মিনহাজুল আবেদীনঃ বিশ্বকাপে বাংলাদেশের প্রথম জয়ের নায়ক
পোস্টটি ২৯৬১ বার পঠিত হয়েছেলেখাটা শুরু করার আগে একটা গল্প বলা যাক।
২০০২ সালের মে মাস। আর ক’দিন পরেই জাপান-কোরিয়াতে শুরু হবে ফুটবল বিশ্বকাপ। কোথায় বিশ্বকাপ নিয়ে বুঁদ হয়ে থাকবে তা না, ব্রাজিলে চলছে বিক্ষোভ, আলোচনা- সমালোচনা। লুইজ ফেলিপে স্কলারির বিশ্বকাপের দলে যে জায়গা পাননি রোমারিও!!
সাধারণ মানুষের মুখ দিয়ে আগুন বেরচ্ছিলো সমানে। সেই আগুনে ঘি ঢাললেন ব্রাজিলের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ফারনান্দো হেনরিক কারদোসো। তিনি সরাসরি বললেন যে তিনি রোমারিওর সাথে আছেন। কথাটা এখানে শেষ হলেই ভালো হতো। তা না করে তিনি স্কলারিকে আহ্বান জানালেন রোমারিওকে দলে নেয়ার জন্য।
স্কলারি বিরক্ত হলেন খুব। তিনি সরাসরি জানিয়ে দিলেন, তিনি তো প্রেসিডেন্টের মন্ত্রীসভায় কে আছে তা নিয়ে মাথা ঘামান না। তাহলে প্রেসিডেন্ট সাহেব কেন বিশ্বকাপ স্কোয়াডে কে থাকবে তা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন?
সেবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল ব্রাজিল। রোমারিওকে ছাড়াই বাকি তিন ‘আর’ এনে দিয়েছিলেন পেন্টা। না জিতলে কী হতো সেটা বুঝতে বেগ পেতে হয় না। বিশ্বকাপে রানার্স-আপ হওয়াটাও যেখানে গুরুতর অপরাধ, সেখানে জনপ্রিয় কাউকে বাদ দিয়ে যদি হারতে হয় তাহলে সেই কোচের কপালে কী ঘটতে পারে অনুমান করতে খুব বেশী কষ্ট হওয়ার কথা নয়।
এর বছর তিনেক আগের কথা। ব্রাজিল থেকে সুদূর বাংলাদেশ। :)
১৯৯৯ বিশ্বকাপের জন্য ঘোষিত হলো বাংলাদেশের স্কোয়াড। প্রথম বিশ্বকাপের দলে সবার নাম ছিল। শুধু ছিল না একজনের নাম। মিনহাজুল আবেদীন নান্নুর নাম।
তখন ফেসবুক ছিল না। ইন্টারনেটও ছিল হাতেগোণা কয়েকজন মানুষের বাসায়। যেকোনো ব্যাপারে খবরের কাগজই ছিল শেষ ভরসা। নান্নু বিশ্বকাপ দলে জায়গা না পাওয়ায় হইচই পড়ে গেল চারদিকে। খবরের কাগজে বারবার নিউজ হতে লাগলো এটা নিয়ে। নির্বাচকদের কাছে জানতে চাওয়া হলো কেন নান্নু নেই স্কোয়াডে। নির্বাচকরা কোন সদুত্তর দিতে পারলেন না। কীভাবে পারবেন? কোন সদুত্তর থাকলে তো!! ভাগ্যিস তারা স্কলারির মতো হননি। স্কলারির মতো ‘ঘাউড়া’ হলে সেবার খবরই ছিল বাংলাদেশের।
সরাসরি কথা বলতেন নান্নু। মনে করা হয়, একারণেই তাঁর উপরে এরকম খড়গহস্ত হয়েছিলেন নির্বাচকেরা। অথচ ১৯৯৮-৯৯ সালে তিনি ছিলেন ঘরোয়া ক্রিকেটের সেরা পারফরমার। বিশ্বকাপের জন্য ৩০ জনের প্রাথমিক দল ঘোষণার আগে যে প্র্যাকটিস ম্যাচটির আয়োজন করা হয়েছিল, তাতে তিনি খেলেছিলেন ১৩০ রানের এক অনবদ্য ইনিংস। এর পরও দেখা গেল, ৩০ জনের দলে তিনি নেই। শেষ পর্যন্ত ক্ষোভে উত্তাল দেশবাসীর ক্ষোভের মুখে নড়েচড়ে বসেন দেশের নীতি-নির্ধারকেরাও। তত্কালীন প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত হস্তক্ষেপে মিনহাজুল শেষ পর্যন্ত বিশ্বকাপ দলে অন্তর্ভুক্ত হন। কোনো খেলোয়াড়কে দলে অন্তর্ভুক্ত করতে দেশের সর্বোচ্চ পদাধিকারী ব্যক্তির হস্তক্ষেপ নতুন কিছু না হলেও বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে মিনহাজুলের ঘটনাটি ছিল প্রথম।
২.
