলেন জ্যাসন গিলেস্পি,মাইকেল ক্যাচপ্রোইজ,এবং ব্র্যাড হগ।
২০০৫ সালের ১৮ জুন,কার্ডিফের সোফিয়া গার্ডেন এ টস জিতে ব্যাটিং এর সিদ্ধান্ত নেয় অস্ট্রেলিয়া। মাশরাফির হাতে নতুন বল তুলে দেন ক্যাপ্টেন বাশার। সেই সময়ের মাশরাফি মানে অন্য জিনিস। দুর্দান্ত পেস নিখুঁত লাইন ল্যাংথ ! ইনিংস এর প্রথম ওভারের দ্বিতীয় বলে শূন্য হাতে ০ রানেই ফিরিয়ে দেন গিলক্রিস্টকে।
ক্রিজে আসলেন রিকি পন্টিং। এবার শিকারীর ভূমিকায় তাপস বৈশ্য। তাতে অস্ট্রেলিয়ার কি এসে যায়। লম্বা ব্যাটিং লাইনআপ তাদের। ডেমিয়েন মার্টিন এর ৭৭ মাইকেল ক্লার্ক এর ৫৪ এবং শেষ দিকে মাইক হাসি ও ক্যাটিচ এর ঝড়ো ব্যাটিং এ অস্ট্রেলিয়ার সংগ্রহ দাঁড়ায় ৫০ ওভারে ২৪৯ । মাশরাফি সেই ম্যাচে ১০ ওভারে ৩৩ রান দিয়েছিলেন মাত্র। অবশ্য ২০০৫ সালে ওয়ানডে ক্রিকেটে ২৫০ রান অনেক। আর বাংলাদেশ এর এত বেশি রান তাড়া করে এর আগে জয়ের রেকর্ড নেই। তখন বাংলাদেশ এর জন্য ২০০ রান করাই সম্মানজনক স্কোর কিংবা পুরো ৫০ ওভার ব্যাটিং করাই মানে দলের মান বাঁচানো।
হয়ত দলের মান বাঁচাতেই ব্যাটিং এর হালখাতা খুলতে ক্রিজে এসেছিলেন জাবেদ ওমর বেলিম এবং বর্তমান জাতীয় দলের ওপেনার তামিম ইকবালের বড় ভাই নাফিস ইকবাল। সেই সময় বাংলাদেশ ক্রিকেটের প্রধান আকর্ষন ছিলেন মোহাম্মদ আশরাফুল। কেউ কেউ তাকে দেশের ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে প্রতিভাবান বলেও দাবি করেন। যদিও সেই প্রতিভার প্রতি বেশিরভাগ ম্যাচেই সুবিচার করতে পারতেন না তিনি। তবে তার ব্যাটিং ছিলো এক দেখার মতো জিনিস। দৃষ্টিনন্দন স্টাইলিশ সব শট এর কালেকশন তার। এই কারনেই বোধহয় কেউ কেউ জাবেদ ওমর এর বিখ্যাত ডিফেন্সিভ ব্যাটিং এর সমালোচক ছিলেন। কারন জাবেদ ওমর আউট হলেই ব্যাটিং এ আশরাফুল এর নামার পথ সুগম হয় ! জাবেদ ওমর সেদিনও খেলছিলেন তার স্বভাবসুলভ ভংগিতে। ৫১ বলে তার অর্জন ১৯ রান। এর আগেই অবশ্য নাফিস ইকবাল আউট হন ২১ বলে ৮ রান করে। তুষার ইমরান ওয়ানডাউনে খেলতে এসে কিছুটা চেস্টা করেছিলেন বটে। ৩৫ বলে ২৪ রান করে তিনিও আউট হয়ে যান।
৭২ রানেই তিন উইকেট নেই বাংলাদেশের। অর্ধেক ইনিংস মানে ২৫ ওভার শেষে স্কোর মাত্র ৮১ রান। ২৫০ রানের লক্ষ্যকে তখন পাহাড়সমই মনে হচ্ছিলো বাংলাদেশী ক্রিকেটপ্রেমীদের কাছে। তখন অবশ্য এত এত ক্রিকেটপ্রেমিক ছিলেন না। অনেকেই তাই অন্যসব দিনের মতো আশংকায় ছিলেন আরো একটি পরাজয়ের। কেউ কেউ টিভি সেট অফ করে দিয়েছেন অথবা চ্যানেল ঘুরিয়ে শীর্ষ রাজনৈতিক খবর দেখছিলেন। তাদের জন্য একরাশ হতাশাই অনুভব হওয়া উচিত। কারন তারা হয়ত ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারেননি কি অকল্পনীয় একটি মুহুর্ত উপহার দিতে চলেছেন টাইগার বাহিনী। আরো আলাদা করে বললে বলতে হয় মোহাম্মদ আশরাফুল।
