ইতিহাসের দ্বিতীয় 'টাই' টেস্ট
পোস্টটি ২৫৫৩ বার পঠিত হয়েছেঘরের প্রথম ছেলের জন্য যেমন একটা নির্ধারিত আদর বরাদ্দ থাকে সবসময়, এ যেন তা-ই । টাই টেস্টের কথা উঠলেই, এক নিঃশ্বাসে আলোচনায় চলে আসে ১৯৬০ সালের সেই ঐতিহাসিক ‘ব্রিসবেন’ টেস্ট । অস্ট্রেলিয়া-ওয়েস্ট ইন্ডিজের সেই প্রথম টাই টেস্টের জন্যেই যেন সব আলোচনা, সব উচ্ছ্বাস বরাদ্দ । টেস্ট ক্রিকেটে দ্বিতীয়বারের মতো ‘টাই’ দেখা অস্ট্রেলিয়া-ভারতের সেই মাদ্রাজ টেস্টের কথা, কারো যেন মনেই থাকে না ।
তা দুটো টেস্টকে দাঁড়িপাল্লায় মাপলে, নিঃসন্দেহে পাল্লাটা ঝুঁকে পড়বে ব্রিসবেনের দিকেই । সেই টেস্টের তুলনায় মাদ্রাজ টেস্ট বলতে গেলে কিছুই না । ক্রিকেট ইতিহাসে বেনো-ওরেলের তুলনায় যেমন বোর্ডার-কপিলকে অনেকটা সাদামাটা দেখায়, ঠিক তেমনি প্রথম টাই টেস্টের তুলনায় দ্বিতীয় টাই টেস্টও অনেক বিবর্ণ, ভীষণ পানসে । তাই দ্বিতীয় টাই টেস্ট নিয়ে যে তেমন আলোচনা হয় না, তাতে দোষ খুব একটা দেয়ার নেই আসলে ।
টাই টেস্টের আলোচনায় তুলনামূলক অনেক কম প্রচার পাওয়া, টেস্ট ইতিহাসের সেই দ্বিতীয় ‘টাই’ নিয়েই আজকের এই আলেখ্য ।
***
সিরিজ শুরুর পূর্বাবস্থা
প্রায় তিন বছর ধরে কোন সিরিজ জেতেনি অস্ট্রেলিয়া । কিম হিউজ থেকে অধিনায়কত্ব হাত বদল হয়ে এ্যালান বোর্ডারের কাছে আসলেও মাঠের ক্রিকেটে সাফল্য ধরা দিচ্ছিল না কিছুতেই । ফ্র্যাংক ওরেল সিরিজের মতো ট্রান্স-তাসমান সিরিজও হেরেছে টানা দুটোতে । এ্যাশেজ খুঁইয়েছে ডেভিড গাওয়ারের ইংল্যান্ডের কাছে । নিজেদের মাঠে ভারতের সাথেও ছিল যাচ্ছে-তাই অবস্থা । কপাল গুণে কোন ম্যাচ না-হারায়, সে সিরিজটি ড্র হয়ে গিয়েছিল । এমন এক দৈন্যদশায়, নিজেদের কঠিন দুর্দিনে, ভারত সফর করেছিল বোর্ডারের অস্ট্রলিয়া । বিদেশের মাটিতে যাদের সর্বশেষ জয়টিও এসেছিল প্রায় সাড়ে তিন বছর পূর্বে, নবীন ক্রিকেট-শক্তি শ্রীলংকার বিপক্ষে ।
অন্যদিকে ভারতের অবস্থা অবশ্য এতটা খারাপ ছিল না । প্রায় পাঁচ বছরের সিরিজ জয়ের খরা কাটিয়ে, ইংল্যান্ডে গিয়ে ইংল্যান্ডকেই হারিয়ে এসেছে তাঁরা । অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে অস্ট্রলিয়াকে বেশ ভালোমতোই চেপে ধরেছিল, যদিও জিততে পারেনি শেষ পর্যন্ত । তাই সিরিজ শুরুর আগে সুবিধাজনক অবস্থায় কেউ যদি থেকে থাকে, সেটা ছিল ভারতই । স্বাগতিক হওয়ায় মানসিকভাবে এগিয়েও ছিল কপিল দেবের দল ।
দুটি দল এমনই দুই মেরুতে অবস্থানরত অবস্থায়, তিন ম্যাচ টেস্ট সিরিজের প্রথমটি খেলতে নামে মাদ্রাজের চিপকে, চিদাম্বরম স্টেডিয়ামে ।
টস জিতল অস্ট্রেলিয়া, সেঞ্চুরী করলেন গাভাস্কার
১৮ই সেপ্টেম্বর, ১৯৮৬ । এমএ চিদাম্বরম স্টেডিয়াম, চিপক, মাদ্রাজ ।
