হঠাৎ করে বাংলাদেশ, চারিদিকে বাংলাদেশ
পোস্টটি ২১৬৭ বার পঠিত হয়েছেসেবার বিলেত সফরের শুরু থেকেই বাংলাদেশ কোচ ডেভ হোয়াইটমোর বলছিলেন 'চমক আছে, চমক'। প্রস্তুতি ম্যাচ আর টেস্টে ভরাডুবির পরও তিনি ভাঙা ক্যাসেটের মতো সেই একই কথা বাজিয়ে যাচ্ছিলেন। তা নিয়ে আমাদের কত্ত হাসাহাসি! কিন্তু একদিন সত্যিই চমকে দিলেন হোয়াইটমোর ও তাঁর শিষ্যরা। পুরো বিশ্বকে অবাক, স্তব্ধ করে দিয়ে অস্ট্রেলিয়ান-অহং ধূলোয় মিশিয়ে, আকাশে উড়তে থাকা বিশ্বচ্যাম্পিয়নদের মাটিতে নামিয়ে এনে, শতাব্দীর অন্যতম বড় অঘটনটি ঘটিয়ে দিল, র্যাংকিংয়ের তলানিতে থাকা 'পুঁচকে' বাংলাদেশ। আর গোঁফো হোয়াইটমোরের আকন্ঠ বিস্তৃত হাসিতে যেন একটা কথা-ই ঠিকরে বেরোচ্ছিল, 'কি বলেছিলাম না, চমক আছে'!
অবিশ্বাস্য ও অচিন্তনীয় সেই ২০০৫ সালের ১৮ই জুনের সেই মহাকাব্যিক ম্যাচের স্মৃতিচারণা করতেই এই ১৮ই জুন এই লেখার অবতারণা।
রেকর্ড বুকের সোনালী দিনগুলি ফিরে আসুক আবার
খেলার মাঠে বীর ক্রিকেটাররা সফল হোক বারবার...
সেভাবে বলতে গেলে বাংলাদেশ ক্রিকেটে তখনও সোনালী সময় আসেনি। তবে 'সোনালী সময়' বলতে যদি সুদিন, বিজয়ের দিন, ম্যাচ-জয় বোঝায় তাহলে অবশ্য তেমন সময় খুব একটা কম ছিল না, আমাদের ছোট্ট ক্রিকেট ইতিহাসে। ক্রিকেট-কৌলিণ্যের দেশে যাওয়ার আগেই হয়ে গিয়েছিল প্রথম 'টেস্ট' জয়, সাথে সিরিজও। ওয়ানডে সিরিজও জেতা হয়েছিল। তবে প্রশ্নবোধক চিহ্নটা বসছিল তখনই, যখন প্রতিপক্ষের নাম টাটেন্ডা টাইবু'র ভাঙাচোরা জিম্বাবুয়ে!
তবু আগের বছরই বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে ভারত কে হারানো কিংবা জিম্বাবুয়েতে গিয়ে ফ্লাওয়ার ভাইদের শক্তিশালী জিম্বাবুয়েকে পরাজিত করা, এসবও সামর্থ্যের জানান দিচ্ছিল ভালোভাবেই।
তাই দিন দুয়েক আগে ইংল্যান্ডের কাছে (বলা ভালো ট্রেসকোথিক ও স্ট্রাউসের কাছে) লজ্জাজনক ১০ উইকেটের পরাজয়ের পরও, কার্ডিফের সোফিয়া গার্ডেনে খেলতে নামার সময়, আমরা স্বপ্ন দেখছিলাম ক্রিকেট মাঠের সোনালী দিনগুলো আবার ফিরে আসার। ভীষণভাবে কামনা করছিলাম, বীর ক্রিকেটাররা যেন সফল হন এবার।
সমালোচকের তোপের মুখে পড়েছি হাজার বার
ব্যাটে বলে খেলে মাঠে দিয়েছি কঠোর জবাব তার...
