বলবয় থেকে দার কাপিতান
পোস্টটি ৪৫০৬ বার পঠিত হয়েছে৯ জুন, ২০০৬। জার্মানী বিশ্বকাপের উদ্বোধনী ম্যাচে স্বাগতিকদের প্রতিপক্ষ কোস্টারিকা। ম্যাচের ৬ মিনিটের মাথায় কোস্টারিকা রক্ষণভাগের কিছুটা দূর্বল ক্লিয়ারেন্সে বল পেলেন বাঁ-প্রান্তে খর্বকায় দর্শনের ফুলব্যাক ফিলিপ লাম। উইংয়ে পাস ছাড়বেন ভেবেই তাকে ভেতরে ঢোকার জন্য কিছুটা জায়গা ছেড়ে দিল কোস্টারিকার দুই ডিফেন্ডার। তার ক্ষমতাকে খাটো করে দেখাটাই কাল হয়ে দাঁড়ালো প্রতিপক্ষের জন্য।
বাঁ প্রান্ত থেকে সামান্য ভেতরে ঢুকে তার আচমকা শট বাঁচানোর সাধ্য ছিল না কোনো কিপারেরই। ভোক্টজ, কাল্টজ, ব্রেমে, ব্রিটনার, শ্নেলিঞ্জারদের পর ’০৬ বিশ্বকাপে ফুটবলবিশ্ব পেল আরেক বিশ্বমানের জার্মান ফুলব্যাককে। নাম ফিলিপ লাম। বাভারিয়ানদের কাছে যার পরিচয় ‘দার কাপিতান’ হিসেবেই। খাটো বলে অবমূল্যায়নটা হয়তো লামের জন্য নতুন কিছু নয়।
কিংবদন্তী হলেও উচ্চতার জন্য আর দশটা মানুষের মতই বাধাগ্রস্ত হতে হয়েছে তাকে। লামের জন্মটা হয়েছিল ফুটবল পাগল এক পরিবারেই। মা দানিয়েলা ও বাবা রোলান্ড উভয়েই জার্মান ক্লাব এফটি জার্নের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। সেখানেই পরিচয়-প্রণয়ের পর ১৯৮৩ সালের ১১ নভেম্বর এই দম্পতির ঘর আলো করে আসেন ফিলিপ লাম। শৈশবের ক্লাব জার্নেই শুরু হয়েছিল ফুটবল যাত্রাটা। মাত্র এগারো বছর বয়সে জার্ন থেকে থেকে বায়ার্নে পাড়ি জমান লাম। ছেলেবেলায় লামের আইডল ছিলেন জার্মান মিডফিল্ডার মেহমেত শোল। ডিফেন্ডার হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করার পর শোলের বদলে তার আইডল বনে গেলেন ইতালীয়ান কিংবদন্তী পাওলো মালদিনি।
লামের প্রথম কোচ ছিলেন হারমান হামেলস, ক্লাব ও জাতীয় দলের সতীর্থ ম্যাটস হামেলসের বাবা। বয়সভিত্তিক দলগুলোতে ধারাবাহিকতার পুরষ্কারস্বরূপ অভিষেকের সুযোগ পান ’০২-এ। কিন্তু এরপর পরই লামকে ধারে পাঠিয়ে দেওয়া হয় স্টুটগার্টে। কারণ? উচ্চতার ও দৈহিক শক্তির অভাবে লামে ভরসা পাচ্ছিলেন না বায়ার্নের তৎকালীন কোচ অটমার হিটজফেল্ড। হার মানার ছিঁটেফোঁটাও কখনো ছিল না লামের মধ্যে। হিটজফেল্ডের এহেন সিদ্ধান্তে ভেঙ্গে না পড়ে আরো দ্বিগুণ উৎসাহে কোমর বেঁধে নামেন লাম। লামকে ধারে পাঠানোর সিদ্ধান্তে ক্ষুদ্ধ গুরু হারমান হামেলস মিডিয়ায় প্রকাশ্যে বললেন, “লাম বুন্দেসলিগার জন্য উপযোগী না হলে আর কেউই হবে না”।
