একটি উপহারই চাইতাম সবার কাছে;সেটি হলো ফুটবল -মেসি
পোস্টটি ৪২৯৯ বার পঠিত হয়েছেবিপ্লবী চে গুয়েভারা যেখানে জন্মেছিলেন তার ঠিক ৫৯ বছর পর ১৯৮৭ সালে একই এলাকায় আরেক মহান বিপ্লবীর জন্ম হলো। আর্জেন্টিনার রোজারিও'তে। ২৪শে জুন ছিলো ক্যালেন্ডারের পাতায়। লুইস লিওনেল আন্দ্রেস মেসি নামে এক ভয়াবহ শৈল্পিক বিপ্লবী'র আগমন হলো ধরণীতে। এই মানুষটিই যে গোটা ফুটবল খেলাটায় নতুন ধরণের এক বিপ্লব এনেছেন,নতুন এক মাত্রায় নয়া এক উচ্চতায় নিয়ে গেছেন ফুটবলকে সেটি হয়ত তার ঘোরতর শত্রুও প্রকাশ্যে না মানলেও ভেতরে ভেতরে ঠিকই টের পান।
ইতালি বংশোদ্ভূত এক মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মেছিলেন মেসি। বাবা জর্জ নিজে এক স্থানীয় ফুটবল দলের কোচ ছিলেন। রক্ত বেয়ে বেয়ে ফুটবল তাই হয়ত মেসির উপর ভর করেছে প্রাকৃতিক কোনো এক নিয়মে। সেই মেসিই শেষমেষ ফুটবল নিয়ে যা করে দেখিয়ে যাচ্ছেন অনেকগুলো বছর ধরে তাতে ফুটবল এবং মেসি দুই শব্দকে যুগলবন্ধী করার কাজটা ফুটবলপ্রেমীদের জন্য খুব সহজই হয়ে যায়।
দৈব ঘটনা বিশ্বাস না করলেও আমাদের মাঝে মধ্যে মেনে নিতে হয় জাগতিক নিয়মকানুন কিংবা প্রাত্যহিক রুটিন করা ঘটনার বাইরেও অলৌকিক অসাধারণ কিছু ঘটে। মুখে মুখে আজ যে মানুষটার নাম,শীত কিংবা রমজানের রাতে অথবা উষ্ণতম রজনীতে রাতভর ঘুমের আলস্য এড়িয়ে যার খেলা দেখে বড় হচ্ছে একটি প্রজন্ম সেই মেসি'র হয়ত কখনো ফুটবল খেলার সুযোগই হতো না। মাত্র ১১ বছরের শিশু মেসির বিরল এক অসুখ দেখা দেয়। যেই অসুখ সাময়িক সুখ কেড়ে নিলো তার পরিবারের। হরমোন বাড়ে না। স্বাভাবিকভাবে অন্য সবার মতো বেড়ে উঠতে পারবেন না মেসি। চিকিৎসা'র প্রচুর খরচ। মাসে প্রায় ৯০০ ডলার !
এর মাঝে অবশ্য মেসির প্রতিভার কিছু ঝলক অনেকেই দেখেছে। দেখেছে বলেই স্থানীয় ক্লাব রিভার প্লেট মেসি'র প্রতি আগ্রহ দেখিয়েছিলো। তবে তারা মেসির চিকিৎসার ভার বহন করতে পারবেন না এটাও জানিয়ে দিয়েছিলেন। এমনই এক সময়ে স্পেনের বার্সোলোনা দলটির তখনকার পরিচালক চার্লস রেক্সাস মেসির সম্পর্কে জানতে পারলেন। তিনি মেসিতে এতটাই মুগ্ধ হন যে হাতের কাছে কোনো কাগজ না পেয়ে একটা ন্যাপকিন পেপারে চুক্তি করেন। বার্সোলোনা সিদ্ধান্ত নিলো তারাই দেবে মেসির চিকিৎসার যাবতীয় খরচ !
