• ফুটবল

ক্লাব ফুটবলের সেকাল এবং "আকাল"

পোস্টটি ৬৭৯৩ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

কালের বিবর্তনে বাংলাদেশের অনেক প্রাণীই বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে। অনেক নদীই শুকনো ধূ ধূ প্রান্তর হয়েছে। বুড়িগঙ্গার জল হয়েছে আরো বেশি ঘোলাটে । মানুষের কত আবেগ অনুভূতিগুলো সাবেক হয়ে গিয়েছে। যেমনটি হয়েছেন দেশের ফুটবলের নক্ষত্ররা। ঢাকা স্টেডিয়াম এর মাঠ এখন যেনো স্রোতবিহীন নদী। 

আশির দশকে সেইদিনগুলো...

ফুটবলটা রক্তের সাথে মিশে আছে আমাদের। শ্রাবণদিনের বর্ষনমুখর সময়ে ফুটবল খেলে গাঁয়ে কাঁদার মাখামাখি করেননি এমন মানুষ এই দেশে নেই। স্বাধীনতার পর দেশে মানুষের বিনোদনের সবচেয়ে বড় জায়গাটি ছিলো ফুটবল। সর্বত্র মানুষের তর্ক বিতর্কে চায়ের দোকান পাড়া মহল্লায় সকলের হৃদয়জুড়েই ফুটবল একটি বিশেষ জায়গা করে নিয়েছিলো।

স্কুল কলেজের ছেলেমেয়েরা একজন আরেকজনকে খোঁচা দিতো প্রতিপক্ষের নামে উলটা-পালটা বকে। কেউ আবাহনীর সমর্থক হলে বলতো, "ইলিশ মাছের তিরিশ কাঁটা,বোয়াল মাছের দাড়ি,মোহামেডান ভিক্ষা করে আবাহনীর বাড়ি..."। আবার মোহামেডান এর সমর্থকরা এর উল্টোটা বলতো।

432197_207850065989327_799428157_n

মোটামুটি সবার কাছেই ফুটবল ছিলো। বিকেলের শেষ আলো মিলিয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত খেলা চলতো সবার। ৫ নাম্বার সাইজের "MIKASA" বল যার কাছে ছিলো পাড়ার মধ্যে সেই ছিলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন ব্যাক্তি। তার সাথে সবার ভাব ভালো ছিলো। সেই ছেলেটির সাথে মিশে মিকাসা বল দিয়ে খেলতে চাইতো সবাই। এমনটাই ছিলো সেইসময়কার দিনগুলো।  ফুটবল এর ক্রেজ এতটাই যে সেই সময় ফুটবল নিয়ে গানও তৈরি হয়েছে বাংলা সিনেমায়। "জয় আবাহনী,জয় মোহামেডান..." গানটাও সবার মুখে মুখে তখন।

  

এখন আমরা দল বেঁধে ক্রিকেট খেলা দেখি। বাংলাদেশ জিতে গেলে সবাই মিলে ভীষণ হৈ চই হয়। এলাকার ছেলেরা মিলে পতাকা নিয়ে মিছিল বের করে। আশির দশকেও এই উন্মাদনা হতো। সেটি ফুটবল নিয়ে। এলাকায় এপাড়া ওপাড়া মিলে ফুটবল ম্যাচ এর আয়োজন হয়। সব বয়সের মানুষ জড়ো হয় খেলা দেখার জন্য। আমাদের গ্রামে ফয়জল ভাই নামে একজন ছিলেন। বয়সে অনেক বড় যদিও তিনি। আশির দশকে গ্রামের এক ফুটবল টূর্নামেন্ট এ গোল দিয়ে তিনি ব্যাপক সুনাম কুড়ান। তিনি যেই মেয়েটিকে পছন্দ করতেন সেও খেলা দেখতে এসেছিলো। ফয়জল ভাইকে মেয়েটি শর্ত দিয়েছিলো গ্রামের হয়ে এই কাপ জিততে পারলে মেয়েটি তাকে বিয়ে করবে। এখন ফয়জল ভাই এর দুই ছেলে এক মেয়ে। আর সেই মেয়েটি তার তিন সন্তানের মা। এইসব হচ্ছে সেই সোনালী সময়কার কথা। ফুটবল তখন এতটাই জীবনের সাথে মিশে গিয়েছিলো।

 

 আবাহনী মোহামেডান দ্বৈরথ... 