এখন অবশ্য শহরটির নাম বদলে ‘মাদ্রাজ’ থেকে হয়ে গেছে ‘চেন্নাই’ । সেই স্টেডিয়ামে সিরিজের প্রথম টেস্টে, ওয়ানডের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ভারতের সাথে খেলতে নামল অস্ট্রেলিয়া । টস ভাগ্যে কপিল দেবের সাথে লড়াইয়ে জিতলেন এ্যালান বোর্ডার । নিলেন প্রথমে ব্যাট করার সিদ্ধান্ত । মাদ্রাজের সূর্য একটু বেশীই যেন উত্তপ্ত থাকে, তাই আগে ব্যাট করার সিদ্ধান্তে চমকের ছিল না কিছুই । অস্ট্রেলিয়ান উদ্ধোধনী দুই ব্যাটসম্যান জিওফ মার্শ ও ডেভিড বুনের সাথে, টসে হারা দুর্ভাগা ভারতীয় দল মাঠে নামলো ফিল্ডিং করতে । পুরো ভারতীয় দলের সাথে মাঠে নেমেছেন সুনীল গাভাস্কারও । আর মাঠের সীমানা দড়ি পেরিয়ে, সবুজ ঘাসে পা ছোঁয়ানোর সাথে সাথে তিনি হয়ে গেলেন ইতিহাস ।
ইতিহাসের প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে ‘টানা’ শততম আন্তর্জাতিক টেস্ট খেলার গৌরবে গৌরবান্বিত হয়ে গেলেন, ভারতের প্রথম লিটল মাস্টার । এর আগে ১০৯ বছরের ক্রিকেট ইতিহাসে, এই অর্জন করে দেখাতে পারেননি আর কেউই ।
টেস্টটাকে উপভোগের জন্য, ভারতীয়দের এই একটা উপলক্ষ্য তো ছিলই । আরো ছিল, ওয়ানডের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হিসেবে নিজেদের মাঠে নিজেদের আধিপত্য দেখানোর সুযোগ। সেই ১৯৭৯তে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে প্রথম সিরিজ জেতা ভারতের সুযোগ ছিল, নিজেদের মাঠে আগেরবারের পুনরাবৃত্তি ঘটানোরও । মাঝে অস্ট্রেলিয়ায় হওয়া দুটি সিরিজই যে অমীমাংসিত অবস্থায় শেষ হয়েছিল ।
এ যেন অগ্নি স্নানে শুচি হোক ধরা
রবিঠাকুর তাঁর ‘এসো হে বৈশাখ’ কবিতাটি লেখার সময় মাদ্রাজের গরম চাক্ষুষ করেছিলেন কি না, কে জানে ! নইলে সত্যিকার আগুনে-গোসল তো এই শহরেই হচ্ছিল । ধরা’কে শুচি করতে সূর্য যেন বেছে নিয়েছিল মাদ্রাজ শহরটাকেই । সে কী উত্তাপ, গরম ! সূর্যের গনগনে আঁচে দেহের ভেতরের মাংসপেশী পর্যন্ত যেন পুড়ে ছাতু হয়ে যাচ্ছিল । যাকে বলে রক্ত জল হওয়ার মতো অবস্থা ।
গরম কাকে বলে, সবচেয়ে ভালো বুঝেছিল ভারতীয় দল । এই পশম-পোড়া রোদে, টানা দুটো দিন বোলিং-ফিল্ডিং করতে হয়েছিল তাদের । ১৭০ ওভারের মধ্যে ১৩৬ ওভারই তাই স্পিনাররাই হাত ঘুরিয়েছিলেন, চেতন শর্মা ও কপিল দেব লম্বা-রানআপের বোলিংয়ের ঝুঁকিতে যাননি । অস্ট্রেলিয়ান ব্যাটসম্যানরাই কি খুব সুখে ছিলেন ? যারা ব্যাটিংয়ে ছিলেন তাঁরা হাড়ে হাড়ে বুঝেছিলেন, হাড্ডি-পোড়া গরম কাকে বলে ! তাই তো ডিন জোন্স যখন প্রায় সাড়ে আট ঘন্টা মাঠে কাটিয়ে ফিরলেন, ড্রেসিংরুমের পরিবর্তে তাকে ছুটতে হলো, অন্যত্র । প্রচন্ড দাবদাহ তাঁর সমস্ত কিছু যেন নিঃশেষ করে দিয়েছিল, ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত হয়ে শুশ্রুষার জন্য তাই তাকে ঠাঁই নিতে হয়েছিল মাদ্রাজের হাসপাতালে ।