ক্যাপ্টেন হাবিবুল বাশার এবং আশরাফুল মিলে গড়লেন ১৩০ রানের বিশাল জুটি। মোহাম্মদ আশরাফুল খেললেন এক মহাকাব্যিক ইনিংস। স্বভাবের বাইরে গিয়ে মাথা গরম করে অকাতরে উইকেট বিলিয়ে আসা আশরাফুলকে দেখা গেলো অন্য এক রুপে। বলের গুন বিবেচনা করে খেলছিলেন সেদিন। মাঝে মধ্যেই দর্শনীয় কাবার শট। পুল শট অথবা হুক শট। তবে ধারাভাষ্যকাররা প্রতিভাবান আশরাফুল এর “চিকি” শটের প্রশংসা করছিলেন সবচেয়ে বেশি। এভাবে এগিয়ে যেতে যেতেই ঠিক ১০০ বলে করলেন ১০০ রান। অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে বাংলাদেশী খেলোয়াড় এর শতক। সব দর্শকের এর করতালিতে মুখর কার্ডিফের মাঠ। অস্ট্রেলিয়ার খেলোয়াড়রা অভিনন্দন দিলেন তাকে। আশরাফুল মাঠেই সেজদা দিলেন। এই চিত্র অনেকদিন স্থায়ী থাকবে ক্রিকেট ফ্রেমে। অদ্ভুত তথ্য হচ্ছে মাত্র দ্বিতীয় বাংলাদেশী হিসেবে ওয়ানডে ম্যাচে শতক হাঁকান সেদিন মোহাম্মদ আশরাফুল। প্রথমটি ছিলো মেহরাব হোসেন এর।
“পিকচার আভি বাকি হ্যে” ! খেলা এখনো শেষ হয়নি। বাশার এবং শতক করার পরের বলেই আশরাফুল এর আউট ম্যাচ এর মোচড় ঘুরিয়ে দেয়ার জন্য যথেস্ট ছিলো। আফতাব আহমেদ ব্যাটিং এ ছিলেন,সাথে মোহাম্মদ রফিক। আফতাব আহমেদ সেই সময়ের অন্যতম সেরা খেলোয়াড় ছিলেন জাতীয় দলের যিনি নিজের দিনে অবলীলায় যেকোনো বোলারের উপরই ধবংসলীলা চালাতেন। ম্যাচ এর শেষ ওভারটিতে তিনি মোকাবেলা করবেন গিলেস্পি। ৬ বলে ৭ রানের দরকার। বল করার পরপরই আফতাব আহমেদ ক্রিজ থেকে হালকা বাম দিকে সরে এসে ব্যাট ঘুরিয়ে দেন মিড উইকেট এর দিকে। বল হাওয়ায় ভাসছে। গিলেস্পি তাকিয়ে আছেন,রিকি পন্টিং ও দেখছেন বলের গন্তব্য কোথায় যাচ্ছে। অতঃপর বল সীমানার বাইরে। ছক্কা !!
পরের বলেই এক রান নিয়ে দলকে জয়ের বন্দরে নোঙ্গর করান আফতাব আহমেদ। সেই অনুভূতি বলে বোঝানোর নয়। গা কাঁটা দিয়ে উঠেছিলো। একজন বাংলাদেশী হিসেবে সেই রাতে জাগ্রত সব দর্শক এটিকে ভেবেছিলো নিজের জয়। এটিই বিশ্বজয়ের চেয়ে কম কিছু নয়। এখন পর্যন্ত এটি অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে বাংলাদেশের একমাত্র বিজয়।
সেই অস্ট্রেলিয়া দলের কোনো সদস্যই এখন বর্তমান জাতীয় দলে নেই। সেই বাংলাদেশ দলের চেহারাও এতদিনে পালটে গেছে। একমাত্র সদস্য হিসেবে টিকে আছেন মাশরাফি বিন মর্তুজা। যিনি দলের উত্থান-পতন উন্মাদনা আর আর কত ঐতিহাসিক বিজয়ের রাজসাক্ষী ! যিনি নিজে এখন দলপতি। যার হাতে এইযুগের বাংলাদেশের দায়িত্ব।
এখন ব্যাটিং এ বাংলাদেশের দল এ জায়গা পাওয়া নিয়েই কাড়াকাড়ি পড়ে যায়। বোলিং এ পেস আক্রমণ বিশ্বের মধ্যেই সেরাদের কাতারে পড়ে। আবার বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার রয়েছেন আমাদের দলে। তাই এখনকার সময়টায় ম্যাচজয় আমাদের অভ্যাসেই পরিনত হয়েছে। এখন আর রিকি পন্টিং এর উত্তরসূরীরা আমাদের বিরুদ্ধে হেসে খেলে জিতে যাবে এটা ভাবতে পারে না। তাদের বলতে হয়, “বাংলাদেশ আর প্লেয়িং ওয়েল,উই হ্যাভ টু প্লে আওয়ার বেস্ট টু ডিফিট দেম...”
কে জানে এই বাংলাদেশের উত্থান-পর্ব আর নবজাগরণ হয়ত অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে সেই জয় থেকেই শুরু হয়েছিলো...
- 0 মন্তব্য