• ক্রিকেট

ধর্মশালায় ফাইনাল টেস্টের বাতাবরণ

পোস্টটি ৫২০৬ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।
ক্রিকেট নাকি শুধুমাত্র খেলা নয়, মানুষকে মানবজীবনের অনুশীলনে অভ্যস্ত করার একটা পদ্ধতিও বটে! মানবজীবনের উত্থান-পতন, হাসি-কান্না, ভালো-মন্দ এসব কিছুর শিক্ষা, ক্রিকেটের মতো করে আর কোনো খেলা দিতে পারে না। জীবনের কঠিন সময়গুলোতে ধৈর্য্য ধারণ ও সময়কে পক্ষে আনার মন্ত্রও ক্রিকেটের মতো করে আর কেউ শেখায় না। ইমরান খান তো বলেছিলেনই, রাজনীতির অচেনা-রুক্ষ উঠোনে মানিয়ে নিতে তাকে সাহায্য করেছিল, ক্রিকেট মাঠের লব্ধ শিক্ষা।
 
মাসখানেক আগেই হরভজন, সৌরভরা কত কি বলেছিলেন। স্মরণকালের দূর্বলতম দলটি নিয়ে, সময়ের সবচেয়ে প্রতাপ দেখানো ভারতের সাথে লড়তে ভারতে পা রেখেছিল অস্ট্রেলিয়া। মাঠে নামার আগেই যেন উড়িয়ে দিচ্ছিলেন স্মিথের তরুণ দলটিকে। অজি-অহংয়ে হয়তো ভালোই ঘা দিয়েছিল সেসব। মাঠের লড়াইয়ে তাই অস্ট্রেলিয়া দেখিয়ে দিয়েছে, খেলা শুরুর আগে, ফলাফল বলতে নেই। তাতে হিতে বিপরীত হতে পারে।
তিন টেস্ট শেষে এখন একই সমতলে দুটি দল। সিরিজ নির্ধারণী টেস্টেই ফয়সালা হবে, বোর্ডার গাভাস্কার ট্রফি ভারতে আসবে, নাকি থাকবে সেই অস্ট্রেলিয়াতেই। শেষ টেস্টের আগে মানসিকভাবেও সুবিধাজনক অবস্থায় স্মিথের তরুণ দল। শেষ ম্যাচ ড্র করলেও ট্রফি তাদেরই থাকছে।
সিরিজ জুড়ে অশ্বিনের পুরোপুরি ‘অশ্বিন’ হয়ে উঠতে না পারা, হয়তো ভোগাচ্ছে ভারতকে। বিরাট কোহলি তিন টেস্টেই হয়েছেন চূড়ান্ত ব্যর্থ।
 
শেষ কবে বোর্ডার-গাভাস্কার সিরিজে এমন ফাইনালের অবতারণা হয়েছিল? প্রায় বারো-তেরো বছর আগে, অস্ট্রেলিয়ায়। সিডনিতে স্টীভ ওয়াহর বিদায়ী টেস্টে, অস্ট্রেলিয়া খুব করে চেয়েছিল, দলনায়ককে জয় দিয়ে বিদায়-সংবর্ধণা জানাতে। কিন্তু পারেননি গিলি-পন্টিংরা। হয়তো হেরেই জেতেন, যদি ইস্পাত মানব শেষ টেস্টেও অমন ইস্পাত নার্ভের পরিচয় না দিতেন!
সেবার ব্রিসবেনে প্রথম টেস্ট ড্র হওয়ার পর এডিলেইডে গিয়ে সবাইকে চমকে দিয়ে সৌরভের ‘টিম ইন্ডিয়া’ সিরিজে লিড নিয়ে ফেলল! পন্টিংয়ের ‘ডাবল’ বড্ড ফ্যাকাসে হয়ে গেল, দ্রাবিড়ের ডাবলের কাছে। লক্ষণ আরো একবার খেললেন ‘ভেরী ভেরী স্পেশাল’ এক ইনিংস। ৮৫ রানে চার উইকেট হারিয়ে ধুঁকতে থাকা দলটা পঞ্চম উইকেটে উপহার দিল ৩০৩ রানের অবিশ্বাস্য পার্টনারশিপ।
অবশ্য মেলবোর্নে পরের টেস্টেই অস্ট্রেলিয়া অজি-অহং পুনরুদ্ধার করেছিল। পন্টিংয়ের পরের ‘দ্বিশতক’ আর ফ্যাকাসে হলো না। বরং তা ভারতকে ধুমড়ে-মুচড়ে দেয়ার আনন্দের রঙে রঙিন।
সিরিজ ১-১ ড্র হওয়া সত্ত্বেও, আগের সিরিজের জয়ী দল হওয়ায় ভারতই রেখে দিয়েছিল সেবারের বোর্ডার-গাভাস্কার ট্রফি।
 