সময়টা আমাদের জন্য বড্ড কঠিন। মাত্রই দাঁড়াতে শেখা আমাদের টেস্ট স্ট্যাটাস তখন প্রশ্নের মুখে। নাক উঁচু ইংলিশরা, কৌলিণ্যের মিথ্যে অহংয়ে পারলে তখনই গলা টিপে ধরেন আমাদের ক্রিকেটের।
যদিও আমাদের 'কিশোর ব্যাটসম্যান' মুশফিককুর রহিমের টেকনিকে জিওফ্রে বয়কটের মতো কেউ কেউ তাজ্জব বনে গেছেন, কেউ আফতাব-বাশারের ব্যাটিংয়ে মুগ্ধ হয়েছেন, বিস্মিত হয়েছেন। কিন্তু সমালোচনা থামাননি কেউই। প্রতিনিয়ত আমাদের সামর্থ্য, সক্ষমতা নিয়ে উপহাস-বিদ্রুপে মেতে উঠছিলেন সুযোগ পেলেই।
সবাই যেন ভুলেই গিয়েছিলেন বাংলাদেশ মাত্র বছর পাঁচেকের টেস্ট-অভিজ্ঞ দল। এখনই তাদের কাছ থেকে বছর-পঞ্চাশের অভিজ্ঞতা আশা করা অন্যায়।
চারদিকের ভয়ংকর সব সমালোচনায় সমালোচিত আমাদের ক্রিকেট ও ক্রিকেটাররা। জবাবের জন্য মাঠের ক্রিকেটের দিকে, ব্যাট আর বলে সামর্থ্যের প্রমাণ দেখতে বড় আশা নিয়ে আমরা তাকিয়েছিলাম, আমাদের ক্রিকেটারদের দিকেই।
বাংলা মায়ের দামাল ছেলে খেলবে ছয়ে চারে
জয়ের নেশায় হেসে খেলে ভাঙবে উইকেট বারে বারে...
কি একটা পরীক্ষা ছিল সেদিন। পরীক্ষা দিয়ে এসে শুয়ে শুয়ে খেলা দেখছিলাম। শোয়া থেকে উঠে বসতে বাধ্য হই, যখন শুরুতেই এডাম গিলক্রিস্টকে 'শূণ্য' উপহার দিয়ে ফেরালেন মাশরাফি মর্তুজা। বৈশ্যও তুলে নিলেন মহা গুরুত্বপূর্ণ পন্টিংয়ের উইকেটটি। নাজমুল হেইডেনের উইকেট ভাঙলেন দ্বিতীয় বারের (প্রথমে একবার ক্যাচ আউট করলেও নো-বল হওয়ায় বেঁচে যান হেইডেন) প্রচেষ্টায়।
'আজ দিনটা আমাদের' গিলক্রিস্টকে কি সেটাই জানাচ্ছিলেন মাশরাফি
তিন উইকেট হারিয়ে কঠিন চাপে পড়ে গেছে বিশ্বজয়ী অস্ট্রলিয়া। আহা, কি আনন্দ আকাশে বাতাসে!
তখন বাংলাদেশের জয়ের দিনগুলো কিভাবে যেন আগে থেকেই আন্দাজ করা যেতো। খেলোয়াড়দের শরীরি অবয়বে ফুটে উঠতো 'বিনা যুদ্ধে নাহি দেব সূচাগ্র মেদিনী' ভাব। তবে কি আজকের দিনটাও আমাদের? নইলে মাশরাফি-বৈশ্য-নাজমুল পেসত্রয়ী এমন রুদ্রমূর্তি নেবেন কেন?
বেশীক্ষণ লাগলো না। আমাদের সুখ চিন্তার জগতকে এলোমেলো করে দিয়ে, ক্লার্ক-মার্টিন ও ক্যাটিচ-হাসিরা অস্ট্রলিয়াকে পৌছে দিলেন আড়াইশ’র চূড়ায়। অত উঁচুতে কি আমরা উঠতে পারব? কখনো উঠিনি যে!
তুষার ইমরান যেন জানালেন, কেন পারব না? ব্রাড হগ কে মারলেন টানা দুই বলে দুই চার। সেই চারের মার দেখার সৌভাগ্য হয়নি অধমের। সম্ভবত এশার নামায পড়তে নীচে গিয়েছিলাম। তখনকার সহপাঠী রিয়াদ ভাইয়ের সাথে কি কথা হয়েছিল পুরো ঠিক মনে নেই। তবে মনে আছে, রিয়াদ ভাই তুষারের চার মারার কথা বলেছিলেন। আর চার মারার চেয়েও গুরুত্ব দিয়েছিলেন, তাঁর মারার ধরণটাকে।
দুরু দুরু বুকে অপেক্ষায় প্রহর কাটে। শংকা জাগে, বাংলা মায়ের দামাল ছেলেরা চার-ছয়ে খেলতে পারবে তো আজ?
শোন গো জন্মভূমি জয় আনবো খুঁজে
চমকে দেবো পৃথিবী লাল সবুজে...
