• ক্রিকেট

ভালবাসাঞ্জলী

পোস্টটি ৩২৩৫ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

মাশরাফি বিন মর্তুজা !

একজন ক্রিকেটারের গন্ডী ছাড়িয়ে যিনি অন্য উচ্চতায় পৌছে গেছেন। তাঁর হার না মানা মনোবলে নিজেকে অনন্যরুপে উপস্থাপন করেছেন, করে চলেছেন প্রতিনিয়ত-ই। ইঞ্জুরি নামক ‘ক্যারিয়ার-ঘাতি বিপদ’টাকে সঙ্গী করে পথ চলছেন, অভিষেকের পর থেকেই। ইঞ্জুরিতে কাতরাতে কাতরাতে কতবার মাঠের বাইরে গেলেন আর রাজসিক প্রত্যাবর্তন করলেন তার যদি কোন তালিকা করা হয়, সেটাও নিশ্চয় মোটাসোটা কোন বইয়ের আকার হয়ে দাঁড়াবে। এক-দু বার নয়, বারবার গেছেন ধারালো ছুরির নীচে। জীবন-নাশের হুমকি সত্ত্বেও কেবল এবং কেবলমাত্র খেলে যাচ্ছেন, দেশ ও দেশের মানুষের জন্য।

কারণ, দেশ ও দেশের মানুষই তাঁর বেঁচে থাকার স্পন্দন।

বারংবার দল থেকে বাদ পড়েও ফিরে আসতেন বলে ভারতের সৌরভ গাঙ্গুলি কে ডাকা হতো ‘কামব্যাক কিং’ নামে। আর বারবার ইঞ্জুরিতে পড়েও রাজসিক প্রত্যাবর্তন করা মাশরাফিকে কি বলে ডাকবেন, সেটা না-হয় আপনিই ঠিক করুন।

 

সেবার পেলেন দেশকে নেতৃত্ব দানের সুযোগ। জীবনে প্রথমবারের মতো দলনেতা হয়ে, গেলেন সুদূর ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জে। স্বপ্নালু চোখে শ্বেত-পোষাকের উপর ব্লেজার জড়িয়ে নামলেন ফ্লয়েড রেইফারের সঙ্গে টস করতে। টস করলেন। ব্যাট করলেন। কিন্তু যা তাঁর আসল কাজ, দলকে নেতৃত্ব দেয়ার সাথে সাথে বোলিং ইউনিটকে নেতৃত্ব দেয়া, তা আর করতে পারলেন না। বোলিং করতে গিয়ে মুখ থুবড়ে পড়লেন। ব্যাথায় কাতর মাশরাফি মাঠ ছাড়লেন, দুজন সতীর্থের কাঁধে হাত দিয়ে ! আহা, সে কী দুঃসহ মূহুর্ত !

 

অস্ট্রলিয়ান শল্যবিদ ডেভিড ইয়াং। মাশরাফির চিকিৎসক।  সেই ২০০৩ সাল থেকে তিনি মাশরাফির দেখভাল করছেন। মাশরাফি প্রতিবার মাঠে ফেরেন। আর ডেভিড ইয়াং চমকে উঠেন। চোখ কপালে তুলে বলেন, এ-ও কি সম্ভব ! এই ধরণের ইঞ্জুরি থেকে সেরে উঠা একজন মানুষ, ফাষ্ট বোলিং করছে ! রান বাঁচাতে হুট-হাট লাফ-ঝাঁপ দিচ্ছে ! তিনি চমকে উঠেন, অবাক হন। তাই মাশরাফি ইঞ্জুরিতে পড়লেও এখন তিনি মুচকি হাসেন আর বলেন, "আমাকে আরেকবার অবাক করে দাও, পাগলা!"

 

২০১০ সালে তিনি মাঠে ফিরেছিলেন, ফিরেই পেয়েছিলেন অধিনায়কত্ব। আর ভাগ্যের কী নিষ্ঠুরতা ! অধিনায়ক হয়ে এবারও ম্যাচটা তাঁর শেষ করা হলো না। তিনি আবার মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়লেন। আবারও সেই দুঃসহ দৃশ্যের অবতারণা...  ব্যাথায় কাতরাতে কাতরাতে মাশরাফির মাঠ ছেড়ে যাওয়া। স্বদেশের আঙিনায় অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপে মাঠ মাতাতে সে কী নিরন্তর প্রচেষ্টা ! ইঞ্জুরিকে তুচ্ছ জ্ঞান করে, চালিয়ে গেলেন ‘বিশ্বকাপ-দলে’ ফেরার কঠিন এক লড়াই। এখানেও নিয়তির নিষ্ঠুরতার বলি হলেন তিনি ! শতভাগ ফিট না-থাকায় দলে জায়গা হলো না, তাঁর। দেশের মাটিতে বিশ্বকাপ, অথচ তিনি হয়ে গেলেন দর্শক ! চোখের জলে মেনে নিলেন তাকে নিয়ে ভাগ্যের খেলা। আর হয়তো বা মনে মনে পণ করছিলেন, ভাগ্যকে একহাত দেখে নেয়ার !

