• ক্রিকেট

ধৈর্য, তুমি কই?

পোস্টটি ৯৮৬০ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

তাঁর ওয়ানডে ক্যারিয়ারের প্রথম দুইটি ইনিংসই শূন্য রানের, রান পেয়েছিলেন তৃতীয় ম্যাচে এসে। এরপর আবারো সেই ব্যর্থতার ইতিবৃত্ত- সেট হচ্ছিলেন ঠিকই কিন্তু রান বড় করতে পারছিলেন না। ক্যারিয়ারের প্রথম ফিফটি পেয়েছিলেন নবম ম্যাচে এসে, পনের ম্যাচ পরেও ব্যাটিং গড়টা ২৫ পার হয়নি।

ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে আরেকজন ব্যাটসম্যান কিছু ইনিংস খেলেছিলেন শেষের দিকে নেমে যা দলের জয়ে ভূমিকা রেখেছিল। তবে সেভাবে সবার নজর নিজের দিকে ফেরাতে পারেননি, যতটা পেরেছিলেন অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে। মেলবোর্ন এবং সিডনিতে ছয়ে নেমে খেললেন ৪৬ এবং ৮১ রানের অপরাজিত দুটি ইনিংস। ১৯৮৫ সালের সেই প্রস্তর যুগের ওয়ানডেতেই তার স্ট্রাইক রেট এই দুইটি ইনিংসে ছিল একশর উপরে। টুর্নামেন্টের শেষ ম্যাচেও খেলেছিলেন ৫২ রানের আরেকটি সময়োপযোগী ইনিংস। কিন্তু এরপরই ক্যারিয়ারে এসেছে ঘোর দুঃসময়, পরের ২০ ইনিসে দুই অঙ্ক ছুঁয়েছিলেনই মাত্র আটবার এবং এর মধ্যে মাত্র তিনটি ইনিংসে বিশের কোটা পার করতে পেরেছিলেন। টানা চার ম্যাচে আউট হয়েছিলেন তিন রানে, রান না পেলেও বেশি চোখে লেগে থাকত তার আউট হবার ধরন।

প্রথমেই যে ব্যাটসম্যানের কথা বলা হল তিনি প্রথম শতক পেয়েছিলেন ক্যারিয়ারের ৭৯ তম ম্যাচে এসে, এরপর শতক পেয়েছেন আরো ৪৮টি। ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই সবাই জানতেন তিনি স্পেশাল, তবে বেশ কিছু অর্ধশতক পেলেও ‘বিগ ইনিংস’ আসি আসি করেও তার উইলো থেকে আসছিল না। পাঁচ বছর তবুও তিনি দলের সদস্য থেকেছেন, অধিনায়কের সমর্থন পেয়েছেন। এরপর আর পিছনে তাকাতে হয় নি তাঁর, শচীন টেন্ডুলকারের পরবর্তী কর্মকাণ্ড তো ক্রিকেট ইতিহাসেরই অমর কাব্য হয়ে আছে।

দ্বিতীয় যে ব্যাটসম্যানের কথা বল হল তিনি অরবিন্দ ডি সিলভা, শ্রীলঙ্কার ১৯৯৬ বিশ্বকাপ জয়ের অন্যতম সারথী। মিনোস থেকে লঙ্কা যে রাবণ হয়ে পৃথিবী জয় করল তার পিছনে মিডল অর্ডারে খেলা এই ব্যাটসম্যানের বিশাল অবদান। ক্যারিয়ারের শুরুতে ভাল সম্ভাবনা দেখিয়েছিলেন, কিন্তু এরপরের দুটি বছর যে নিদারুণ যন্ত্রণার মধ্যে কাটিয়েছেন তা তো বলাই হল। দলের অধিনায়ক থেকে নির্বাচক তবুও ধৈর্যহারা হননি, সাহস দিয়েছেন, পরিচর্যা করেছেন। হতাশার ঘেরাটোপে থাকা সেই সিলভাই পরে করেছেন ৯২৮৪ রান, এগারটি শতকের পাশাপাশি হাঁকিয়েছেন ৬৪টি অর্ধশতক। শ্রীলঙ্কা ক্রিকেটের পরবর্তী মহীরূহ সাঙ্গাকারা, জয়াবর্ধনে বেড়ে উঠেছেন এই সিলভাকেই আদর্শ মেনে।