পরদিন সমাজ বিজ্ঞান পরীক্ষা। আব্বু কর্মসূত্রে বদলি হয়ে সুদূর রাঙামাটির লংগদুতে। আব্বুর অনুপস্থিতিতে যেন বিগড়ে না যাই, আম্মু তাই বাড়িয়ে দিয়েছেন শাসন। বিকেলে যা খেলা দেখার দেখেছি। সন্ধ্যায় বসতে হলো বই নিয়ে।
ওদিকে বাংলাদেশ একটু একটু করে জয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এদিকে আমি খেলা না দেখার ছটফট-যন্ত্রণায় মরছি।
হেঁটে হেঁটে পড়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। সামনের রুম অন্ধকার। দরজাটা খুলে রেখেছি, বাতাস আসবে এই কথা (পড়ুন, ছুতো) বলে। হাঁটতে হাঁটতে বইটা ধরেই এক ছুটে বাসা থেকে বেরিয়ে পাশের বাসায় ঢুঁ মেরে আসি। কয়েক সেকেন্ডেই স্কোরটা দেখে নিই। স্বস্তি পাই আশরাফুল-বাশার তখনো আছে দেখে। ৭২ থেকে ২০২ পর্যন্ত নিয়ে গিয়েছিলেন এই দু'জন। ১৩০ রানের পার্টনারশিপ। হাবিবুল বাশার আউট হয়ে গিয়েছিলেন ৭২ বলে ৪৭ করে। এসব সেই থেকে এমনভাবে মুখস্ত হয়ে গিয়েছে যে, পরিসংখ্যান দেখা লাগে না আর।
আশরাফুল আস্তে আস্তে এগিয়ে যাচ্ছেন সেঞ্চুরীর দিকে। আজ কি সত্যিই জয়ের খোঁজ পেয়ে যাবো আমরা? পৃথিবীকে চমকে দিতে পারবো, লাল সবুজে?
সূর্য নিয়ে উড়ছে সবুজ অবাক মানুষ জন
কে শোনেনি আমার দেশের বাঘের গর্জন
লাল সবুজের এই পতাকা যাচ্ছে নতুন দিনে...
আর অপেক্ষা করতে পারলাম না। আম্মুকে বললাম, বাংলাদেশ অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে দিচ্ছে। বলতে বলতে ছেড়ে দিলাম টিভিটা। আম্মুও বসে গেলেন আগ্রহ নিয়ে, বাংলাদেশ কি করে দেখার জন্য।
ম্যাকগ্রাকে আলতো টোকায় লগ অনে ঠেলে দিয়ে, আশরাফুল পৌছে গেলেন তিন অংকের জাদুকরি সংখ্যায়। আশার ফুল হয়ে ফুটলেন আশরাফুল, করলেন সেঞ্চুরী। এই প্রথম দেখলাম কোন বাংলাদেশী ওয়ানডে ক্রিকেটে সেঞ্চুরী (অপির সেঞ্চুরী দেখা হয়নি আমার) করছেন, হ্যালমেট খুলছেন, ব্যাট উঁচিয়ে ধরছেন, সিজদা দিচ্ছেন... সব যেন স্বপ্ন স্বপ্ন লাগে। সত্যি সত্যি ঘটছে তো? পাশের বাসা থেকে চিৎকার ভেসে আসে। আমাদের বাসায় চিৎকার নেই, আছে কেবল গভীর উদ্বেগ।
অপরিচিত এক দৃশ্যের অবতারণা হলো কার্ডিফের সবুজ প্রাঙ্গনে
সারা শরীর জুড়ে ভয়ংকর কাঁপুনি টের পাচ্ছি। লোমগুলো সব যেন দাঁড়িয়ে গেছে। আশরাফুল গিলেস্পির বলে ধরা পড়লেন বাউন্ডারীর কিছুটা আগে। হায় হায়, এখন কি হবে?