অস্ট্রেলিয়ার রান-চূড়ায় অধিষ্ঠান
জিওফ মার্শ বেশীক্ষণ না-থাকলেও, অপর ওপেনার ‘গোঁফো’ ডেভিড বুন ছিলেন । ডিন জোন্সের সাথে ভারতীয়-বোলারদের খাটিয়ে মেরে, ১৫৮ রানের জুটি গড়েছিলেন । ফিরেছিলেন ১২২ রান করে, ১ম দিনের খেলা শেষ হওয়ার একটু আগে । পরের খেলাটা খেলেছিলেন ডিন জোন্স । ভদ্রলোক এখন ধারাভাষ্যকার বনে গেছেন । নাইট ওয়াচম্যান ব্রাইটকে সাথে নিয়ে, দ্বিতীয় দিনও জ্বালিয়ে মেরেছিলেন ভারতীয় বোলারদের । ব্রাইটকে শিবলাল যাদব ফেরালে, মাঠে নামেন অজি-অধিনায়ক এ্যালান বোর্ডার । জোন্স-বোর্ডার মিলে কপিল দেবের বোলিং ইউনিটকে চূড়ান্ত হতাশায় ডুবিয়ে যোগ করেছিলেন আরো ১৭৮ রান ।
৫০২ মিনিটের ম্যারাথন ইনিংস খেলে জোন্স যখন যাদবের বলে বোল্ড হলেন তখন তাঁর নামের পাশে জ্বলজ্বল করছে ২১০ রান । ৩৩০ বল খেলে ২৭টি চার ও ২টি ছয় মেরেছিলেন তিনি এই ইনিংসটিতে । এখনও এই ২১০-ই ভারতের মাটিতে কোন অস্ট্রেলিয়ানের সর্বোচ্চ ইনিংস ।
বুন ও জোন্সের পর সেঞ্চুরী পেয়েছিলেন বোর্ডারও । একটি দ্বি-শতক ও দুটি শতকের উপর ভর করে অস্ট্রেলিয়া পেয়ে গিয়েছিল ৫৭৪ রানের বিশাল সংগ্রহ । তৃতীয় দিন সকালে ৩৭ মিনিটের মাথায় ৭ম উইকেট হিসেবে গ্রেগ ম্যাথুস আউট হলে, বোর্ডার ইনিংস ঘোষণা দেন । এতক্ষণে একটা নির্ভার-স্কোর পেয়েছি, এমন কিছুই হয়তো ভেবেছিলেন বোর্ডার ।
কপিল দেবের ‘দেবত্ব’
প্রচন্ড গরমে টানা দুইদিন ফিল্ডিং করা ভারতীয় দল ব্যাটিং করতে নেমে কেমন যেন খেইহারা হয়ে গিয়েছিল । শ্রীকান্থের আক্রমণাত্নক সূচনায় দ্রুত পঞ্চাশ পেরোলেও, ৬২ থেকে ৬৫’র মধ্যেই তিন উইকেট হারায় ভারত । আজহার উদ্দীনও করেন খেইহারা ব্যাটিং, যদিও পঞ্চাশ অবধি পৌছে গিয়েছিলেন । রবি শাস্ত্রী ও চন্দ্রকান্ত পন্ডিত চেষ্টা করেছিলেন কিছুটা প্রতিরোধ করতে, তবে তাতে লাভ হয়নি । তৃতীয় দিনের খেলা সমাপ্তির সময় ভারতের স্কোর দাঁড়ায় ২৭০/৭, ফলোঅন এড়াতে তখনও প্রয়োজন আরো ১০৫ রান । হাতে মাত্র তিন উইকেট ।
চতুর্থ দিন সকালে সেখান থেকেই কপিল দেবের বীরত্বের (কিংবা দেবত্বের) সূচনা । চেতন শর্মা, শিবলাল যাদব ও মানিন্দর সিংদের নিয়ে লড়লেন শেষ পর্যন্ত । ১০৯ বলে সেঞ্চুরী করে থেমেছিলেন ১১৯ এ । কপিল দেবের এই দুরন্ত ‘ফাইটব্যাকে’ ভারত ফলোঅন-শংকা এড়াতে পেরেছিল, এবং পৌছে গিয়েছিল ‘ভদ্রস্থ’ একটা স্কোর ৩৯৭-তে ।
তাই কপিল দেবের এই চতুর্থ সেঞ্চুরী কি শুধুই বীরত্বের ছিল ? বরং রক্ষাকর্তার ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়া এই সেঞ্চুরীটি দেবত্বের স্বীকৃতিও কি কিছুটা দাবী করে না !
