• ফুটবল

অদ্ভূত আঁধার এক

পোস্টটি ১৮০৭ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় খেলার মাঠে তখন আঁধার নেমেছে। ফ্ল্যাশ লাইটের আলোয় সে আঁধার চিড়ছে, সঙ্গে আছে ক্যামেরার ফ্ল্যাশ। প্রায় শূন্য গ্যালারিতে দাঁড়িয়ে সৌরভ আর আমি। সঙ্গে সামিউল, আর আমাদের বন্ধু ওস্তাদ। পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান শেষ হয়ে এসেছে। মার্কেটিং, ইইই-র সঙ্গে জোট বেঁধে ছবি তুলছে, আলাদা করে তুলছেন। চ্যাম্পিয়ন ফিজিক্স আর ইসলামিক স্টাডিজেরও ছবি তোলার হিড়িক পড়ে গেছে। ফিজিক্সের একেকজন আসছেন, একেকজনের একেকরকম পোজ। মার্কেটিং একটু আগে এমন কাজই করেছে। উল্লাস দেখে বোঝা দায়, কে চ্যাম্পিয়ন, কে রানার্স-আপ। একটু আগে যে দলটা মুষড়ে পড়েছিল, মেডেল, ট্রফি, সামনে ক্যামেরার ফ্ল্যাশ যেন প্রাণ সঞ্চার করলো তাঁদের মাঝেই।
 
আমরা তখনও ঠাঁই দাঁড়িয়ে। আমাদের ছবি তোলার বালাই নেই। উঠে চলে যেতেই পারি, যাচ্ছি না। একে একে সবাই চলে গেছে। আমরা দলের সেই অর্থে কেউ না, নিতান্ত সমর্থক। তবুও দাঁড়িয়ে, বসে, গ্যালারির পাশের রেলিঙয়ে হেলান দিয়ে পার করে দিচ্ছি সময়। কেন, জানি না।
 
একটু ভাবতে গেলেই ফ্ল্যাশব্যাকে আসছে সব। ফিজিক্সের আত্মঘাতি গোলে এগিয়ে যাওয়া। কিভাবে গোলটা শোধ হয়ে গেল, কে জানে! তবে হয়েছে। সব গিয়ে ঠেকেছে টাইব্রেকারে। কৃষ্ণর গ্লাভস পরা। কৃষ্ণর পায়চারি। এদিকের বার ছোঁয়ার চেষ্টা, ওদিকে গিয়ে আবার। এদিক আরেকবার, তারপর স্থির। শরীরটা দুলুনি দিয়ে যায়। কখনও হঠাৎ এগিয়ে যায় কৃষ্ণ, সামনে যে শটটা নিতে এসেছে, তাকে আরও নার্ভাস করে দিতে।
 
কৃষ্ণ একটা শট ঠেকিয়ে দেয়। তার আগে সে নিজে গোল করেছে, শুভ গোল করেছে। মান্নান মিস করে গেল, যে মান্নান ম্যাথমেটিকসের সঙ্গে অন্যরকমের আত্মবিশ্বাস দেখিয়েছিল, যে মান্নান এর আগে গোল করেছিল বোটানির সঙ্গে, সেই মান্নান মারলো বাইরে দিয়ে। ফার্স্ট ইয়ারে পড়ে, সামনে নিশ্চয়ই আরও অনেক সুযোগ পাবে মান্নান, তার কোনো এক শটেই হয়তো আবার আনন্দোল্লাসে ভাসবে গ্যালারি, অথবা ফেসবুক লাইভে দেখা সেই দূরদেশের কেউ!
 
সবুজ আসে। নার্ভাস। হওয়ারই কথা। ম্যাথের সঙ্গে সবুজের শটটা নিয়ে সন্দেহ ছিল, এর মিস করার অভ্যাস আছে। পাশে বসা ফুয়াদ ভাইও বিশ্বাস করতে পারছিলেন না! সবুজের শটটা ছিল নিঁখুত, ম্যাচশেষে বলেছিল, জাল জড়ানো আছে কোণের যে বাঁশটা দিয়ে, সেটা বরাবরই মারার প্র্যাকটিস করেছে। মেরেছেও সেখানেই! এরপর আমার চেয়ে কম উল্লাস করেননি ফুয়াদ ভাই, নিজেকে ভুল দেখতে পেরে কী যে খুশী!
 
