বাংলাদেশ ক্রিকেটের শতায়ু হোক
পোস্টটি ৫১৩১ বার পঠিত হয়েছেবাংলাদেশের খেলা প্রথম কবে দেখেছিলাম? ওমম... বলা কঠিন। সম্ভবত ১৯৯৭-৯৮ এর দিকে, কেনিয়ায় যে একটা ত্রিদেশীয় সিরিজ হলো বোধহয় সেবার। সন্ধ্যার দিকে বাসায় কারেন্ট ছিল না। এক বন্ধু কোত্থেকে দেখে এসে আব্বুকে জানালো, ‘আংকেল বিদ্যুৎ গিয়ই’ মানে বিদ্যুৎ আউট হয়ে গেছে। নামতা মুখস্তের মতো ক্রিকেটারদের পুরো নামও আমাদের মুখস্ত তখন। সেসময় মূল নামের বদলে বেশীর ভাগ সময় ডাক নামেই ডাকা হতো ক্রিকেটারদের। সে কত দিন আগের কথা!
শততম ওয়ানডে ম্যাচটির সময় কাঁথা মুড়ি দিয়ে খেলা দেখেছিলাম। চোখমুখে সে কী উত্তাপ! তার পুরোটাই জ্বরের প্রভাব ছিল নাকি আশরাফুলের সরাসরি থ্রোটারও কিছু প্রভাব ছিল, ঠিক বলতে পারব না। বহুদিন হয়ে গেল যে!
বাংলাদেশ যখন প্রথম টেস্ট খেলতে নামছে তখনও টেস্টের মাহাত্ন্য বোঝার বয়স হয়নি। তবুও চারপাশের আবহটা ঠিক বুঝিয়ে দিচ্ছিল, এ-এক বিশেষ কিছু। দিনের খেলা শেষের কিছু আগে সৌরভ যখন তুলে মারতে গিয়ে আউট হয়েছিলেন, তখন আব্বু আর মামার হাঁপছাড়া ভাবটা কিভাবে যেন স্পষ্ট মনে পড়ে! তারপর হাঁটি হাঁটি পা পা করে কবে যে টেস্ট ক্রিকেটের বাংলাদেশ একশ’টা টেস্ট খেলার দোরগোড়ায় এসে দাঁড়ালো, টেরই পেলাম না যেন!
মুলতানেই ফর্ম ফিরে হতে হলো মোটাসোটা নাদুস-নুদুস লোকটার। রশীদ লতিফের সংকীর্ণতা, মোঃ রফিকের উদারতায় দিনশেষে মিললো পরাজয় আর ভালো খেলার বাহবা। আমাদের চট্টগ্রামেই মোহাম্মদ আশরাফুল ইরফান-জহিরদের বেধড়ক পিটিয়ে, দিয়েছিলেন ‘অপরাজিত ১৫৮’ এর রোমাঞ্চ! রিভার্স সুইপ, ৭৬ থেকে ১০০ তে পৌছানো, ৮৮ থেকে তিন চার... সব কেমন এখনও জীবন্ত মনে হয়!
যেদিন 'আশার ফুল' হয়ে ফুটেছিলেন আশরাফুল।
কি এক ইনিংস ছিল আশরাফুলের, যেন ফুটেছিলেন ‘আশার ফুল’ হয়েই। অথচ সেই আশরাফুলই সেদিনই যখন দ্বিতীয় পালার ব্যাটিংয়ে ব্যর্থ হয়েছিলেন, হতাশায় মুষড়ে পড়েছিলাম। তা দেখে আম্মু বলেছিলেন, ‘ছেলেটা সারাদিন ব্যাটিং করল। এখন আবার করতে হলো। সে আর কি করবে, বল!’ আরে, তাই তো! একা কত আর করবে বেচারা!