চমকে দিয়ে ইনিংস ঘোষণা বোর্ডারের
১৭৭ রানে এগিয়ে থাকা অস্ট্রেলিয়া, দ্রুত রান তোলার দিকে মনযোগ দেয় । চতুর্থ দিন শেষ হতে হতে পাঁচ উইকেট হারিয়ে তাই ১৭০ রান তুলে ফেলে, ফলে লিড তখন ৩৪৭-এ গিয়ে ঠেকেছে । পঞ্চম দিনের সূচনায় আর ব্যাটিংয়ে না নেমে, ইনিংস ঘোষণা দিয়ে দেয় অস্ট্রেলিয়া ।
জিততে হলে শেষ দিনের উইকেটে, সারাদিনে করতে হবে ৩৪৮ রান। এমনই একটা লক্ষ্য পায় ভারত । অথবা ম্যাচ বাঁচাতে চাইলে পড়ে থাকো, উইকেটে কাটিয়ে দাও সারাটা দিন ।
ম্যাচের নাটকীয় মোড়
বলতে গেলে এ এক অকল্পনীয় জয়ের লক্ষ্য । ভারত তাই সেই লক্ষ্যের দিকে ছোটার বদলে, মনোনিবেশ করে গরম উপেক্ষা করে সারাটা দিন কিভাবে টিকে থাকা যায় সেইদিকে । গাভাস্কার-শ্রীকান্থের সাবধানী সূচনার পর, অমরনাথের দারুণ ব্যাটিংয়ে আস্তে আস্তে ম্যাচের মোড় পাল্টাতে থাকে । ভারত যখন পঞ্চম দিনের চা-পান বিরতিতে গেল, তখন তাদের সংগ্রহ ৫৭ ওভারে দুই উইকেটে ১৯০ । শেষ সেশনে ৩০ ওভারে করতে হবে ১৫৮, হাতে আছে আট উইকেট । ঠিক এই পরিস্থিতিতে ভারত ড্রয়ের বদলে, জয়ের চিন্তা করতে শুরু করেছিল, এমনই মনে করেন ক্রিকেট-বোদ্ধারা । শততম টেস্ট খেলতে নামা সুনীল গাভাস্কার নার্ভাস-নাইন্টিজে (৯০) কাঁটা পড়লেও, আজহারউদ্দীন-চন্দ্রকান্ত পন্ডিতরা লড়াইটা টেনে নিয়ে গেলেন আরো অনেক দূর পর্যন্ত । শেষ কুড়ি ওভারে সমীকরণ ঠেকে, সাত উকেট হাতে নিয়ে প্রয়োজন ১১৮ রান-এ ।
প্রায় সাড়ে চারদিন ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখা অস্ট্রেলিয়া তখন চলে গেছে, ‘ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি’ অবস্থানে । ম্যাচের লাগাম হাত বদল হয়ে ভারতের কাছে চলে গেছে ততক্ষণে । ম্যাচের অবস্থা বিবেচনায় কপিল দেব নিজেকে ‘প্রমোশন’ দিলেন, অবশ্য নিজেকে উপরে এনে লাভ করতে পারলেন না কিছুই । এবার আর দেবত্ব কিংবা বীরত্ব দেখানো গেল না, এলেন আর গেলেন । রবি শাস্ত্রীর ব্যাটে ভর দিয়ে তবুও লড়াইটা ঠিকই চালিয়ে যাচ্ছিল ভারত । একটা সময় শেষ পাঁচ ওভারে দরকার পড়ল মাত্র ১৮ রান । হাতে তখনও চার-চারটি উইকেট ।
এই সময় ক্রিকেট দেখাল তাঁর সৌন্দর্য্যের আরেক পসরা । ব্রাইটের একই ওভারে ফিরলেন চেতন শর্মা ও কিরন মোরে । শিবলাল যাদব ছয় মেরে জয়টাকে হাত-ছোঁয়া দূরত্বে আনলেও, তাকেও ফেরালেন ব্রাইট । আট বলে দরকার চার রান, হাতে মাত্র এক উইকেট ।
