• ক্রিকেট

একজন ভেরী ভেরী স্পেশাল

পোস্টটি ৭৭০৪ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

পঁচিশ বছর বয়সের টগবগে তরুণ তিনি। আগের ষোলটি টেস্টে মাত্র তেইশ-চব্বিশ গড়ে রান করেছেন। একটাও সেঞ্চুরী পাননি। বলার মতো কিছু করে দেখাতে পারেননি চলতি সিরিজেও। এডিলেইড, মেলবোর্ন দুটি টেস্টেই ছিলেন ব্যর্থ। দলও হেরেছে যাচ্ছে-তাই ভাবে। তৃতীয় টেস্টে কিছু করতে না পারলে, চরম লজ্জা নিয়ে ফিরতে হবে দেশে।

এমন এক পরিস্থিতিতে সিডনীতে মাঠে নেমেছিলেন তিনি। প্রথম ইনিংসে হয়েছেন যথারীতি ব্যর্থ। তাঁর দলও সাকূল্যে স্কোর বোর্ডে জমা করলো ‘দেড়শ’ রান। যার জবাব স্টীভের নিষ্ঠুর অস্ট্রলিয়া দিল ৫৫২ করে।

৪০২ রানে পিছিয়ে থেকে দলের দ্বিতীয় ইনিংসের সূচনায়, উদ্বোধনী ব্যাটসম্যান হিসেবে যখন তিনি ম্যাকগ্রা-লি-ওয়ার্নের মুখোমুখি হতে নামছিলেন তখন কি ভাবছিলেন কে জানে! এই হয়তো শেষ সুযোগ কিছু করে দেখানোর, নিজের সামর্থ্য প্রমাণের দ্বিতীয় সুযোগ হয়তো আর মিলবে না, তেমন কিছু কি ভাবছিলেন?

হয়তো, হ্যাঁ।

কারণ এরপর অস্ট্রলীয় বোলারদের কচুকাঁটা করে, কব্জীর শৈল্পিক মোচড়ে ১৯৮ বলে ১৬৭ করলেন, মাত্র সোয়া চার ঘন্টায়। দলের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ কত ছিল জানেন? সৌরভ গাঙ্গুলির ২৫!

তাঁর অসাধারণ ইনিংসটির পরও দলের বড় পরাজয় ঠেকাতে পারেননি ঠিকই, কিন্তু ঠেকিয়ে দিয়েছিলেন নিজের ক্যারিয়ার-বিপর্যয়! তাঁর কব্জীর প্রেমে পড়তে বাধ্য করেছিলেন ক্রিকেট-বিশ্বকে। সেই ক্যারিয়ার-ফাঁড়া কেটে যাওয়ার পর নিজেকে এমনভাবে মেলে ধরলেন যে, ক্রিকেট বিশ্ব বুঁদ হয়ে রইলো তাঁর কব্জীর মোচড়ে। পরবর্তী একযুগ ধরে ক্রিকেটের ক্ল্যাসিক-ঘরানা কাকে বলে, তিনি তা দেখিয়ে গেছেন বড় উদারচিত্তে, অকপটে!

 

তিনি ভাংগিপুরাপ্পু ভেংকাটা সাই লক্ষণ, সংক্ষেপে ভিভিএস লক্ষণ। বিশেষ মুহূর্তে বিশেষ ইনিংস খেলতেন বলে, ক্রিকেট-বিশ্ব যাকে ভালবেসে নাম দিয়েছিল, ‘ভেরী ভেরী স্পেশাল’ লক্ষণ! ভিভিএস এর অন্যরুপ ভেরী ভেরী স্পেশাল যে!

 

সিডনী টেস্টের ঠিক চার টেস্ট পর নিজেকে নিয়ে গেলেন অন্য উচ্চতায়। দলের বিপর্যয়ে আরো একবার আবির্ভাব হলেন ত্রাতার ভূমিকায়। এবার আর ১৬৭তে থামলেন না, খেললেন ২৮১ রানের ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম এক সেরা ইনিংস। ২৭৪ রানে পিছিয়ে ফলোঅনে পড়ে ব্যাট করতে নামা দলটা পরিস্থিতি ৩৬০ ডিগ্রী ঘুরিয়ে দিয়ে ম্যাচ জিতল ১৭১ রানে, সে তো তাঁর অমন এক অতিমানবীয় ইনিংসের কল্যাণেই।

এটা এমনই এক ইনিংস যে, এই ইনিংস নিয়ে শত শত গল্পগাঁথা হয়ে গেছে, দিস্তার পর দিস্তা কাগজ খরচ হয়ে গেছে ইনিংসের বীরত্ব-মাহাত্ন্য বর্ণনায়। মাত্র এই একটি ইনিংসে, ক্রিকেটের শতবর্ষী ইতিহাসে নিজের জন্য সৃষ্টি করেছেন আলাদা এক বর্ণাঢ্য এক অধ্যায়।