তবে এদিন কেন যেন সবুজের উপর বিশ্বাস ছিল। সবুজ পারবে। রাহাতের কাঁধে ভর দিয়ে তাকিয়ে থাকি আর ভাবি, সবুজ ঠিকঠিক মারবে, ওই বাঁশ বরাবর! সবুজ উপর দিয়ে মারলো। রাহাতের মাথা এদিক ওদিক করছে শুধু, মানতে পারছে না। সবুজের তো পারার কথা ছিল! ম্যাচের সময়টাতে সবুজ এদিন গোটা টুর্নামেন্টে নিজের সেরা খেলাটা খেলেছে, প্রায় একাই গোল করেই ফেলেছিল! সেই সবুজের আত্মবিশ্বাস গোলবারটার একটু উপর দিয়ে বেরিয়ে গেল।
 
সব গিয়ে ঠেকলো আবার ওই কৃষ্ণের উপর!
 
ম্যাথের সঙ্গে টাইব্রেকারে শেষ শটটা যখন বাইরে দিয়ে গেল, গোলবারের নীচে দাঁড়ানো কৃষ্ণ খানিক বাদেই উল্লাসের মাঝে হারিয়ে গিয়ে কেঁদে ফেলেছিল! আনন্দে! ফাইনালে কৃষ্ণ একটা ওভারহেড কিক করলো! কৃষ্ণ ফ্রি-কিক করলো, কৃষ্ণ অনায্য ফাউলের শিকার হয়ে মাঠ ছেড়ে উঠে আসতে চেয়েছিল!
 
কৃষ্ণ পারলো না। ফিজিক্স উল্লাসে মত্ত, গ্যালারির এপাশটায় কিরকম একটা শুনশান নীরবতা। সবুজ এগিয়ে আসছে। দুচারজন চলতি পথে সান্ত্বনা দিয়ে গেল, সতীর্থদের সান্ত্বনা পেয়েছে আগেই। সৌরভের হাঁটুতে হেলান দিয়ে আমি বসে পড়েছি, ওপাশে নাজমুল ভাইয়ের অবস্থাও একই। অথচ সকালে নাজমুল ভাই জীবন নিয়ে কতো কথা বলেছেন, আমি নিশ্চিত, সে সময় নাজমুল ভাইয়ের জীবনটা একটু আগে শেষ হওয়া ম্যাচটার উপর এসে ভর করেছিল! রাহাতের মুখে রা নেই, সৌরভ নিশ্চুপ। সবুজ এগিয়ে আসছে, গ্যালারির দিকে। ভেঙ্গে পড়ছে ধীরে ধীরে।
 
এরপরের অনেকটা সময় সবুজ আমার পাশে বসে। দুহাতে ধরে রেখেছি, এটা ওটা সেটা, ফুটবল, জীবন, হেন তেন বোঝানোর চেষ্টা করছি। সৌরভ বুঝানোর চেষ্টা করে। তামারা, ব্রাজিল আর নেইমার ভক্ত, সেও এসে সবুজকে সান্ত্বনা দেয়। সবুজ মানে না! ফুঁপিয়ে ওঠা কান্নার দমকটা আটকে রাখার চেষ্টা করে!
 
এত ‘বাজে’ একটা কিক সে কিভাবে নিল! এমন যদি হতো, ভাল শট, কিন্তু গোলকিপার ঠেকিয়ে দিয়েছে, তাও তো হতো! অথবা আগের দুইদিন, র‍্যাগডে বা ঝামেলার কারণে ঠিকমতো প্র্যাকটিস করা হয়নি, তার ভুলে দলে হেরেছে, কতো কী! শুধু সবুজের পাশে বসে থাকি, আর ভাবতে থাকি।
 
এর আগের কোনো ম্যাচে ঘাসে ঘসা লেগে অনেকখানি ছড়ে গিয়েছিল সবুজের, কয়েকদিন ঘুমাতে হয়েছে একপাশ হয়ে। তারপর আরেক প্লেয়ারের বুটের স্পাইক লেগে লাল লাল ছয়টা দাগ বসে গেছে উরুতে, সবুজ আবার রাতে ঠিকমতো ঘুমাতে পারেনি। সেই সবুজ বোধহয় আজও পারবেনা ঘুমাতে ঠিকমতো, ঘুরেফিরে হয়তো আসবে সেই শট, যেটা বারের উপর দিয়ে গেল!
 