শেষ ওভারের রোমাঞ্চ
ব্রাইটের শেষ দুটি বল কোনমতে ঠেকিয়ে দিয়েছিলেন মানিন্দর সিং । শেষ ওভারে দরকার ছিল মাত্র চার রান, স্ট্রাইকে ছিলেন ৩৭ বলে ৪৫ করা রবি শাস্ত্রী । বোলিংয়ে ছিলেন টানা ৪০তম ওভার করতে আসা গ্রেগ ম্যাথুস । যিনি সেই নবম ওভার থেকে এই ৮৭তম ওভার পর্যন্ত এক প্রান্ত দিয়ে বল করেই যাচ্ছিলেন । প্রথম ইনিংসে পাঁচ উইকেট পেয়েছিলেন, দ্বিতীয় ইনিংসেও পেয়ে গিয়েছিলেন চারটি উইকেট ।
ম্যাথুস প্রথম বলটি করলেন, ব্লক করলেন শাস্ত্রী । দ্বিতীয় বলটি করলেন, একটু এগিয়ে এসে লেগ সাইডে ঘুরিয়ে মারলেন, রবি শাস্ত্রী । ঠিক যেভাবে মারতে চেয়েছিলেন, সেভাবে পারেননি । তবুও মিস ফিল্ডিংয়ের সুবাদে পেয়ে গেলেন মহা-মূল্যবান দু-দুটো রান । চার বলে তখনও দরকার দুই রান । স্ট্রাইকে শাস্ত্রীই আছেন ।
তৃতীয় বলটিও ব্লক করলেন শাস্ত্রী, বল চলে গেল লেগ সাইডে । লেগ সাইডের ফিল্ডারটি তখন সীমানা-দড়ির কাছে । সে দৌড়ে আসতে আসতে শাস্ত্রী, মানিন্দর সিংয়ের সাথে বদল করে ফেললেন জায়গা । স্কোর টাই ।
তিন বলে দরকার এক রান । হাতে আছে এক উইকেট । স্ট্রাইকে আছেন মানিন্দর সিং । নাম্বার ইলেভেনের জন্য বোর্ডার দুইজন শট-ফিল্ডার সেট করলেন । চতুর্থ বলটি করলেন ম্যাথুস, ঠেকালেন মানিন্দর । লেগে দাঁড়ানো সিলি পয়েন্টের ফিল্ডারটির হাতে ক্যাচ হতে হতেও হলো না । দুই বলে দরকার এক রান ।
পঞ্চম বলটি করলেন ম্যাথুস, বল লাগলো প্যাডে । আবেদন জোরালো হতে না-হতেই আঙ্গুল উঁচিয়ে ধরলেন আম্পায়ার । মুহূর্তেই ম্যাথুসকে ঘিরে উল্লাসে ফেটে পড়লো অস্ট্রেলিয়া-শিবির । ম্যাচ হয়ে গেল টাই ।
আম্পায়ারের ভুল নাকি শাস্ত্রীর ‘অ-শাস্ত্রীয়’ ভুল
“আম্পায়ার সে সময় নার্ভাস ছিল, তাই আউট দিয়েছে । আমি আউট ছিলাম না । বল ব্যাটে লেগেছিল, প্যাডে নয় ।” মানিন্দর সিংয়ের দাবী এরকমই । ওটা আউট ছিল এটা মানতে এখনও নারাজ তিনি । ভুলটা কি তবে আম্পায়ারেরই ছিল ? নাকি শাস্ত্রীই মূল ভুলটা করে বসেছিলেন দুই বল আগে । একাদশ নাম্বার ব্যাটসম্যান মানিন্দরকে যে তিনিই ম্যাথুসের সামনে ঠেলে দিয়েছিলেন । ভারতের জয় নিশ্চিত করার আগে হার হবে না, এটা নিশ্চিত করাটা কি ঠিক ছিল ?
