দ্য ম্যান হু ক্লাইম্বড এভারেস্ট ইন আ শর্ট স্লিভড সোয়েটার
পোস্টটি ২০৪৮ বার পঠিত হয়েছে১৯৩৩ সালের অ্যাশেজে ডগলাস জার্ডিনের ‘বডিলাইন’ কৌশলের কাছে নাস্তানাবুদ হয়েছিলো বিল উডফুলের অস্ট্রেলিয়া। ইংল্যান্ড সেবার ৪-১ ব্যবধানে সিরিজ জিতে নিলেও ভস্মাধার পুনুরুদ্ধার করতে একেবারেই সময় নেয়নি ক্যাঙ্গারুরা। পরের বছরই, ১৯৩৪ সালে ইংল্যান্ড থেকে ভস্মাধার অস্ট্রেলিয়াতে ফিরে যায়। উডফুলের নেতৃত্বেই।
এরপর টেমস বা মারে রিভার দিয়ে জল গড়ালো অনেক। ব্র্যাডম্যান নামের এক অতিমানবের উত্থান, বিশ্ব দেখেছিলো আগেই। কিন্তু দেখা হয়নি ‘নেতা’ ব্র্যাডম্যানকে। ব্যাটিং অর্ডার রিভার্স করা সেই মহাকাব্যিক ম্যাচ অথবা স্যার ডনের ‘দ্য ইনভিন্সিবল’ ইংল্যান্ডকে লজ্জা দিলো বারংবার। সেই ব্র্যাডম্যানও অবসর নিলেন ১৯৪৮’র অ্যাশেজ খেলে।
অ্যাশেজ আর ফিরলো না ইংল্যান্ডে!
কেটে গেলো প্রায় ১৯ বছর। ইংল্যান্ডের প্রতীক্ষা ফুরালো অবশেষে। স্যার লিওনার্দ হাটন নামক এক রানমেশিনের অধিনায়কত্বে ১৯৫৩ সালে নিজেদের মাটিতে ছাইধার নিজেদের করে নিলো ইংল্যান্ড।
১৯৫৬ সালের ইংলিশ সামার।
অস্ট্রেলিয়া দল তখন একটা পুনর্গঠনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। দলে অভিজ্ঞ খেলোয়াড়ের সংখ্যা খুব কম। বেশিরভাগই তরুণ খেলোয়াড়। কিন্তু কারোরই এতো কথা শোনার সময় নেই। কথা একটাই, অ্যাশেজ টানা ১৯ বছর অস্ট্রেলিয়ার ছিল, অ্যাশেজ আবারো অস্ট্রেলিয়ার হাতে চাই। তাই তরুণ দল নিয়ে ইয়ান জনসনের নেতৃত্বে ৫ টেস্ট ম্যাচের অ্যাশেজ সিরিজ খেলতে যখন ইংল্যান্ডে আসলো অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট দল তাঁদের উপরে চাপ ছিল ভীষণ। আগের দু’আসরে ‘চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী’ ইংল্যান্ডের কাছে হেরে বিসর্জন দিতে হয়েছে অ্যাশেজ। অ্যাশেজ পুনরুদ্ধার করতেই হবে এবার।
সেবার হয়তো জিতেই যেতো অস্ট্রেলিয়া। কিন্তু জেমস চার্লস লেকার নামের এক অফস্পিনার যে কিংবদন্তী হওয়ার জন্য এই সিরিজটিকেই বেছে নিলেন!
দিনটা কেমন যাবে, প্রভাত কি সবসময় তার সঠিক পূর্বাভাষ দেয়?
এ বিষয়ে তর্ক হতে পারে। তবে জিম লেকারের ক্ষেত্রে যে দিয়েছিলো তা বলাই বাহুল্ল্য।
ইংল্যান্ড সফরে আসার পরে কাউন্টি দল সারে’র সঙ্গে একটা প্রস্তুতি ম্যাচ খেলে অস্ট্রেলিয়া। সেই ম্যাচের এক ইনিংসে অস্ট্রেলিয়ার সবকটি উইকেট পকেটে পুরে জিম লেকার যেন জানান দেন, “এই সিরিজ হবে শুধু আমার। অন্য কারো নয়।”
এ বিষয়ে ডন মোসি নামে একজন লেখক তাঁর ‘লেকারঃ পোট্রেট অফ আ লিজেন্ড’ বইয়ে লেখেন, “কারো কল্পনাশক্তি যতই উর্বর হোক না কেন, যতই উচ্চাকাঙ্ক্ষা থাকুক না কেন, যতই ইস্পাতকঠিন মানসিকতার অধিকারী সে হোক না কেন, কেউ ১০ উইকেটের এই ডাবলের চিন্তাও করতে পারবে না। কিন্তু লেকার এটা করে দেখিয়েছেন।”
প্রথম টেস্ট ছিল ট্রেন্টব্রিজের নটিংহ্যামে। এই টেস্টের দুই ইনিংস মিলিয়ে মোট ৬ উইকেট নিয়ে ড্র করতে বড় ভূমিকা রাখেন লেকার। দ্বিতীয় টেস্টে লেকার নেন মাত্র ৩ উইকেট। লেকার বেশি উইকেট পাননি। ইংল্যান্ডও ম্যাচ জেতেনি। সিরিজে ১-০ তে এগিয়ে যায় অস্ট্রেলিয়া।