 

চিরন্তন অপরাজেয় মনোভাবের মাশরাফি, এবারও সব সংশয় আর হতাশাকে পাশ কাটিয়ে মাঠে ফিরলেন। দলে ফিরলেন। এবং তৃতীয়বারের মতো পেলেন অধিনায়কত্ব। দলের নেতা হয়ে দলকে নেতৃত্ব দিলেন বিশ্বমঞ্চে। জিতলেন, জেতালেন। দেশের ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে স্বর্ণালী এক অধ্যায় উপহার দিলেন, স্বদেশের মানুষদের। তাঁর অধীনে টানা ছয়টি ওয়ানডে সিরিজ জেতালেন। সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে গেলেন, দিয়ে যাচ্ছেন।

মাঠে এবং মাঠের বাইরে তাঁর নিপুণ পরিচালনায় গড়ে উঠেছে দুর্দান্ত এক অপরাজেয় শক্তি। তাঁর দৃঢ়চেতা মনোভাবের সাথে সঙ্গতি রেখেই তিনি গড়ে তুলেছেন, দৃঢ়-আত্নপ্রত্যায়ে বলীয়ান, রক্তের শেষ বিন্দু দিয়ে লড়াই প্রত্যাশী, অনমনীয় চিত্তের, হারার আগে হার না মানা দুরন্ত এক দল। যারা ঠিক তাঁর মতো করেই প্রবল-প্রতাপশালী প্রতিপক্ষের চোখে চোখ রেখে কথা বলে, কঠিন শক্তিশালী প্রতিপক্ষের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করার সামর্থ্য ও সাহস রাখে।

 

বারবার ইঞ্জুরিতে পড়ে বারবার ফিরে আসার মন্ত্রটা ভালো করেই জানেন তিনি। সেই মন্ত্রবলেই অবলীলায় জয় করেন, দূর্জেয় সব বাঁধা। অকপটে ঝাঁপিয়ে পড়েন দেশের জন্য। তাই মাশরাফি আর কেবলমাত্র ক্রিকেটার থাকেন না, হয়ে যান তার চেয়েও বেশী। তাঁর একেকটি কথা, একেকটি বাক্য হয়ে যায়, অফুরন্ত প্রেরণার উৎস। অনন্ত উৎসাহের ফোয়ারা হয়ে যান, ব্যাক্তি মাশরাফি। 

তাঁর ফিরে আসার মন্ত্রটা শুনুন একবার, “বারবার ইঞ্জুরি থেকে ফিরে আসার প্রেরণা পাই, বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কাছ থেকে। এমনও ম্যাচ গেছে আমি হয়তো চোটের কারণে সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছিলাম না। দুই-তিনটা বল করেই বুঝতে পারছিলাম সমস্যা হচ্ছে। তখন তাদের স্মরণ করেছি।  নিজেকে বলেছি, হাতে-পায়ে গুলি লাগার পরও তাঁরা যুদ্ধ করেছিলেন কীভাবে ? তোর তো একটা মাত্র লিগামেন্ট নেই ! দৌড়া...।” 

এই লোক বারবার প্রত্যাবর্তন করবে না তো কে করবে ?

 

মাশরাফির বারবার প্রত্যাবর্তনে তাঁর চিকিৎসক ডেভিড ইয়াং অবাক হন। এবং কীভাবে এই লোক বারবার ফিরে আসে, তার একটা ব্যাখ্যা দাঁড় করানোর চেষ্টা করেন। "আমার মনে হয় এটা সম্ভব হয়েছে ওর মানসিক শক্তি এবং বাংলাদেশ ক্রিকেটের প্রতি নিবেদনের কারণে।"

নিবেদন ! দেশের ক্রিকেটের জন্য তাঁর নিবেদন কতটা, তা বোঝার সাধ্য একমাত্র বিধাতার পক্ষেই হয়তো সম্ভব। তাঁর নিবেদন বোঝা, সাধারণ মানুষের কর্ম নয় ! যে লোক বলে, "দেশের পতাকা হাতে দেশের জন্য দৌড়ানোর গর্ব আর কিছুতেই নেই। পায়ে আরও হাজারটা অস্ত্রোপাচার হোক, এই দৌড় থামাতে চাই না আমি।" ভাবুন অবস্থা ! এই লোকের নিবেদনের মাত্রা নিরুপন করার সামর্থ্য কি আমার-আপনার, আমাদের মতো সাধারণের আছে ! বলেন ?