মাথায় আসে, সবুজকে আমি নতুন করে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করি! সবুজ, কৃষ্ণ যাকে শাকিলুর বলে ডাকে। ম্যাথের সঙ্গে খেলাটা ছিল সকালে। ঘুম থেকে ওঠা দায়, আমি সবুজকেই বলে রেখেছিলাম, মাঠে যাওয়ার সময় যাতে আমাকে একটা ফোন দেয়! দলের অন্যতম খেলোয়াড় নিতান্ত এক দর্শককে ফোন দিয়ে ডাকিয়ে তোলে, খেলা দেখার জন্য! সেই সবুজ, তাকে কী করে সান্ত্বনা দেই!
 
কৃষ্ণ বলে, পারলাম না। সবুজ কুমার বলে, স্যরি বন্ধু! সাব্বির ভাইয়ের সঙ্গে হাত মেলাতে গেলে বসতে বলেন পাশে। হাত বাড়িয়ে মান্নানকে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করি, সুযোগ পাবি সামনে অনেক!
 
প্লেয়াররা নিচে নেমে যান। পুরস্কার নিতে। সবুজের মুখেও হাসি ফোটে, ঠাট্টার ছলে বলে, দে তো আমাকে এই ট্রফিটা, আমার ভুলেই তো এটা পেলাম, একটা ছবি তুলি! জাভেদ ভাই, সাব্বির ভাই, জুয়েল ভাই ছবি তোলেন। রাকিব ভাই তোলেন। সেরা খেলোয়াড় মিশুক ভাই তোলেন। সিরাজ হাসে, শুভ হাসে। সব ভুলে মান্নান মেডেল কামড়ে ধরে পোজ দেয়। আশীস দা বিদায় নিয়ে চলে যান। স্বপ্নীল ভাই আপুকে নিয়ে ছবি তুলে দিতে বলেন।
 
আমি আর সৌরভ ভাইকে ব্যাগের অজুহাত দেখায়, ভাই ব্যাগগুলো নিতে বলেন, তাহলে আমরা চলে যেতে পারি! অথচ কেউ আমাদেরকে ব্যাগ আগলে রাখার দায়িত্ব দেয়নি। গোল হলে আমরা গলা ফাটিয়েছি, দিগ্বিদিক ছুটেছি। টাইব্রেকারে টেনশন করেছি। রেফারি কার্ড দেয় না কেন, রেফারি শাকিলুরের এতো ফাউল ধরে কেন সেটা বলেছি। রেফারি কৃষ্ণকে নাম ধরে ডাকে, এটা ভেবে কেমন একটা গর্ব হয়েছে। সিরাজ নামলেই গোল হয়, মান্নান কতো ভাল করবে, সেটা আলোচনা করেছি। ম্যাচ শেষ হয়েছে, উল্লাসে মেতে গোল করে দাঁড়িয়েছি, পাশের জনকে হয়তো ঠিকমতো চিনিও না!
 
সেই যে আইনের সঙ্গে খেলা দিয়ে শুরু, ফিজিক্সে শেষ। কখনও একা, কখনও দলবেঁধে গ্যালারির নিচের সারিতে গিয়ে বসা। সৌরভ ঘুমের কারণে কতো ক্লাস মিস করলো, আমি কতো কিছু মিস করলাম। সৌরভের একটা খেলাও মিস হয়নি। আমার হয়নি। কী হতো চ্যাম্পিয়ন হলে! হয়তো গলা ফাটাতাম। আলোচনা হতো, চিপায়, নীলক্ষেতে। অনেকদিন।
 
এখনও হবে। মান্নান একদিন ট্রফি জিতবে। কৃষ্ণ নিজেকে ছাড়িয়ে যাবে। জাভেদ ভাইদের আক্ষেপ থাকবে। সবুজ হয়তো সেরা খেলোয়াড় হবে। সবুজ আপাতত আক্ষেপ করবে। আর সকাল হলে বাড়ি যাবে ঈদ করতে।
 
বাড়ি যা সবুজ। ঈদের আনন্দ কর। খেলার মাঠের দিনশেষের আঁধারটা না, আলোর ঝলকানিটাই নাহয় মনে রাখলি!
 
(ছবি- সুজয় সাহা)