নিজেকে প্রবোধ দেয়ার মন্ত্রটা বুঝি রপ্ত হয়ে গিয়েছিল সেদিনই।
ফতুল্লায় নাফিস-বাশার দেখিয়েছিলেন অসম্ভব এক স্বপ্ন। বৃহস্পতিবার ছোটো খালার বিয়ে থাকায় শেষদিনের খেলা দেখা আর হয়নি। ক্রিকইনফো-ফেসবুকে আপডেট পাওয়া তো তখন এক অলীক কল্পনা! ক্লাবে কাটছিল উৎকন্ঠার সময়। দুপুরের দিকে হঠাৎ এক মামা জানালেন, হেরে গেছে বাংলাদেশ। সম্ভবত মোবাইলে মেসেজ দিয়ে খবর নিয়েছিলেন তিনি। পন্টিংয়ের হাতে স্বপ্ন খুন হলো সেবার।
ক্লাসে থাকা অবস্থাতেই খবর হয়ে গেলো দক্ষিন আফ্রিকা থেকে লিড পেয়েছে বাংলাদেশ। কিন্তু বাগে পেয়েও দক্ষিন আফ্রিকাকে কিছু করা গেল না সেবার। নিউজিল্যান্ডের সাথে সাকিবও এনে দিলেন অবিশ্বাস্য এক লিড। ভেট্টোরীও হয়ে উঠলেন অতিমানব। স্বপ্ন খুন হলো আবারও। আমরা নিজেকেই প্রবোধ দিই, ওরা এখনও ছোটো। আর একটু পরিণত হলেই, ফলাফলগুলো বদলে যাবে। পক্ষে আসবে আমাদের।
ওয়েস্ট ইন্ডিজকে নাটকীয়ভাবে অলআউট করেও হেরে গেলো বাংলাদেশ। আমরা বলি, অনভিজ্ঞতা। ছয় বছর পর প্রত্যাবর্তন করা নড়েবড়ে জিম্বাবুয়ের কাছেও হারতে হলো। আমরা বলি, আসলে ফেভারিটের চাপ সামলাতে পারেনি। এখনও ছোটো তো!
মেহেদী মিরাজ! তিনি আসলেই এখনও ছোটো!
সময় গড়িয়ে যায়। কিন্তু বাংলাদেশ ক্রিকেটারদের যেন বয়স বাড়ে না। ওরা এখনও ছোটো, এখনও অনভিজ্ঞ। ভারতের সাথে এক সেশন বাকী থাকতে পরাজয় ঘটলো। মুশফিকুর রহীম উইকেট বিলিয়ে দিয়ে নিজ হাতে মাটি চাপা দিলেন ড্রয়ের শেষ আশাটুকুও। আমরা বলি, বেচারা আর কি করবে। অতক্ষণ কিপিং করল, ব্যাটিং করল, কত আর করবে! প্রবোধ দেয়ার মন্ত্রটা যেন আমরা ভালোই রপ্ত করে নিয়েছি।
এত কিছুর মাঝেও হঠাৎ এক ঝলক মুক্ত হাওয়ার মতো স্বপ্ন সত্যি হওয়ার মতো ব্যাপারও ঘটেছে বাংলাদেশ ক্রিকেটে। ক্রিকেটের প্রাচীন পরাশক্তি ইংল্যান্ডকে পরাভূত করা গেছে। ধবল ধোলাইয়ের স্বাদও জুটেছে। সমানে সমান ভাব দেখিয়ে ড্রও করা গেছে। কিন্তু সেসবের আলোচনা যে ওই প্রবোধ দেয়ার মতোই শোনায়। পরাজয়ের ভীড়ে জোর করে জয়গুলোকে আলাদা করতে যাওয়া কঠিন তো বটেই, বড্ড বিব্রতকরও!