 

ইস্পাত-কঠিন তাঁর মনোবল। সাহস তাঁর মাত্রাছাড়া, কখনো কখনো যা দুঃসাহসে রুপান্তরিত হয়। তবে এসবের বাইরেও আছেন একজন মাশরাফি। যিনি বন্ধু বলতে অজ্ঞান। বন্ধুর জন্য নিজের জীবনটাকে বাজী রাখতে পারেন, হাসতে হাসতে। হাস্যরস আর আড্ডাতে মাতিয়ে রাখতে পারেন ঘন্টার পর ঘন্টা। তাঁর এই প্রাণোচ্ছল স্বভাবের কারণে, ডেভ হোয়াইটমোর নাম দিয়েছিলেন ‘পাগলা’।

 

আপাদমস্তক সহজ-সরল সোজাসাপ্টা এই মানুষটা যা বলেন, তা নিজে মনে-প্রাণে বিশ্বাস করেন। কোন ভান-ভণিতার আশ্রয় নেন না। ইঞ্জুরিতে ক্যারিয়ার শেষ হয়ে গেলে কি করবেন প্রশ্ন শুনেও তাই তাঁর অকপট উত্তর থাকে, "স্ট্রেইট নড়াইল চলে যাব... জীবনে যা কিছু করব নড়াইলেই করব।" জমাট আত্নবিশ্বাস-ই তাঁর চালিকা শক্তি ছিল সবসময়। তাই হয়তো ইঞ্জুরিতে পড়লেও দৃপ্ত স্বরে ফিরে আসার ঘোষণা দিতে পারেন অনায়াসে। "আমার বিশ্বাস, আমি ফিরে আসতে পারব । বিশ্বাস আছে আমার ক্যারিয়ার শেষ হবে অবসর নিয়ে । আমি যদি কালও অবসর নিই, আমি নিজে সিদ্ধান্ত নিয়ে নেব। ইঞ্জুরির কাছে হেরে নয়। বাকীটা উপর ওয়ালার হাতে।"

তিনি ফিরে এসেছেন। হয়তো আগামীতেও ফিরে আসবেন। তিনি জীবন-রণে লড়াকু-যোদ্ধা, তিনি কি করে হার মানেন ?

 

দেশের ক্রিকেটের প্রতি তাঁর অবদান স্বর্ণাক্ষর কোন ছাই, প্লাটিনামের চেয়েও দামী কিছু থাকলে, তা দিয়ে বাঁধাই করা দরকার। ক্ষণজন্মা এই ক্রিকেটার কেবলমাত্র দেশের ক্রিকেটকেই তো সমৃদ্ধ করছেন না, সমৃদ্ধ করছেন আরো অনেক কিছুকেই। তাঁর চলন-বলন, তাঁর ধ্যানধারণা, তাঁর দর্শন, তাঁর রচনা... সবকিছুই অনন্যতায় ভরপুর।

তাঁর সবকিছু দিয়েই আমরা সমৃদ্ধ হচ্ছি।

 

আমরা হয়তো সৃষ্টিকর্তার কাছে কৃতজ্ঞতা জানাতে পারি এই বলে যে, তিনি আমাদের একজন মাশরাফি দিয়েছেন। মাশরাফি নামের এই ‘অকুতোভয় প্রাণপুরুষ’ যে তাঁর প্রাণপ্রাচুর্য্যে, প্রতিনিয়ত মুগ্ধ করে যাচ্ছেন আমাদের। তাঁর অনিঃশেষ জীবনী শক্তিতে কৃতজ্ঞ করে চলেছেন পুরো জাতিকে।

দেশ ও দেশের মানুষের জন্য তাঁর এই নিবেদন, তাঁর এই ত্যাগের বিনিময় দেয়ার সাধ্য আমাদের নেই। আমরা কেবল তাকে বুকভরা ভালবাসা দিতে পারি। হৃদয়টাকে উজার করে দিয়ে তাকে ভালবাসতে পারি। তাঁর প্রতি সেই ভালবাসা-ই অঞ্জলি ভরে সাজিয়ে এনেছি।

প্রিয় মাশরাফি, আপনি ভাল থাকুন। সুস্থ থাকুন। ইঞ্জুরি মুক্ত থাকুন। বাংলাদেশ ক্রিকেটের এই নব পথচলায়, আপনাকে চাই আরো বহুদিন।

সৃষ্টিকর্তা আপনার সহায় হোন।

 

শুভ জন্মদিন, মাশরাফি বিন মর্তুজা।

 

(পূর্ব-প্রকাশিত)