 বাচ্চু মিয়া ইসলামপুরে কাপড়ের ব্যবসায় করেন। আজ অবশ্য তিনি দোকান বন্ধ রেখেছেন। বিকেলে ঢাকা স্টেডিয়ামে আবাহনী মোহামেডান এর খেলা। তিনি মোহামেডান সাপোর্টার। বীর মহসীনকে বেশি পছন্দ করেন। এই ছেলেটা গোলপোস্ট এর সামনে একাই পাহাড় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে।

চায়ের দোকানদার শফিক আলীর মন মেজাজ আজকে অন্য দিনের চেয়ে বেশি ভালো। তার চেহারা চকচক করছে। খেলা উপলক্ষ্যে গত কয়েকদিন ধরে দোকানটায় সবসময় ভীড় লেগে আছে। ম্যাচ যদিও আজকে,তবুও ম্যাচ এর এক সপ্তাহ আগে থেকে মানুষের আগ্রহের সীমা নাই। এইতো গতকাল বড় বাজারের মিয়াঁ বাড়ির দুই ভাই মারামারি লেগে গিয়েছিলো। সম্পর্কে ভাই হলেও খেলার ব্যাপারে কেউ কাউকে ছাড় দেয় না। বড়টা আবাহনীর স্ট্রাইকার আসলাম এর ভক্ত। ছোট ভাই আবার মোহামেডান ডিফেন্ডার কায়সার হামিদ এর ভক্ত। এই নিয়ে কথা কাটাকাটি জের ধরে এক সময় তারা হাতাহাতি শুরু দিলো।

13418697_1018992374858509_3594822085910795691_n

রাশুরা সবাই ক্লাস টেন এ পড়ে। আবাহনী মোহামেডান এর খেলা। সবাই পতাকা লাগাচ্ছে। কে কার থেকে বড় পতাকা উড়াবে এই নিয়ে ভীষণ প্রতিযোগিতা। গতবার এলাকায় আবাহনীর সবচেয়ে বড় পতাকা উড়িয়েছিলো ওরা। এইবার ওই পাড়ায় মুন্নারা মোহামেডান এর সবচেয়ে পতাকা লাগাবে বলে উড়া উড়া খবর পাওয়া গেছে। খেলার আগেই পুরো শহর পতাকার ছায়াতলে। সেলাই শিল্পীরা পতাকা সেলাই এ ব্যস্ত সময় পার করছে। 

এই দিকে সারাদিন অপেক্ষা করেও ম্যাচ এর একটা টিকেটও কিনতে পারেনি সাব্বির। ফুটবলটা তার বড় ভালো লাগে। সেও চায় বাংলার ম্যারাডোনা খ্যাত ওয়ালি সাব্বির এর মতো খেলোয়াড় হতে। বিদেশী খেলোয়াড় এমেকার খেলাও তার খুব পছন্দ। অথচ, সে খেলা দেখতে যেতেই পারবে না। টিকেটের জন্য গতকাল মারামারি হয়েছে। আবাহনী মোহামেডান খেলার টিকেট পাওয়া মানে মোটামুটি বিশ্বজয় করে ফেলার কাছাকাছি কিছু একটা। ব্ল্যাকে কিছু টিকেট আছে বলে সে শুনেছে। ঠিক করেছে যদি টিকেট পায় প্রয়োজনে তিন গুন বেশি দাম দিয়ে হলেও টিকেট নিয়ে খেলাটা দেখবে। মোহামেডান এর খেলা মিস করা সম্ভব না। 

 এই খন্ডচিত্রগুলো আশি-নব্বুই দশকের নিয়মিত এক চিত্র। দেশের ৯০ শতাংশ মানুষ আবাহনী কিংবা মোহামেডানের সমর্থক ছিলেন। মাঠেও দুই দলের খেলোয়াড়রা যেনো খেলা নয় যুদ্ধে নামতেন। সাজ সাজ রব চারিদিকে। মাঠের উত্তাপ বাইরে ছড়িয়ে পড়তো। এই দুই চিরপ্রতিধন্ধীর খেলা হলে মানুষ ও দুই ভাগ হয়ে যেতো। নিজ দলকে এরা সমর্থন দিতেন পাগলের মতো। এখন আমরা আর্জেন্টিনা ব্রাজিল কিংবা বার্সা-রিয়াল এর ম্যাচ হলে যেমনটা করি তার চেয়েও বেশিই উন্মাদনা ছিলো তখন। কোনো কোনো দিন মাঠে হাঙ্গামা বা মারামারি হলে সেটির রেশ ছড়াতো মাঠের বাইরেও। পল্টন-গুলিস্থান বাইতুল মোকাররমের আশে পাশে রনক্ষেত্র তৈরি হতো। এমনই গরম ছিলো দেশের ফুটবল। 