খালেদ মাসুদের বদলে রফিককে পাঠানো হলো। ড্রেসিংরুমে দেখা যাচ্ছে মাশরাফিকে, তিনিও তৈরী। যেন প্রয়োজন দেখা দিলেই যুদ্ধ ক্ষেত্রে নেমে পড়বেন। ধারাভাষ্য কক্ষে কে ছিলেন মনে নেই, তবে দেখেছিলাম আতহার আলী খানকে পাখা দিয়ে বাতাস করছিলেন আর তা করে মজা নিচ্ছিলেন।
শেষ ওভারটি গিলেস্পি করতে এলেন, ছয় বলে সাত দরকার। প্রথম বলেই আফতাব একটু এগিয়ে এসে উড়িয়ে মারলেন, সীমানা দড়ি পেরিয়ে গেল বল। ছয়। পরের বলটা কি যে হলো কেউ বুঝলো না। উইকেটের কাছেই বলটা রেখে, রফিক শুধু ‘আয় আয়’ মতো কি একটা বলে দৌড় মারলেন। আফতাবও সায় দিয়ে, দিলেন ভোঁ দৌড়।
সে কী দৌড়! এক দৌড়েই হয়ে গেল ইতিহাস, মহাকাব্য!
একটি জয়েই সারা বিশ্বকে যেন নতুন এক বার্তা দেয়া, অন্তহীন সামর্থ্যের জানান দেয়া, এক অনাগত নতুন আলোকাজ্জ্বল ভবিষ্যতের এক টুকরো আভাস দেয়া...।
হঠাৎ করে বাংলাদেশ
চারিদিকে বাংলাদেশ...
সারা রাত ঘুমাতে পারিনি আর। কি এক সুখ যন্ত্রণায় কেবল এপাশ-ওপাশ করে ভোর করে ফেলেছিলাম। পন্টিংয়ের সেই বিহ্বল, হতচকিত দৃষ্টি আর যন্ত্রণাদগ্ধ অভিব্যক্তির চেয়ে সুখকর দৃশ্য বুঝি আর হয় না।
কখনো কখনো অতি সুখও তাহলে নিদ্রাহীনতার কারণ হয়!
লজ্জা, অপমান, হতাশা, বিস্বাদ সব যেন মিলেমিশে একাকার
এমন এক-একটা দিন আসতো, তখন হঠাৎ চারপাশে কেমন একটা বাংলাদেশ বাংলাদেশ রব উঠে যেতো। বিশ্বমিডিয়াগুলো এক সুরে বাংলাদেশের প্রশংসায় হয়ে যেতো পঞ্চমুখ। দেশের সবকটা পত্রিকা, টিভি চ্যানেল বড় সাধ করে বিশাল বিশাল রিপোর্ট করত। কি সব সময়!
কোন কোন চ্যানেল ক্রিকেট নিয়ে চমৎকার সব গানগুলি প্রচার করত। কখনো কখনো কিংবদন্তী সংগীত শিল্পী ও সুরকার লাকী আখন্দের অমর-সৃষ্টি সেই ‘হঠাৎ করে বাংলাদেশ, চারিদিকে বাংলাদেশ’ বেজে উঠতো। আমরা বড় আবেগে সেসব শুনতাম।
মনে হতো, সত্যিই বুঝি আজ চারদিকে শুধুই বাংলাদেশ।
পুনশ্চ : এই 'হঠাৎ করে বাংলাদেশ' গানটির সাথে '৯৯ বিশ্বকাপটাও জড়িয়ে আছে। তখন শুভ্রদেবের 'গুডলাক বাংলাদেশ' আর এই গানটি খুব প্রচার করা হতো। গানটির আবেগ-অনুভূতি যদি আপনি এই বর্তমান সময়ে এসে প্রথম বুঝতে চান, তাহলে হয়তো আপনি সফল না-ও হতে পারেন। তবে গত শতকের শেষ আর এই শতকের শুরুর দিকে যারা বাংলাদেশ ক্রিকেটের সাথে ছিলেন, তাঁরা খুব ভালোভাবেই এই গানটিকে বুঝতে পারেন। অনুধাবন করতে পারেন।
গানটি সংগ্রহে থাকায়, এখানে দিয়ে দেয়া হলো।
গীতিকার, সুরকার ও শিল্পী : লাকী আখন্দ
কৃতজ্ঞতা :
'বাংলাদেশ জেগে উঠো, বাংলাদেশ গর্জে উঠো' -শুভ্র দেব
'১৬ কোটি প্রাণ একটাই গান' -বাপ্পা মজুমদার
'বেশ বেশ সাবাশ বাংলাদেশ' -আসিফ আকবর
'বাংলাদেশ বাংলাদেশ জেগে উঠো বাংলাদেশ' -কুমার বিশ্বজিৎ
'ও পৃথিবী এবার এসে বাংলাদেশ নাও চিনে' -ইবরার টিপু
এবং...
'হঠাৎ করে বাংলাদেশ, চারিদিকে বাংলাদেশ' -লাকী আখন্দ
- 0 মন্তব্য