বিশ্বকাপে বাংলাদেশের প্রথম ম্যাচ ছিল নিউজিল্যান্ডের সাথে। সেই ম্যাচে দলেই জায়গা হলো না তাঁর। ড্রেসিংরুমে বসে দেখলেন দলের হার। দ্বিতীয় ম্যাচে ফিরলেন মোহাম্মদ রফিকের জায়গায়; সুবিধা হলো না সে ম্যাচেও; করলেন মাত্র ৫ রান। তবে ফর্মে ফিরলেন একেবারে মোক্ষম সময়ে; স্কটল্যান্ডের সাথে যখন ২৬ রানে ৫ উইকেট হারিয়ে থরথর করে কাঁপছে বাংলাদেশ। সেই অবস্থায় নাইমুর রহমান দুর্জয়ের সাথে গড়লেন ৭১ রানের পার্টনারশিপ। দলকে ৯৬ রানে রেখে দুর্জয় আউট হলেও তিনি থেকে গেলেন শেষপর্যন্ত, অপরাজিত ৬৮ রান করে দলকে নিয়ে গেলেন ১৮৫ রানের ভদ্রস্থ স্কোরে। ৬৮ রান খুব বড় কিছু না। একটা হাফসেঞ্চুরিই তো!! কিন্তু শুধুমাত্র একটা হাফসেঞ্চুরি কিংবা ৬৮ রানকে মাপতে গেলে ভুল হবে। পরিস্থিতি বিবেচনায় ওয়াংখেড়ে ধোনীর ৯১ কিংবা লারার ১৫৩’র চেয়ে কোন অংশে কম গুরুত্বপূর্ণ মনে হয় না আমার কাছে। ক্রুশিয়াল মোমেন্টে ম্যাচ বাঁচানো ইনিংস।
স্কটল্যান্ড খারাপ খেলছিল না। ৮৩ রানে ৬ উইকেট পড়ে গেলেও গ্যাভিন হ্যামিল্টন নামের এক বাঁহাতি ব্যাটসম্যান স্কটল্যান্ডকে নিয়ে যাচ্ছিলেন জয়ের দিকে। কিন্তু ১৩৮ রানে এক দুর্ভাগ্যজনক রানআউটের পর আর পেরে উঠলো না স্কটল্যান্ড। অলআউট হলো ১৬৩’তে। বাংলাদেশ ম্যাচ জিতলো ২২ রানে।
৬৮ রানের পরে বোলিঙে এক উইকেট নিলেন নান্নু। হলেন ম্যান অব দ্য ম্যাচ। যাকে স্কোয়াডেই নেয়া হচ্ছিলো না সেই খেলোয়াড়টিই হয়ে গেলো বাংলাদেশের প্রথম বিশ্বকাপের প্রথম জয়ের নায়ক। তবে ইয়ান ফিলিপের কাছে কৃতজ্ঞ থাকতে পারে বাংলাদেশ। স্লিপে ক্যাচ ফেলার কারণেই না নান্নুর ব্যাট থেকে এলো সেই ৬৮ রান। আরও কৃতজ্ঞ থাকতে পারে ‘মিঃ এক্সট্রা’র কাছেও। দলের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ (৪৪) যে তারই।
পরের ম্যাচ অস্ট্রেলিয়ার সাথে। সেই ম্যাচে ৫৩। ব্যাক টু ব্যাক হাফ সেঞ্চুরি। দল হারলো বাজেভাবে কিন্তু নির্বাচকদের মুখে আরও একদফা চুনকালি লাগানোর কাজটা ভালোভাবেই করলেন মিনহাজুল আবেদীন।
মার্ক টোয়েন বলেছিলেন, “ট্রুথ ইজ স্ট্রেঞ্জার দ্যান ফিকশন।” তাঁকে একটা স্যালুট।
৩.