 

সেই সিডনী হয়ে কলকাতা টেস্ট থেকে এডিলেইডে জীবনের শেষ টেস্টটি পর্যন্ত, কতবার তিনি দলের বিপদে দাঁড়িয়েছেন বুক চিতিয়ে, একা একা সংগ্রাম করে গেছেন বিরুদ্ধ দেশ-কাল-পরিস্থিতিতে! মোহালীতে ১২২ রানে সপ্তম উইকেট হিসেবে যখন অধিনায়ক-ধোনী আউট হয়েছিলেন, ভারত জয় থেকে আরো ৯৪ রান দূরত্বে দাঁড়িয়ে। অস্ট্রলীয়-দলপতি পন্টিং কপাল কুঁচকে রেখেছিলেন তখনও। কারণ লক্ষণ আছেন। সেই তিনি পন্টিংয়ের কপালের ভাঁজকে, ছড়িয়ে দিলেন সারা মুখে। ম্যাচ শেষে পন্টিং যখন ফিরছিলেন আষাড়ের আকাশ যেন তাঁর মুখাবয়বে।

এক পায়ে খেলেই লক্ষণ তখন ৭৯ বলে অপরাজিত ৭৩ করে, এক উইকেটে ম্যাচ জিতিয়ে মাঠ ছাড়ছেন যে!

 

১৯৯৯ বিশ্বকাপের আগে দলে এসেছিলেন, থিতু হতে পারেননি। তাই সেবার বিশ্বকাপ-স্কোয়াডে সুযোগ পাওয়ার প্রশ্নও উঠেনি। ২০০৩ বিশ্বকাপে অবশ্য বিশ্বকাপ-স্কোয়াডের একজন হতে পারতেন। কিন্তু কপাল মন্দ বলে, জায়গা হারালেন দীনেশ মঙ্গিয়ার কাছে। সেবার হঠাৎই আশংকিত হয়েছিলেন, আদৌ কখনো বিশ্বকাপ খেলতে পারবেন কি না!

তাঁর আশংকা সত্যি প্রমাণ করে তিনি আর কখনোই খেলতে পারেননি, বিশ্বকাপ। জন রাইটের পর গ্রেগ চ্যাপেল এলে, ওয়ানডে দলে ব্রাত্য হয়ে পড়েন। ২০০৬ সালের পর খেলতে পারেননি আর একটিও ওয়ানডে। টেস্ট ক্রিকেটে অধিক মনযোগ দিতে বিদায় জানিয়ে দেন, রঙিন পোষাকের ক্রিকেটকে।

 

অনেকেই বলেন, ওডিয়াই গড় ৩০, আর টেস্ট গড় যার ৪৫, তিনি কি করে মহারথীর মর্যাদা পান? 

তাঁরা হয়তো কলম্বোর পঞ্চম দিনে চতুর্থ ইনিংসে, তাঁর ১০৩ রানের কথা জানেন না। জানেন না, ডারবানে দক্ষিন আফ্রিকার বিপক্ষে ৯৬, আহমেদাবাদে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ৯১, ২০০৩ সালে অস্ট্রলিয়ার বিপক্ষে এডিলেইডে ১৪৮, ২০০৮-এ পার্থে ৭৯... এমন অনেক ইনিংস। যে ইনিংসগুলোর মূল্য কোনদিন কোনভাবেই করা যাবে না।

অস্ট্রলিয়ার বিপক্ষে তাঁর অতিমানব হওয়া, দলের বিপর্যয়ে দৃঢ়চিত্তে দাঁড়িয়ে যাওয়া, চতুর্থ ইনিংসে বিরুদ্ধ স্রোতে লড়াই করা... কত কি!  

 

তিনি ভিভিএস লক্ষণ, ভেরী ভেরী স্পেশাল লক্ষণ। শচীন-সৌরভ-দ্রাবিডদের মতো উজ্জ্বল তারকাদের মাঝেও, যিনি নিজের একটা স্বতন্ত্র অবস্থান তৈরী করতে পেরেছিলেন। নীরবে-নিঃশব্দে দলের বিপর্যয়ে ত্রাতা হওয়াতেই ছিল যার সবটুক আনন্দ।

প্রায় সোয়া একযুগ যিনি কব্জীর মোচড়ে মোহাবিষ্ট করে রেখেছিলেন পুরো ক্রিকেট বিশ্বকে।

 

আজ তাঁর ৪২তম জন্মদিন।

শুভ জন্মদিন ‘ভেরী ভেরী স্পেশাল’ লক্ষণ। মাইক্রোফোন হাতেও আমাদের মাঠের ক্রিকেটের মতোই আনন্দ দিবেন, সেই কামনা রইলো।