শচীন অথবা সিলভা যখন দলে আসেন তখন দলের অবস্থা নিতান্ত সঙ্গিন, ভারত হয়তো তখন দেশের মাটিতে জিততো কিন্তু দেশ-বিদেশ সবখানেই শ্রীলঙ্কার অবস্থা ছিল যাচ্ছেতাই। নির্বাচক, কোচ, অধিনায়ক তখন বুঝতে পেরেছিলেন দীর্ঘমেয়াদি একটি দলের প্রয়োজনীয়তা, এজন্যেই ‘স্পেশাল ট্যালেন্ট’ মনে করা এঁদেরকে সু্যোগ দিয়ে গেছেন ম্যাচের পর ম্যাচ, দিয়েছেন ধৈর্য্যের চূড়ান্ত পরীক্ষা। এর ফলও পেয়েছেন, দুজনই কিন্তু দেশের হয়ে বিশ্বকাপ জিতে শেষ করেছেন ক্যারিয়ার।

বাংলাদেশেও এমন একজন আছেন, তিনি শচীন-সিলভার মত হয়তো হবেন না, কিন্তু বাংলাদেশের ‘দিন আনি দিন খাই’ দলের জন্য তিনি তো শচীনের মতই ‘স্পেশাল’। ক্যারিয়ারের শুরুর কথা হিসেব করলে বরং তিনি তাঁদের থেকেও ভাল! ক্যারিয়ারে এখন পর্যন্ত বিশ ম্যাচে তিনবার এক অঙ্কে আউট হয়েছেন, ডাক খেয়েছেন মাত্র একবার। অনুজ হয়েও দলকে উপহার দিয়েছেন ভরসা দেয়ার মত কিছু ইনিংস, অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডের বাউন্সি পিচ হোক আর উপমহাদেশের মন্থর উইকেট হোক, সবখানেই তিনি দেখিয়েছেন তার সহজাত ব্যাটিং দক্ষতা। পাকিস্তানকে হোয়াইটওয়াশ করতে খেলেছেন ১২৭ রানের অনবদ্য ইনিংস, আবার দক্ষিণ আফ্রিকার বিশ্বসেরা বোলিং লাইনআপকে কচুকাটা করেছেন পরপর দুই ম্যাচে। ২০ ম্যাচ পার হবার পরও তার গড় ৪০ এর উপরে, স্ট্রাইক রেট অবিশ্বাস্য- ৯৯.৪৫!

তিনি এখন ফর্মে নেই এটা সত্যি, কিন্তু তিনি যে বাংলাদেশের ক্রিকেটের জন্য স্পেশাল কেউ এটা কি আপনি অস্বীকার করতে পারেন? সাকিব আল হাসান এবং মাহমুদউল্লাহ বাদে ক্যারিয়ার শুরুর দিকে এমন গড় বাংলাদেশের আর কারো কখনোই ছিল না, এবং তাঁরা সৌম্যের মত মাত্র ২০ ম্যাচের ক্যারিয়ারে একটাও ম্যাচ উইনিং ইনিংস খেলেননি।

সৌম্য এই বছরটাই কাটিয়েছেন বাজে সময়ের আবর্তে; টিটোয়েন্টি বিশ্বকাপ, এশিয়া কাপ- ভাল করতে পারেননি কোথাওই। ঘরের মাটিতে আফগানিস্তানের বিপক্ষে ব্যর্থ হয়েছেন, ইংল্যান্ড সিরিজে সু্যোগই পাননি। বিপিএল এও ভাল করেন নি, টিম ম্যানেজমেন্টের এমন সিদ্ধান্তে আপনি যে ক্ষুব্ধ-তার পিছনে এইসব কারণই হয়তো আছে। কিন্তু এর মধ্যে এমন আর কে আছেন যিনি সৌম্যের তিন নম্বর জায়গাটা নেয়ার মত পারফর্ম করেছেন?

