• অন্যান্য

কিভাবে হয় কিংবদন্তি?

পোস্টটি ১১৩৩৯ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

৯টি মাত্র আন্তর্জাতিক গোল, ইউরো কিংবা বিশ্বকাপেও কোনোদিন খেলেননি, দুইটি মাত্র ঘরোয়া লিগ শিরোপা- ক্যারিয়ারে এই রেকর্ড থাকার পরেও কাউকে কি সমর্থক-বোদ্ধারা সেরা বলে রায় দিয়ে দেয়? আর একজন অ্যাথলেট, যাঁর অলিম্পিক স্বর্ণ চারটি, তাঁর থেকে বেশি স্বর্ণ আছে আরো ৭০ জনের। কিন্তু ওই সত্তরজনের প্রায় সবাইকে বাদ দিলেও তাঁকে বাদ দিয়ে অন্তত অলিম্পিক ইতিহাস লেখা যাবেনা।

 

বুদ্ধিমান পাঠক হয়ত এরমধ্যেই বুঝতে পেরেছেন কাদের কথা বলা হচ্ছে উপরে। প্রথমজন জর্জ বেস্ট; যাঁকে পেলে পর্যন্ত তাঁর দেখা সেরা খেলোয়াড় বলে রায় দিয়েছিলেন। আর পরেরজন জেসি ওয়েন্স, আশি বছর আগের এক অলিম্পিকে হিটলারের রক্তচক্ষুকে যিনি পরোয়া করেননি এইটুকুও।

 

শুকনো সংখ্যা কিংবা পরিসংখ্যানের তাই আসলে সাধ্য নাই, কোনো খেলোয়াড়ের কিংবদন্তী হয়ে ওঠার চূড়ান্ত মাপকাঠি হবার। সংক্ষিপ্ত ক্যারিয়ারের কেউও তাই খুব বেশিকিছু না জিতেও দর্শকের মন জয় করে নিতে পারেন ছোট্ট কোনো ঘটনায়।

 

পাওলো রসির কথাই ধরুন না! আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে মাত্র ২০ গোল, ঘরোয়াতে সেই সংখ্যাটা কোনোরকমে একশ’ পেরিয়েছে। কিন্তু তিনি কিংবদন্তী হয়ে থাকবেন মাত্র তিন ম্যাচের জন্য। বিরাশির বিশ্বকাপের আগে জেল খেটে আসা আসামী ছিলেন রসি। কোচের প্রিয়পাত্র হয়ে গ্রুপ পর্বের ম্যাচগুলোতে সুযোগ পেয়েও কাজে লাগাতে পারছিলেন না। ফুল হয়ে ফুটলেন টেলে সান্তানার ব্রাজিলের বিপক্ষে; জোগো বনিতার আদর্শ উদাহরণ হয়ে থাকা জিকো-সক্রেটিস-ফ্যালকাওদের দলের বিপক্ষে। রসি সেই ম্যাচে করলেন হ্যাটট্রিক, পরে সেমিতে জোড়া গোল আর ফাইনালে আরেকটি। সেই বিশ্বকাপের আগে আরেকটি বিশ্বকাপেও তিন গোল আছে রসির, একসময় ছিলেন দলবদলের সবচেয়ে দামি খেলোয়াড়। কিন্তু রসিকে সবাই মনে রাখবে জুলাইয়ের পাঁচ থেকে এগারো, ওই সাতদিনে করা ছয় গোলের জন্যই।

 

মাঠের চেয়ে মাঠের পেছনের গল্পগুলোই বেশি ভালোবাসে লোকে। তাই রকি মারসিয়ানো, মেওয়েদার, রিকার্ডো লোপেজেদের বক্সিং রেকর্ড ঢের ভালো হলেও লোকের কাছে ‘দ্য গ্রেটেস্ট’ একজনই, মোহাম্মদ আলী! সেটাতে কি ক্যারিয়ারের তুঙ্গে থেকেও ভিয়েতনাম যুদ্ধে না গিয়ে বক্সিং থেকে তিন বছর নির্বাসনে থাকার কিছুটা হলেও হাত নেই? সাথে হয়ত আপনার মনে এসে গেছে ফকল্যান্ড যুদ্ধের ক্ষত বুকে নিয়ে থাকা আর্জেন্টাইনদের তাতিয়ে দেয়া ম্যারাডোনার দুই গোলের কথা। চিরকাল মার খেয়ে আসা দুর্বলের একরত্তি প্রতিশোধও কি ছিল না ইংল্যান্ডের সাথে ম্যাচটি? কিংবদন্তী তো এভাবেই তৈরি হয় কালে কালে।

 