গুরুর উৎসাহে যেন আরো তেতে উঠলেন লাম। স্টুটগার্টে যে দুই মৌসুম ছিলেন, এর মধ্যে দ্বিতীয় মৌসুমে (‘০৪-‘০৫) স্টুটগার্ট হল চতুর্থ। ঐ মৌসুমে লাম এতটাই ধারাবাহিক ছিলেন যে, ডিফেন্ডার হয়েও জার্মানির বর্ষসেরা ফুটবলারের দৌড়ে হলেন দ্বিতীয়। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হল, লামের স্টুটগার্ট ক্যারিয়ার শুরুই হয়েছিল একটি ‘মিথ্যা’ দিয়ে। লামকে স্টুটগার্ট মূলত কিনেছিল রাইটব্যাক আন্দ্রেয়াস হিঙ্কেলের বদলি হিসেবে।
লামকে বাজিয়ে দেখার জন্য কোচ মাগাথ লামকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, লেফট ব্যাকে খেলার অভিজ্ঞতা কিনা। লেফট ব্যাকে কখনো না খেললেও দলে সুযোগ পাওয়ার জন্য লাম হ্যাঁ সূচক উত্তর দিলেন। আর ঘাটাঘাটি না করে লামকে রক্ষণভাগের বাঁ প্রান্ত সামলাতে নামিয়ে দিলেন মাগাথ। এই ‘মিথ্যা’ দিয়েই যেন পুনর্জন্ম হল লামের ক্যারিয়ারের।
লামে মাগাথের পাশাপশি মুগ্ধ হয়েছিলেন আরো একজন; রুডি ভোলার, তৎকালীন জার্মানী জাতীয় দলের ম্যানেজার। লামে ভোলার এতটাই মজেছিলেন যে ’০৪-এ আন্তর্জাতিক অভিষেকের পাশপাশি লামকে ধরিয়ে দিয়েছিলেন ইউরো ’০৪ এর মূল আসরের টিকেট। প্রথম আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টটা অবশ্য একেবারেই দুঃস্বপ্নের মত কেটেছিল লামের। বিস্ময়করভাবে গ্রুপপর্ব থেকে বাদ পড়ে জার্মানী। ইউরো শেষে স্টুটগার্টে ফেরত গিয়েই ইঞ্জুরিতে পড়েন লাম।
‘০৫-‘০৬ মৌসুমের জানুয়ারিতে বায়ার্নে ফিরে আসেন লাম। নিজের মাটিতে বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ কোনোভাবেই হাতছাড়া করতে চাননি এই জার্মান। ইঞ্জুরি থেকে ফিরে এসে ঠিকই ফর্ম ফিরে পান লাম। মাগাথের অধীনে সেই যে রক্ষণভাগ সামাল দিতে নামলেন, থামেননি আজো। একাধিক কোচ, খেলোয়াড় এসেছেন, গেছেন; বয়সটাও থেমে নেই, দলের প্রয়োজনে খেলেছেন বিভিন্ন পজিশনও, কিন্তু লাম ঠিকই থেকে গেছেন। আয়নাবাজির ‘আয়না’ যেমন একজনই, ঠিক তেমনি ফুটবলবিশ্বে লামও একজনই।
বিশ্বকাপ শুরুর ঠিক আগে প্র্যাকটিসে কনুইয়ে ব্যথা পান লাম। প্রথম ম্যাচে তার অংশগ্রহণ হয়ে পড়ে প্রশ্নবিদ্ধ। দলে লামের গুরুত্ব এতটাই ছিল যে জার্মানীর চ্যান্সেলর স্বয়ং অ্যাঞ্জেলা মার্কেল জার্মানী ক্যাম্পে এসে খোঁজ নিয়েছিলেন তার। টুর্নামেন্টে ‘ফেবারিট’ হলেও আবারো ‘নেমেসিস’ ইতালীর কাছে সেমিফাইনাল হেরে বিদায় নেয় লাম ও জার্মানী।
আন্তর্জাতিক শিরোপা জয়ের সবচেয়ে সুবর্ণ সুযোগ এসেছিল ইউরো ’০৮-এ। এবার সেমির ফাঁড়া এড়াতে এগিয়ে এসেছিলেন স্বয়ং লামই। তুরষ্কের বিপক্ষে সেই ম্যাচ ও লামের সেই গোল এখনো ফুটবল অনুরাগীদের ছুঁয়ে যায়। কিন্তু আবারো তীরে এসে তরী ডোবায় জার্মানী। এবারের হন্তারক লুইস আরাগোনেসের স্পেন। অপেক্ষা ও দীর্ঘশ্বাস- দুটোই বাড়লো আরেকটু...