নির্বাচক, কোচ, অধিনায়ক সবাই যে সৌম্যকে এখনো সু্যোগ দিয়ে যাচ্ছেন এটা বাংলাদেশের ক্রিকেটে হয়তো নতুন কিন্তু বিশ্বক্রিকেটে নয়। সৌম্যের উপর এটা একধরনের বিনিয়োগ, বাংলাদেশের মত দলে এমন সু্যোগ তিনি পেতেই পারেন। আর ওয়ানডেতে এখনো তাঁকে ব্যর্থ বলা যায়না। মাত্র তিন ম্যাচ আগেই তার ৯০ রানের ইনিংস আছে, দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে ঐ সিরিজের পর ওয়ানডেতে তাঁর ব্যর্থ হবার পরিধি এখনো অত বৃদ্ধি পায়নি যে বাদ দিতে হবে! নিউজিল্যান্ডের বাউন্সি কন্ডিশনে পরীক্ষিত সৌম্যকে বাদ দিয়ে মিরপুরের স্লো উইকেটে টিটোয়েন্টিতে ভাল করা কাউকে অভিষেক ঘটিয়ে দেয়ার মত বোকামি নিশ্চয়ই টিম ম্যানেজমেন্ট করবে না!

শ্রীলঙ্কার তখন দুর্দিন ছিল, সিলভার মধ্যে ভবিষ্যৎ দেখতে পেয়েছিলেন বলেই নির্বাচকরা তাঁর উপর আস্থা রেখেছিলেন। আতাপাত্তুর প্রথম দশ ইনিংসে দশ পেরুনো স্কোর ছিলই মাত্র দুটি, নির্বাচকরা তবুও তাঁকে দল থেকে বের করে দেননি। আতাপাত্তুর মত প্রতিভা শ্রীলংকান ক্রিকেটে আর ছিলনা বলেই আতাপাত্তুকেই ঘষেমেজে শাণিত করার পণ নির্বাচকরা করেছিলেন। বাংলাদেশ এখন যেমন চিৎকার দিয়ে ছোট দল তকমা থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে, বড় বড় দলগুলোর সাথে কেবল দেশের মাটিতেই নয় বরং বিদেশের মাটিতে গিয়েও লড়াই করেতে চাইছে; নব্বই দশকের শুরুর ভাগে শ্রীলংকার ক্রিকেটেরও ছিল একই দশা। পার্থক্য হচ্ছে তাঁরা ধৈর্য ধরে ছিলেন, সঠিক প্রতিভা তুলে এনে ব্যর্থতার পরও নিরলস পরিচর্যা করেছিলেন। ব্যাটিং আভিজাত্য, বাউন্সি-মন্থর যেকোন উইকেটে বড় ইনিংস এবং শট খেলার ক্ষমতা নিয়ে অবশ্যই সৌম্য সরকার বাংলাদেশের ক্রিকেটে সেই পরিচর্যার দাবী রাখেন। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক হবার পর এমন উন্মত্ততা সৌম্যের আগে আর কেউ কি বাংলাদেশে দেখিয়েছেন?  

সৌম্যকে খেলার সুযোগ দেয়ার জন্য দলীয় থিঙ্কট্যাঙ্কের সমালোচনা করা একেবারেই অবান্তর। সমর্থকরাই হয়তো সৌম্যের বড় ইনিংস খেলার পিছনে সবচাইতে বড় শত্রু, কিন্তু এটা বুঝার ক্ষমতা এদেশের বেশিরভাগ সমর্থক গোষ্ঠীর এখনো আসে নি!