.১৭ বছর বয়সে এই মানুষটির লীগে অভিষেক হলো এস্পানেওল এর বিপক্ষে। সেই সময়ে বার্সোলোনার সবচেয়ে কমবয়সী গোল স্কোরার হন তিনি। ২০০৫ এর সেপ্টেম্বরে তিনি স্পেনের নাগরিকত্ব পান।
২০০৪ এ তাকে তাকে স্পেন অনুর্ধ ২০ জাতীয় দলে খেলার প্রস্তাবও দেয়া হয়। তিনি বলেছিলেন, "আমি মনে প্রাণে একজন আর্জেন্টাইন। আর্জেন্টিনার জার্সির প্রতি যা অনুভব করে সেই ধারণাকে কেউ কখনো পরিবর্তন করতে পারবে না।" এরপর পরই তিনি আর্জেন্টিনার হয়ে খেলেন এবং ফিফা ইয়ুথ চ্যাম্পিয়নশীপ জয়ে ভূমিকা রাখেন সর্বোচ্চ গোল করে। ২০০৮ সালে তিনি অলিম্পিক ফুটবল আসরে গোল্ড মেডেল পান। সে বছর আর্জেন্টিনা বিজয়ী হয়। তবুও আজকাল অনেকেই বলে থাকেন মেসি'র নিজ দেশের হয়ে তেমন কোনো অর্জন নেই।
মানবিক মেসির কথাও আড়ালে পড়ে যায়। মেসির নিজেরই একটি ফাউন্ডেশন আছে। "লিও মেসি ফাউন্ডেশন" নামে। এই সংগঠন থেকেই তিনি শিশুদেরকে স্বাস্থ্য এবং শিক্ষাক্ষেত্রে যাবতীয় সহযোগিতা করেন। তিনি ইউনিসেফ এর "গুডউইল এম্বাসেডর" হিসেবেও কাজ করছেন। ২০১৩ সালে তিনি নিজের এলাকায় একটি শিশু হস্পিটালে ৮১২০০০ ডলার দান করেছেন। মানবিক মেসির উদাহরণও তার অসংখ্য কীর্তির মতো বলে শেষ করবার নয়।
মেসি ফুটবলের ইতিহাসে প্রথম এবং একমাত্র খেলোয়াড় যিনি পাচটি ফিফা ব্যালন ডি'অর পুরস্কার জিতেছেন। এছাড়া প্রথম খেলোয়াড় হিসেবে তিনি তিনটি ইউরোপীয়ান গোল্ডেন শু পুরস্কারও জিতেছেন। বার্সেলোনার হয়ে মেসি সাতটি লা লিগা, দুইটি কোপা দেল রে, পাঁচটি স্পেনীয় সুপার কোপা, চারটি উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লীগ, দুইটি উয়েফা সুপার কাপ এবং দুইটি ফিফা ক্লাব বিশ্বকাপ শিরোপা জিতেছেন। এত অর্জনের পরও মাঠে তিনি শান্ত। গোল করে শুধু আকাশের দিকে দুই হাত উচু করে তুলে ধরেন। এটি করেন তিনি তার দাদীর জন্য। মেসি বিশ্বাস করেন,তার দাদী অন্য গ্রহে বসেও তার খেলা দেখছেন,তার অর্জনে সেও খুশি হয়।
তবুও বারবারই সমালোচিত হন। অভিযোগ কারো কারো,তিনি জাতীয় দলে সেরা খেলাটা খেলতে পারেন না। ফুটবল খেলাটা যে ১১ জনের সম্মিলিত দলগত খেলা এটিই হয়ত ভক্তরা ভুলে যান। একা মেসি তারপরও চেস্টা করে যান সব সমালোচনা মাথা পেতে নিয়েই। টানা তিনটি বড় ফুটবল ইভেন্টের ফাইনাল এ পৌঁছানো তো সেই সাক্ষ্যই দেয়। দূর্ভাগ্য তিনি একবারও চ্যাম্পিয়ন দলের অংশ হতে পারলেন না এই তিন প্রতিযোগিতায়। শেষ মেষ অভিমান করেই হয়ত আজ ২৭ জুন বিদায় জানিয়েছেন জাতীয় দলকে।
এক সাক্ষাতকারে একবার মেসি বলেছিলেন, "আমি অনেক ছোটবেলায় প্রথম ফুটবল উপহার পেয়েছিলাম। তখন আমি অনেক ছোট; আমার বয়স মনে হয় তিন কিংবা চার হবে। সেটি আমার জন্য সবচেয়ে বড় উপহার ছিল। তার পর থেকে ক্রিসমাস হোক আর জন্মদিনই হোক না কেন, আমি সব সময়ই একটি উপহার চাইতাম সবার কাছে; সেটি হলো ফুটবল।" এই ফুটবলকেই তো তিনি জীবনের সব উপহার দিয়েছেন,দিয়ে চলেছেন এখনো। ফুটবল অনেক পেয়েছে মেসির কাছ থেকে,তবে তাকে ফিরিয়ে দিয়েছে শূন্য হাতে। মেসি হয়েছেন আর্জেন্টিনার এক ট্র্যাজেডির নায়ক।
সবাই মনে রাখবে তবুও আপনাকে প্রিয় লিওনেল মেসি ! পাঁচ ফুট সাড়ে ছ'ইঞ্চি শারীরিক উচ্চতার মানুষটি ফুটবলকে যে উচ্চতায় নিয়ে গেছেন তা সকল ফুট-ইঞ্চি-মিটারের বাইরে। আকাশছোঁয়া যার কীর্তি তাকে মর্ত্যলোকের মানুষ স্মরণ করবে যুগান্তর পেরিয়ে অন্য কোনো সময়ে। যে সময়ে আমরা সাধারণ মানুষেরা হয়ত থাকবো না,থাকবে,সত্যিই টিকে থাকবে মেসিময় রাতগুলোর মুগ্ধতা !
- 0 মন্তব্য