ক্লাব ক্যারিয়ারে বায়ার্নের হয়ে অবশ্য ঠিকই সাফল্য পাচ্ছিলেন লাম। মার্সেল ইয়ান্সেনকে জায়গা করে দিতে লামকে সরিয়ে আনা হয় রাইটব্যাকে। অবশ্য ঐ মৌসুম থেকে ডানপ্রান্তে লামের ধারাবাহিকতা দেখে মনে হচ্ছিল, আজীবন যেন রাইটব্যাকেই খেলে এসেছেন এই জার্মান। মার্ক ভ্যান বমেলের প্রস্থানের পর লামের হাতেই ওঠে বায়ার্নের অধিনায়কত্ব। আর ’১০ বিশ্বকাপের পর বালাকের উত্তরসূরি হিসেবে পেয়ে যান জার্মানীর আর্মব্যান্ডটাও।
০৯-১০ মৌসুমে লিগ, কাপ জেতার পর চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনালেও গিয়েছিল লামের বায়ার্ন। আবারো ফাইনালে এসে রৌপ্য পদক নিয়েই খুশি থাকতে হয় লামকে। বায়ার্নের বদলে ‘ট্রেবল’ জেতে মরিনহোর ইন্টার। ক্যারিয়ারে শিরোপার অভাব না থাকলেও একাধিক বড় ফাইনালে বিজিত পক্ষে থাকতে হয়েছে লামকে। লামের ক্লাব পর্যায়ে সবচেয়ে দুঃখজনক হার আসে ১১-১২ চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনালে।
ঘরের মাঠ আলিয়াঞ্জ অ্যারেনাতে চেলসির কাছে ফাইনাল হেরে আবারো রানার আপ হয় লামের বায়ার্ন। রাগে-ক্ষোভে-হতাশায় অবসরের চিন্তাও করেছিলেন লাম। ক্যারিয়ারের অন্ধকার অধ্যায়ে সবসময়ের মত এবারো লামের পাশে ছিলেন হারমান হামেলস। প্রিয় গুরুর অনুপ্রেরণাতেই লেগে থাকার সাহস পান লাম। অবশেষে ২০১২-১৩ মৌসুমে আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। ইয়ুপ হাইঙ্কেসের অধীনে লিগ, কাপ ও পরম অরাধ্য চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জিতে প্রথম জার্মান ক্লাব হিসেবে ‘ট্রেবল’ জিতে নেয় বায়ার্ন। লামের অধীনে এক যুগ পর আবারো ইউসিএল জেতে বায়ার্ন। ২০১৪ সালটা খুব সম্ভবত লামের ক্যারিয়ারের সর্বসেরা বছর।
বারবার তীরে এসে তরী ডোবানো জার্মানী ২৪ বছর পর জিতে নেয় বিশ্বকাপ। বিশ্বজয়ের এই যাত্রায় ব্রাজিলকে তাদের নিজেদেরই মাঠে ৭-১ গোলে অপদস্থ করেছিল লো’য়ের শিষ্যরা। বিশ্বকাপ জিতেই জাতীয় দল থেকে অবসরের ঘোষণা দেন লাম। ১১৩ বার ‘ডি ম্যানশ্যাফট’দের জার্সিতে নামার শেষ ম্যাচেই বাজিমাত করলেন লাম। একাধিক টুর্নামেন্ট শেষে অশ্রু ঝরানো এই জার্মানের কাছে এর চেয়ে মধুর আর কিইবা হতে পারতো।
২০১৮ সালে বায়ার্নের সাথে চলতি চুক্তি শেষে ফুটবল থেকেই অবসরের ইঙ্গিত দিয়েছেন লাম। সব ঠিকঠাক থাকলে ক্যারিয়ারটা শেষ করবেন শৈশবের ভালবাসার ক্লাব বায়ার্নেই। ফুলব্যাক পজিশন ছাড়াও গার্দিওলার অধীনে ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডেও ধারাবাহিকতা দেখিয়ে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন সবাইকে। মেসি, জাভি, ইনিয়েস্তাদের কোচিং করানো গার্দিওলা পর্যন্ত বলেছেন, তার দেখা সবচেয়ে বুদ্ধিমান খেলোয়াড় ফিলিপ লামই। ক্যারিয়ারের সায়াহ্নে এসে নামের পাশে জ্বলজ্বল করছে আটটি বুন্দেসলিগা, সাতটি জার্মান কাপ, একটি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ও একটি বিশ্বকাপ।
স্বদেশের সবচেয়ে সম্মানজনক ক্রীড়া পুরষ্কার ‘সিলবার্নেস লরবিয়ারব্ল্যাট’ জিতেছেন তিনবার। পিরলো, জাভি, জিদান, মালদিনি, ম্যারাডোনা, পেলে-লামে মুগ্ধ সবাইই। ছেলেবেলায় যখন অলিম্পিক স্টেডিয়ামে বলবয় হিসেবে ঘুরে বেড়াতেন, তখন কে ভেবেছিল একদিন এই বলবয়ের পায়ের কারিশমা দেখতেই পুরো অলিম্পিক স্টেডিয়াম কানায় কানায় পূর্ণ হবে? কে ভেবেছিল, এই সামান্য বলবয়ের হাত ধরেই ঘুচবে দুই যুগের বিশ্বকাপ খরা? কে ভেবেছিল, ৫ ফুট ৭ ইঞ্চির এই ‘লিলিপুট’ই হবেন জার্মান ফুটবলের ‘দার কাপিতান’...
- 0 মন্তব্য