লিডসের তৃতীয় টেস্টে অস্ট্রেলিয়াকে রীতিমতো কাঁপিয়ে দেন লেকার। দুই ইনিংস মিলিয়ে নেন ১১ উইকেট। অস্ট্রেলিয়ার জন্য এক ভীষণ আতংকের নাম হয়ে দাঁড়ায় জিম লেকার। লেকারের বল কি বস্তু সেটাই বুঝতে পারছিলো না তাঁরা। ফলাফল, ১ ইনিংস এবং ৪২ রানের লজ্জাজনক পরাজয়।
৫ টেস্টের অ্যাশেজ সিরিজে তখন ১-১ সমতা। এ অবস্থায় শুরু হলো ওল্ড ট্রাফোর্ড টেস্ট। পিচে ঘাস বলে কোন জিনিসের অস্তিত্ব ছিল না। ম্যাচ শুরুর আগে ইংল্যান্ডের এক খেলোয়াড় বলে দেন, “ওটা পিচ নয়। ওটা বিচ(beach)।” টসে জিতে ‘বিচে’ ব্যাটিঙে নেমে প্রথম ইনিংসে ৪৫৯ রান সংগ্রহ করলো ইংল্যান্ড। অস্ট্রেলিয়ার ব্যাটসম্যানদের চোখ চকচক করছিলো। “ইংলিশরাই যদি এতো রান করে, আমরা তো আরও বেশী করবো। আর এই ন্যাড়া পিচে লেকার কি করবে শুনি?” কিন্তু তাঁরা ভুলে গিয়েছিলো ইংলিশদের ১০ উইকেটের ৬টিই নিয়েছেন অস্ট্রেলিয়ার স্পিনাররা।
ব্যাট করতে নেমে শুরুটা ভালোই করলো অস্ট্রেলিয়া। বিনা উইকেটে ৪৮ রান তুলে ফেললো তারা। ইংলিশ অধিনায়ক পিটার মে জুটি ভাঙ্গার জন্য এরপরেই বোলিঙে আনলেন জিম লেকার আর টনি লককে।
আচ্ছা, টনি লকের কথা কেন বলছি? টনি লক তো বাহুল্য মাত্র। জিম লেকার এমনই ধ্বংসযজ্ঞ চালালেন যে বিনা উইকেটে ৪৮ থেকে ৮৪ রানে অলআউট হয়ে গেলো অস্ট্রেলিয়া। ৩৭ রানে তিনি নিলেন ৯ উইকেট। ‘সান্ত্বনা পুরস্কার’ হিসেবে অস্ট্রেলিয়ার ইনিংসের ৩য় উইকেটটা নিলেন বাঁহাতি স্পিনার টনি লক।
পার্টনারের এই সাফল্য লক’কে উত্তেজিত করে তুলছিল। পার্টনারের মতো তিনিও স্পিনার। কিন্তু তাঁর পার্টনার যেখানে হাত ঘুরালেই মুড়ির মতো উইকেট পাচ্ছেন সেখানে তাঁর সংগ্রহ মাত্র এক উইকেট! এই ব্যাপারে লেকার অনেকদিন পরে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “আমি এখনো যখন ঐ ম্যাচের কথা ভাবি, তখন এটা ভেবে অবাক হই না যে আমি কিভাবে ১৯ উইকেট পেয়েছিলাম। বরং আমি অবাক হই লক কিভাবে মাত্র ১ উইকেট পেয়েছিল।”
দ্বিতীয় ইনিংসে আরও আনপ্লেয়েবল হয়ে উঠলেন জিম লেকার। ২০৫ রানে যখন তিনি একাই যখন প্রতিপক্ষকে অলআউট করে দিলেন তখন তাঁর নামের পাশে জ্বলজ্বল করছে ১০ উইকেট। দু’ইনিংস মিলিয়ে মোট ১৯ উইকেট। মাত্র ৯০ রান খরচায়।
ইংল্যান্ড সিরিজে এগিয়ে গেলো ২-১ এ।
ওল্ড ট্রাফোর্ডের পিচ স্পিন সহায়ক ছিল বলেই লেকারের অমন রেকর্ড, এ কথা বলে যারা এই রেকর্ডের গায়ে ‘কাদা’ ছিটাতে চান, টনি লকের পারফরম্যান্স তাদের জন্য একটা জবাবও। স্পিন সহায়ক হলে লেকারের কেন ১৯ উইকেট আর লকের কেন ১ উইকেট? উইকেট সংখ্যা তো কাছাকাছিই হওয়ার কথা। তাই না?
ওভালের ৫ম টেস্টে লেকার নিলেন মোট ৭ উইকেট। সেই টেস্ট ড্র হল। ভস্মাধারের অধিকার থেকে গেলো তাই ইংল্যান্ডের কাছেই।
জিম লেকারের পাশে বসতে গেলেও কোন বোলারের এক ইনিংসে ১০ উইকেট পেতেই হবে। লেকারের রেকর্ড ভাঙ্গতে গেলে লাগবে দুই ইনিংসেই ১০ উইকেট। জিম লেকার তাই এমন এক জায়গায় অবস্থান করছেন, যেখান থেকে শুধু নিচেই দেখা যায়। উপরে কখনোই নয়!
এই রেকর্ডটি হয়েছিলো আজ থেকে ৬০ বছর আগে। আজকের দিনে।
কে যেন লেকার সম্পর্কে বলেছিলেন, “ক্লাইম্বিং এভারেস্ট ইন আ শর্ট স্লিভড সোয়েটার!”
যদি কেউ আপনাকে কখনও লেকারকে একবাক্যে ব্যাখ্যা করতে বলে তবে আপনি এই লাইনটা তাকে শুনিয়ে দেবেন!!!
- 0 মন্তব্য