বিশ্বকাপের শেষ ম্যাচ ছিল পাকিস্তানের সাথে। সেই ম্যাচে ব্যাটহাতে নান্নু করলেন ১৪, বোলিঙে নিলেন ১ উইকেট। সে হতেই পারে। রোজ রোজ তো কেউ ভালো খেলতে পারে না। সেই ম্যাচের রেজাল্ট কী ছিল আশা করি বলে দিতে হবে না।
তবে বিস্ময়ের ব্যাপারটা ঘটলো অন্য জায়গায়। পাকিস্তানের সাথে ম্যাচটাই হয়ে গেলো নান্নুর ক্যারিয়ারের শেষ ম্যাচ!! পাকিস্তানের সাথে জেতার এক বছরের মাথায় টেস্ট স্ট্যাটাস পেলো বাংলাদেশ; অভিষেক টেস্ট খেলতে নামলো তারও মাস পাঁচেক পর। সেই টেস্ট ম্যাচের স্কোয়াড নিয়েও কত কাহিনী। হাবিবুল বাশার, আমিনুল ইসলাম বুলবুল আর মিনহাজুল আবেদীনকে তো নেয়াই হলো না। এবারও ব্যাপক সমালোচনার পরে অভিষেক টেস্টের দলে অন্তর্ভুক্ত হলেন হাবিবুল আর আমিনুল। কিন্তু যাকে মনে করা হতো; ইনফ্যাক্ট এখনও মনে করা হয় টেস্ট না খেলা বাংলাদেশের এ যাবৎকালের সেরা ক্রিকেটার সেই মিনহাজুলের আর জায়গা হলো না। দলে জায়গা পেয়ে হাবিবুল করলেন ৭১, আর আমিনুল তো চার্লস ব্যানারম্যান এবং ডেভ হটনের পাশেই বসে গেলেন।
নান্নুকে অভিষেক টেস্টের দলে রাখলে কি আমরা প্রথমবারের মতো অভিষেক টেস্টে দু’জন ব্যাটসম্যানের ডাবল সেঞ্চুরি পেতাম?
হয়তো পেতাম।
হয়তো না।
কে বলতে পারে!!
৪.
লেখাটা যখন লিখছি তখন বাংলাদেশ- আফগানিস্তানের প্রথম ওয়ানডে শেষ হয়েছে কয়েক ঘণ্টা। কষ্ট করে হলেও জিতে গেছে বাংলাদেশ। খেলা দেখা আর অন্যান্য কাজ মিলিয়ে লেখাটা লিখতে দেরী হয়ে গেলো।
গতকাল ২৫ সেপ্টেম্বর ছিল মিনহাজুল আবেদীন নান্নুর ৫১তম জন্মদিন।
নান্নু, প্রধান নির্বাচক হিসেবে সফল হোক আপনার ক্যারিয়ার। সকল বাধা-বিপত্তি, সমালোচনা কভার ড্রাইভে পাঠিয়ে দিন মাঠের বাইরে। যেভাবে ম্যকগ্রাকে কভার ড্রাইভে মাঠের বাইরে পাঠিয়েছিলেন।
শুভ জন্মদিন আপনাকে।
- 0 মন্তব্য