আম্পায়ারের ভুল হোক কিংবা শাস্ত্রীর ভুল । সেই ভুলের এমন মাশুলে নিশ্চয় আম্পায়ার ও শাস্ত্রী দুজনই মহা খুশী । মানিন্দরও কি খুশী নন ? ভারতের জয় হয়নি ঠিকই, জয় হয়নি তো অস্ট্রেলিয়ারও! জয় হয়েছে তো আসলে ক্রিকেটেরই ।
কেউ জেতেনি, কেউ হারেনি । জিতেছে ক্রিকেট, জিতেছে ক্রিকেটের চিরন্তন অনিশ্চিত সৌন্দর্য্য । অস্ট্রেলিয়া কিংবা ভারতের পরিবর্তে জয়ের বরমাল্য পরেছে ক্রিকেট, এর চেয়ে সুখকর আর কি হতে পারে ? মুগ্ধতার জন্য, এর চেয়ে বেশী আর কি লাগে ?
কবিগুরু যদি এই টেস্ট দেখে যেতে পারতেন, তাহলে হয়তো বলে উঠতেন-
“টাই হলো টাই হলো, কেউ না-হারি
ক্রিকেটের জয়ে, সবদিক উঠেছে ভরি ।”
ইতিহাসের দ্বিতীয় ‘টাই’ টেস্টে, আক্ষরিক অর্থেই ক্রিকেটের জয় হয়েছে । পরতে পরতে ম্যাচের রঙ বদলেছে, বড় প্রকট হয়ে ধরা দিয়েছে টেস্ট ক্রিকেটের ‘সেশন বাই সেশন’ সৌন্দর্য্য । ম্যাচ শেষ না-হওয়া পর্যন্ত বলা যাচ্ছিল না, ফলাফল কি হতে যাচ্ছে । এই তো ক্রিকেটের শাশ্বত নান্দনিকতা, গৌরবময় অনিশ্চয়তা ।
সংক্ষিপ্ত স্কোর :
টেস্ট নং ১০৫২ । ১৮ই সেপ্টেম্বর-২২শে সেপ্টেম্বর, ১৯৮৬ ।
টস : অস্ট্রেলিয়া (ব্যাটিং)
অস্ট্রেলিয়া ১ম ইনিংস : ৫৭৪/৭ ডিক্লেয়ার
জিওফ মার্শ ২২, ডেভিড বুন ১২২, ডিন জোন্স ২১০, রে ব্রাইট ৩০, এ্যালান বোর্ডার ১০৬, গ্রেগ রিটচি ১৩, গ্রেগ ম্যাথুস ৪৪, স্টীভ ওয়াহ ১২ অপঃ
শিবলাল যাদব ১৪২/৪, চেতন শর্মা ৭০/১, রবি শাস্ত্রী ১৬১/১
ভারত ১ম ইনিংস : ৩৯৭/১০
সুনীল গাভস্কার ৮, কৃশ শ্রীকান্থ ৫৩, মহিন্দর অমরনাথ ১, মোঃ আজহারউদ্দীন ৫০, রবি শাস্ত্রী ৬২, চন্দ্রকান্ত পন্ডিত ৩৫, কপিল দেব ১১৯, কিরন মোরে ৪, চেতন শর্মা ৩০, শিবলাল যাদব ১৯, মানিন্দর সিং ০০ অপঃ
গ্রেগ ম্যাথুস ১০৩/৫, রে ব্রাইট ৮৮/২, স্টীভ ওয়াহ ৪৪/১, ব্রুস রিড ৯৩/১
অস্ট্রেলিয়া ২য় ইনিংস : ১৭০/৫ ডিক্লেয়ার
জিওফ মার্শ ১১, ডেভিড বুন ৪৯, ডিন জোন্স ২৪, এ্যালান বোর্ডার ২৭, গ্রেগ রিটচি ২৮, গ্রেগ ম্যাথুস ২৭ অপঃ, স্টীভ ওয়াহ ২ অপঃ
রবি শাস্ত্রী ৫০/২, মানিন্দর সিং ৬০/৩
ভারত ২য় ইনিংস (লক্ষ্য ৩৪৮) : ৩৪৭/১০
সুনীল গাভস্কার ৯০, কৃশ শ্রীকান্থ ৩৯, মহিন্দর অমরনাথ ৫১, মোঃ আজহারউদ্দীন ৪২, চন্দ্রকান্ত পন্ডিত ৩৯, কপিল দেব ১, রবি শাস্ত্রী ৪৮ অপঃ, চেতন শর্মা ২৩, কিরন মোরে ০, শিবলাল যাদব ৮, মানিন্দর সিং ০
গ্রেগ ম্যাথুস ১৪৬/৫, রে ব্রাইট ৯৪/৫
ফলাফল : টাই
______
- 0 মন্তব্য