শততম টেস্ট খেলতে নামার সময় বাংলাদেশ দলে নেই একজন চারহাজারী, নেই একজন দুইশ উইকেট শিকারীও। সর্বোচ্চ ম্যাচ খেলা ক্রিকেটারটির নাম মোঃ আশরাফুল, ৬১ ম্যাচ। মুশফিকুর রহীম খেলেছেন ৫৩ ম্যাচ, শততম ম্যাচে হবে ৫৪। শুরুর আমিনুল ইসলাম, মেহরাব হোসেন, নাইমুর রহমানরা কবেই হারিয়ে গেছেন! হাবিবুল-রফিকরাও নেই প্রায় বছর-আটেক হয়ে গেল। অথচ নিকট অতীতে টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়া শ্রীলংকা-জিম্বাবুয়ের এন্ডি ফ্লাওয়ার-রানাতুঙ্গারা ঠিকই ছিলেন বহুদিন। জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটে বর্ণবাদ হানা না দিলে, হয়তো এন্ডির ক্যারিয়ার আরো বর্নাঢ্য হতো। তাহলে কি জাভেদ-রাজিনদের জোর করে বসিয়ে দেয়াটাই ‘চিরকেলে ছোটো’ হওয়ার কারণ? কে জানে, হবে হয়তো!
উইজডেন সম্পাদক শিল্ড বেরী বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ টেস্ট স্ট্যাটাস পেয়েছে বড্ড অপরিপক্ক অবস্থায়।’ তা নয়তো কি? প্রথম শ্রেণীর কোনো অবকাঠামোই যে ছিল না, এ দেশের ক্রিকেটে। আবেগ দিয়ে এক-দুটো জয় পাওয়া যেতে পারে, এক-দুই ম্যাচে হয়তো ভালো করা যায়, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে কি সাফল্য পাওয়া সম্ভব?
বাংলাদেশ ক্রিকেটের অভিভাবকেরা হয়তো তা-ই চেয়েছেন। আবেগ পুঁজি করে, ক্রিকেট-উন্মাদনা কাজে লাগিয়ে, যখন টেস্ট-মর্যাদা পাওয়া গেছে তখন প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেট ঢেলে সাজানোর আর দরকার কি! বেশ তো চলছে, চলুক না। ঢিলে অবকাঠামো আর ক্রিকেট-নিয়ন্ত্রকদের উদাসীনতার ফল কতটা ভয়ংকর হতে পারে তার বাস্তব উদাহারণ হচ্ছে, বাংলাদেশের ৯৯ টেস্টের বিপরীতে ৭৬টি দুঃসহ পরাজয়!
আরো একবার উইকেট বিলিয়ে আসা। দায় বর্তায় অবকাঠামোতেও... ।
এমন অবকাঠামো থেকে যদি শচীন, লারা, ডি ভিলিয়ার্সের মতো ক্রিকেটারও বেরিয়ে আসেন, তাহলেও হয়তো ফলাফল পক্ষে আনা সম্ভব নয়। কারণ, এই অবকাঠামো যে আপনাকে কঠিন মনোসংযোগ আর অধ্যাবসায়ের শিক্ষা দেবে না। তাই দেখা যাবে তাঁরাও মাঠে গিয়ে ঠিকই উইকেট বিলিয়ে দিয়ে আসছেন।
সময়টা বড্ড দ্রুতগতির। এতটাই দ্রুত যে, কখন-সখনও তাল মেলানো কষ্ট। এই তড়িৎ যুগে দীর্ঘমেয়াদে সাফল্যের আশা কেউ করে না, চায়-ও না। সবাই ক্ষণিকের মিরাকলে বিশ্বাসী। আমাদের ক্রিকেট সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিরাও হয়তো তা-ই। প্রায় আঠারো হতে চলল। এখনও একটা ক্রিকেট অবকাঠামো দাঁড় করানো গেল না। আসলে হয়েছে কি, এখনও নবীন ক্রিকেট শক্তি তো! অভিভাবকদের আরেকটু সময় দিলেই হয়তো দাঁড়িয়ে যাবে... !