Mohammad Lutfar Rahman Binu 1984 club

শূন্য মাঠ এবং প্রানহীন ফুটবলের শুরু

আইসিসির সদস্যপদ পেয়ে বাংলাদেশের স্পোর্টস জগতের এক নবযাত্রার শুরু। ক্রিকেটটা ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হতে শুরু করলো। ফুটবলটা এক বর্ষার "পার্টটাইম" শখের খেলা হয়েই হারিয়ে যেতে বসলো। এর বদলে ব্যাট,স্ট্যাম্প আর টেপ টেনিসের রাজত্ব শুরু হলো। 

 ক্রিকেটের উত্থান যতটা না ফুটবলের জনপ্রিয়তা হারিয়ে যাওয়ার কারন তার চেয়ে বেশি দায়ী ফুটবল অবকাঠামো এবং ভালো মানের খেলোয়াড় উঠে না আসা। 

 নব্বুই দশকের মাঝামাঝি এক সময়ে লীগে বিদেশী খেলোয়াড় কোটা বন্ধ করা হয়েছিলো। সেবার দর্শকরা তেমন আগ্রহ দেখাননি,মাঠে আসেন নি খেলা দেখতে। সেই থেকেই দর্শকখরার শুরু ঢাকা লীগে। এছাড়া মিরপুর স্টেডিয়ামকে ক্রিকেটের উন্নয়নের খাতিরে ছেড়ে দিতে হয়েছিলো। ধীরে ধীরে দেশের তারকা ফুটবলাররাও অবসর নিতে শুরু করলেন,কেউ কেউ দলে অপাংতেয় হয়ে পড়েছিলেন। এই তারকা সংকট আর কাটিয়ে উঠতে পারলো বাংলার ফুটবল। ফুটবলারদের পারিশ্রমিক কমে গেলো,স্পন্সররা ফুটবলে আগের মতো সহযোগিতা করছিলো না। অথচ ৮৬-৮৯ সালেই সাড়া জাগানো ডিফেন্ডার কায়সার হামিদ সর্বোচ্চ পারিশ্রমিক পেতেন। এই সময়টায় তার পারিশ্রমিক উঠানামা করেছিলো ১০ থেকে ১৫ লাখে ! 

স্কুল ফুটবল থেকে শুরু করে জাতীয় লিগ ফুটবল কোনোটিই ঠিক পথে চলছে না। ভালো ফুটবলের প্রদর্শনী করতে পারছেন না খেলোয়াড়রা। ক্লাব ফুটবলের আমেজ নস্ট হয়ে গিয়েছে অনেক আগেই। এক সময় দলবদলের সময় সবাই চোখ কান খোলা রাখতো। কে কোন দলের হয়ে খেলছে সেটি নিয়ে বিস্তর আলোচনা। এখন দলবদল হয় অনেকটা দায়সারা গোছের। ফুটবল খেলে জীবন চালানোর সিদ্ধান্ত নেয়াটাও যুগের সাথে যাচ্ছে না। যখন সব অর্থকরী নিয়ে ক্রিকেটারদের পেছনে ছুটছে স্পন্সর থেকে হর্তাকর্তারা। ফুটবলের মাঠে এখন আর বিনা টিকেটেও দর্শক এর দেখা মেলে না। ফুটবলের রুপকথা যেনো আজ চুপকথা হয়ে গিয়েছে।

 

মনে রবে কি না রবে ফুটবল'রে

 দেশের ফুটবল এর সোনালি দিনের কীর্তির ইতিহাস আজ পরিহাসে রুপ নিয়েছে। সবাই যখন যখন কোপা,ইউরো অথবা লীগের রিয়াল-বার্সা কিংবা নয়া ইংলিশ রুপকথা লিখা লেস্টার সিটিকে নিয়ে মুগ্ধ হওয়ার মাতম তুলছে তখন সত্যিই মন খারাপ হয় নিজের দেশীয় ফুটবল অতীতের কথা ভেবে। এই প্রজন্ম দেশের ফুটবলের দৈন্যদশা দেখছে। তাই ফুটবল প্রেমী হিসেবে হয়ত বিদেশী লীগ দেখে ফুটবলীয় ক্ষুদা মিটাচ্ছে সবাই। এক সময় কি তবে দেশের ফুটবল এর ইতিহাসগুলো মুছেই যাবে ফুটবলের এই দৈন্যদশার আড়ালে  অথবা বিদেশী লীগের জনপ্রিয়তায়?  

 ( প্রচ্ছদ ছবি এবং শেষ ছবি কৃতজ্ঞতাঃ মোহাম্মদ লুতফুর রহমান বিনু )