মেসিকে নিজ দেশের লোকের ভালোবাসা পেতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয় তাই, কাতালানসহ বিশ্বের তাবৎ লোকের ভালোবাসা পেয়ে গেছেন যদিও অনেক আগেই। টানা তিন ফাইনাল হারের কান্না বোধ হয় অবশেষে গলাতে পেরেছে আর্জেন্টাইনদের মন। ছোটবেলার হরমোন সমস্যার গল্পটাও সেখানে বাড়তি উপাদান। আরেকদিকেই দেখুন না, তিন বিশ্বকাপ জিতে জুলেরিমে ট্রফির নাইকি দেবিকে নিজের করে নিলেও ব্রাজিলিয়ানরা কিন্তু পেলের চেয়ে বেশি ভালোবাসে তাদের ‘ছোট্ট পাখি’ গারিঞ্চাকে। কোনো বিশ্বকাপ কিন্তু একার কারিশমায় জেতাননি ‘কালোমানিক’ পেলে। সুইডেনের বিশ্বকাপে ছিলেন একদমই তরুণ আর বাষট্টির বিশ্বকাপে দ্বিতীয় ম্যাচের পর থেকে টুর্ণামেন্টের বাকিটা সময় ইনজুরির খপ্পরে পড়ে সাইডলাইনে ছিলেন বসে। চিলির সেই বিশ্বকাপটা কিন্তু প্রায় একাই জিতিয়েছিলেন গারিঞ্চা, সাথে জিতে নিয়েছিলেন ব্রাজিলিয়ানদের মনও।  

 

ক্রিশ্চিয়ানো ইউরো জিতলেন প্যারিসে, কিন্তু পর্তুগিজরা কি সেরার জায়গাটা থেকে পঞ্চাশ বছর আগে ঠাঁই দেওয়া ইউসেবিওকে সরাবেন? সন্দেহ থেকে যায়। আগের ম্যাচের ইতালিবধের পর ছেষট্টির সেই বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালেও শুরুর ২৫ মিনিটের মধ্যে ৩-০ গোলে এগিয়ে উড়তে থাকা উত্তর কোরিয়াকে বত্রিশ মিনিটের যাদুতে একাই চার গোল করে মাটিতে নামিয়েছিলেন ইউসেবিও। এরকম এক অসাধারণ গল্পের জন্যই হয়ত কোনো টুর্ণামেন্টের ফাইনালে দলকে নিতে না পারলেও পর্তুগিজদের আদরের ‘কালো চিতা’র জায়গাটা সবার উপরেই। রোনালদোর বেড়ে ওঠার গল্পটা সেভাবে নাড়া দেয়না তাদের। লিসবনের সেরা এক যুব একাডেমিতে খেলা শিখেছেন, এরপর স্যার অ্যালেক্সের ছত্রছায়ায় হয়েছেন পরিণত আর এরপর মাদ্রিদের রোশনাইতে আরো আলোকিত। দিনের পর দিন অনুশীলন করে নিজেকে আরো শানিয়ে নেয়া আরেকটা ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর দেখা হয়ত পাওয়া যেতে পারে সামনেও, কিন্তু মনকাড়া গল্পটা না থাকলে যে ঠিক জমে না! তবে দেশের হয়ে কিছু জিততে না পারলেও তাতে কিছু যায় আসত না ক্রিশ্চিয়ানোর, তিনি কিংবদন্তীদের তালিকায় নাম লিখিয়েছেন অনেক আগেই। 

 

আমাদের মাশরাফির কথাই ধরুন। দু’খানা হাঁটুতে সাতটা অপারেশনের পরেও হারতে না চাওয়ার জন্যই না সবার প্রিয় হয়ে উঠেছেন ‘ম্যাশ’? বল-ব্যাটের হিসেব দিয়ে কি আর সেই জায়গাটুকু নেয়া যায় চট করে? ছক্কা তো অনেকেই মেরেছেন আমাদের; কিন্তু ছয় বলে এগারো রানের সমীকরণের সময় পাইলটের ছক্কা মেরে ব্যাটে চুমু খাওয়াটা কি ভোলা যাবে কখনো? কিংবা গিলেস্পিকে লং অনে পাঠানো আফতাবের ছক্কাটা? 

 

শচীনের চেয়ে বেশি রান হয়ত একদিন করে ফেলবেন কোহলি। কিন্তু ভারতীয়রা কি তাঁদের ক্রিকেট-ঈশ্বরের জায়গাটা থেকে শচীনকে সরাবেন? শচীনই তো প্রথম তাদেরকে শিখিয়েছিলো, চাইলে কিভাবে বিশ্বসেরা হওয়া যায় তাদের দেশ থেকেও। ভারতের বদলে যাওয়া অর্থনীতির একটা সূচকও কি ছিলো না শচীনের রান? অস্ট্রেলিয়ানদের ক্রিকেট মাঠে খেলা দেখতে প্রথম আসতে শিখিয়েছিলেন ব্র্যাডম্যান, খেলাটাকে ভালোবাসতেও শিখিয়েছিলেন। ‘ডন’ হয়ে উঠবার পেছনে তাই প্রায় একশ’ গড়ে রান করার পরেও অন্য কিছু একটা কাজ করে।  আমরাও হয়ত একদিন সাকিব আল হাসানের চেয়ে ভালো অলরাউন্ডার পাবো। কিন্তু বিশ্বকে শাসন করতে প্রথম শেখানো 'বাংলার জান, বাংলার প্রাণ' সাকিব তো একজনই থাকবেন আমাদের কাছে।