আমাদের আগের প্রজন্ম চাওয়ার চেয়েও বেশী পেয়ে গিয়েছিলেন। তাঁরা কখনও ভাবতে পারেননি, বাংলাদেশ কখনও টেস্ট মর্যাদা পাবে, টেস্ট খেলবে, বিশ্বকাপে যাবে। হয়তো সেই অতিরিক্ত পাওয়াটাই এখন আমাদের এই প্রজন্ম না পেয়ে শোধ করছে। কি জানি!
কেনিয়ার মতো একটা ক্রিকেট জাতি অনেকটা বিলুপ্তির পথে। কার দায় সে আলোচনা না-হয় থাক। হারিয়েছে তো। নড়বড়ে অবকাঠামো কখনো কখনো ভয় ধরিয়ে দেয়, বাংলাদেশও না হারিয়ে যায়! আফগানিস্তান-আয়ারল্যান্ডের মতো ক্রিকেট শক্তিগুলো উঠে আসছে। কত সুন্দর একটা লক্ষ্য ঠিক রেখে, পরিকল্পনা করে এগোচ্ছে ওরা। এদিকে আমরা যেন হাঁটছি পেছন পায়ে। ‘শিক্ষানবিশ’ পর্যায়টা যেন কাটিয়ে উঠা যাচ্ছে না কোনভাবেই।
জাতি হিসেবে আমরা প্রচন্ড আশাবাদী। কঠিন সংগ্রামী ও দৃঢ়চেতাও। আমরা আশা করি, একদিন আমাদের দেশটা উন্নয়নশীল দেশ থেকে উন্নত দেশ হবেই। যত বাঁধা আসুক, দেশটা ঠিকই এগিয়ে যাবে। কিভাবে যাবে, কে নিয়ে যাবে, তা হয়তো আমরা জানি না। কিন্তু স্বপ্ন দেখি, ঠিকই একদিন অন্ধকার চিরে আলোয় আলোয় দেশটা ভরে উঠবে।
একইভাবে আমরা বিশ্বাস করি, ক্রিকেটেও একদিন দাঁড়াতে শিখে যাবে বাংলাদেশ। শক্তিশালী অবকাঠামো পাবে, দায়িত্বশীল ক্রিকেট-অভিভাবক জুটবে, ক্রিকেটাররাও মানিয়ে নেবেন পরিস্থিতির চাহিদামতো। সেদিন হয়তো আমি থাকবো না, আমরা থাকবো না। হয়তো আমাদের পরের প্রজন্মের জন্য তোলা রইল সেই সুখের সময়। হয়তো বাংলাদেশ ক্রিকেটের শততম টেস্ট বছরে যখন বাংলাদেশ টেস্ট খেলতে নামবে, তখন রেকর্ড বই এতটা রুগ্ন ও করুণ দেখাবে না। হয়তো তখন কয়েক ডজন দশ-পনেরো হাজারী, আর তিন-চার হালি চার-পাঁচশো উইকেট শিকারী থাকবে বাংলাদেশ ক্রিকেটের। হয়তো... থাক আর না। স্বপ্নের পাখা আর আশার পারদটা এমন যে, সুযোগ পেলেই কেবল বাড়তে চায়।
টেস্ট ক্রিকেটের ১৪০ বছরের ইতিহাসে, শতবর্ষী টেস্ট খেলুড়ে দেশ আছে কেবল তিনটি। সবচেয়ে নবীন টেস্ট শক্তিটির শতবছরের টেস্ট মর্যাদা উপভোগ করতে পাড়ি দিতে হবে আরো অনেকটা পথ।
সেই পর্যন্ত আমরা কেবল কামনা করতে পারি, বাংলাদেশ ক্রিকেটের শতায়ু হোক। বাংলাদেশ ক্রিকেটের কল্যাণ হোক। ঠিক যেমন কামনা করি, শততম টেস্টটি উদযাপিত হোক নবম জয়ের মহোৎসব দিয়ে। অধিনায়কের পঞ্চাশতম টেস্টটিতে যেমন বিজয়-উচ্ছ্বাস হয়েছিল ঠিক তেমনি হোক এবারও... ।
- 0 মন্তব্য