 

আর প্রথম ভালোলাগার একটা ব্যাপারও থেকে যায়, অনেকটা প্রথম প্রেমের মত, আপনাকে কষ্ট দিলেও ভুলতে পারবেন না যাকে সারা জীবনেও। মিল লাগছে আশরাফুলের গল্পের সাথে? দশ থেকে পঁচিশ বছর বয়সের ভালো লাগার এই ছাপটা তাই মুছে না কোনোভাবেই। আশির দশকের টিনএজারদের জিজ্ঞেস করেই দেখুন। ভিভ রিচার্ডসকে কোনোভাবেই শচীনের পরে রাখতে চাইবেন না তাঁদের কেউ কেউ। কিংবা নাদালের সাথে বারবার হারার পরেও ফেদেরারকে সারাজীবন ভালবেসে যাবেন অনেকে, জোকোভিচ ট্রফিজয়ে তাঁকে কখনো টপকে গেলেও। এই লেখক যেমন ভুলতে পারেন না সাম্প্রাসকে।  

 

কিংবদন্তী হয়ে ওঠার মূহুর্তটা কি তাহলে সবসময় সুখের? তাহলে আপনাকে সেই গল্পটা বলবে ক্লুজনারের পাগলাটে দৌড়, ব্যাজ্জিওর পেনাল্টি মিস, ক্রনিয়ে কিংবা আজহারের বাজিকরের সাথে হাত মেলানো। চোখের জলে ভাসিয়েও তো হওয়া যায় নায়ক!  

 

আবার সেরাদের আসনে যাঁদের বসিয়ে দেয়া হয়, তাঁরাও মাঝেমাঝে করে বসেন মানবীয় সব ভুল। এখন পর্যন্ত বিশ্বকাপে কর্ণার হতে সরাসরি গোল খাওয়ার একমাত্র রেকর্ডটা কিন্তু ‘ব্ল্যাক স্পাইডার’ লেভ ইয়াসিনের, যাঁর নামে দেওয়া হত সেরা গোলকিপারের পুরষ্কার। ড্রাগ নিয়ে ধরা পড়েন ম্যারাডোনা। টাইগার উডস জড়িয়ে পড়েন নারীঘটিত ব্যাপারে। ক্যান্সার জয় করে ফিরে এলেও ডোপ কলংকে জড়িয়ে যান ল্যান্স আর্মস্ট্রং। 

 

কিংবদন্তী হতে হলে তাই সবরকম শিরোপা জিততে হয়না! নীল চোখের মালদিনিও জিতেননি কোনো বিশ্বকাপ কিংবা ইউরো। তাই বলে সর্বকালের সেরা লেফট ব্যাক হিসেবে তাঁর নাম না বললে লোকে হয়ত আপনাকেই টিটকিরি দিতে পারে। চার বছর পরপর সাতটা মাত্র ম্যাচ দিয়ে কি কাউকে বিচার করা যায়? বাতিস্তুতার ঝুলিতে দুইটা কোপা আর একটা মাত্র সিরি-আ, কোনো চ্যাম্পিয়নস লিগও নেই সেখানে; কিন্তু তাঁর খেলা দেখে আর্জেনটিনাকে সমর্থন কি শুরু করেননি অনেকে? দেশের হয়ে বিশ্বকাপ-ইউরো কিছুই জেতা হয়নি ক্রুয়েফ-পুসকাসের; বিশ্বকাপ জিতেননি ডি স্টেফানো কিংবা লারাও। আর হ্যাঁ, চ্যাম্পিয়নস লিগ কিংবা কোপা আমেরিকার ট্রফিতে কখনো চুমু খাওয়া হয়নি পেলে-ম্যারাডোনা কারোরই।

 

কাগজে-কলমে, মাঠের হিসেবে, ট্রফি-গোল-রান-উইকেট দিয়ে তাই কিংবদন্তী হওয়া যায়না, লাগে কিছু খ্যাপাটে মূহূর্ত, মাঠের পেছনের কোনো গল্প, মানুষ নিজের জীবনের সাথে মিলিয়ে নেয় সেসব।

 

কিংবদন্তীরা তাই মাঠে তৈরি হয়না, তৈরি হয় মানুষের মনে।