তারও আগে, শতাব্দীর সূচনাকালে স্টীভের ‘ফাইনাল ফ্রন্টিয়ার’ কেমন গুবলেট পাকিয়ে গিয়েছিল, সে নিশ্চয় মনে আছে? মুম্বাই টেস্ট হেরে পিছিয়ে পড়া ভারত কলকাতায় গিয়ে জন্ম দিল অবিশ্বাস্য এক রুপকথা। প্রত্যাবর্তনের সব ইতিহাসকে ম্লান করে দিয়ে, নতুন এক ইতিহাস লিখলেন লক্ষণ-দ্রাবিড়রা। আর সিরিজ সমাপনী কিংবা সিরিজ নির্ধারণী চেন্নাই টেস্টে, দুই উইকেটের রোমাঞ্চকর জয়ে, বিশ্বজুড়ে অস্ট্রেলিয়ার একচ্ছত্র আধিপত্যে, ভারত যেন সীমারেখা টেনে দিয়েছিল!
 
ভারতের বিপক্ষে সিরিজ জেতা হয়নি স্টীভ ওয়াহর, পন্টিং-ক্লার্করা আবার জিততে পারেননি ভারতের মাটিতে। যদিও এ্যাডাম গিলক্রিস্ট জিতেছিলেন, দুই টেস্টে। প্রায় একযুগ আগে, ভারতের মাটি থেকে সর্বশেষ যেবার অস্ট্রেলিয়া সিরিজ জিতে ফিরেছিল।
 
ক্রিকেট এ এক অদ্ভুত খেলা। কখনো তুলে দেয়, সাফল্যের সপ্তশিখরে। আবার কখনো বড় নিষ্ঠুরভাবে নামিয়ে দেয়, পতনের অতল গহ্বরে। এই যে বিরাট কোহলি, ক্রিকেট ইতিহাসে একমাত্র অধিনায়ক-ব্যাটসম্যান হয়ে যিনি কি না, করেছিলেন টানা চার সিরিজে চারটি ‘ডাবল’ হাঁকানোর রেকর্ড, সেই তিনিই কি না, তিন টেস্টের পাঁচ ইনিংস মিলিয়ে পঞ্চাশই পেরোতে পারলেন না! কি অদ্ভুত, তাই না?
হরভজন-সৌরভরা কি দুঃস্বপ্নেও ভেবেছিলেন, তাদের ভবিষ্যদ্বানী এমন বুমেরাং হয়ে দেখা দেবে! কে ভেবেছিল, হ্যান্ডসকম্ব-রেনশো-ম্যাক্সওয়েল-ও’কিফিরা এমন আলো ছড়াবেন? রাঁচিতে দুই সেশন বাকী থাকতেই টপ অর্ডার হারিয়ে ফেলা অস্ট্রেলিয়া যে ম্যাচ বাঁচিয়ে ফেলবে, তা কি কেউ কল্পনা করেছিল? হ্যান্ডসকম্ব-মার্শ যে ওভাবে ভারতের মুখের গ্রাস(পড়ুন, জয়) কেড়ে নেবেন তা-ই বা কে জানত?
 
স্মিথের রান-ফোয়ারা ছুটছে ভারতেও। পূজারাও ঠিক সময়ে ভারতের রক্ষাকর্তা হয়ে দেখা দিচ্ছেন। রাহানে-বিজয়রা ঠিকই পার্শ্বনায়ক হয়ে উঠছেন, সময়ের প্রয়োজনে। বিরাট কোহলিও হয়তো ফিরবেন অচিরেই। ও’কিফি পরিশ্রমের সুফল পাচ্ছেন, ম্যাক্সওয়েল নিজের অন্যরুপ চেনাতে ব্যস্ত, তারুণ্যদ্বীপ্ত হ্যান্ডসকম্ব-রেনশোও বুঝিয়ে দিচ্ছেন ‘ব্যাগি গ্রীণ’ মাথায় তোলার মতো যথেষ্ট যোগ্যতা তাদের আছে। ভারতের জন্য শেষ টেস্টে জয়ের বিকল্প নেই। আর অশ্বিন জানেন, ভারতের জয়ের জন্য তাঁর ‘অশ্বিন’ হয়ে উঠার বিকল্প নেই।
 
ভারতের দীর্ঘতম এক আন্তর্জাতিক ক্রিকেট মৌসুম প্রায় শেষের পথে। সেই কবে সেপ্টেম্বরে শুরু হয়েছিল। এই সময়ে সোনায় মোড়ানো একটা সময় পার করেছে বিরাট কোহলির ভারত। বোলাররা পেয়েছেন উইকেট, ব্যাটসম্যানরা করেছেন রান। মাঠের ক্রিকেটে অতিথি আপ্যায়নে কোনরুপ আতিথ্যের ধার ধারেনি তাঁরা। কিন্তু অস্ট্রেলিয়াও যে উষ্ণ আতিথ্য গ্রহন না করে যাওয়ার পাত্র নয়। তাই ভালোই জমে গেছে ভারত-অস্ট্রেলিয়ার এই সিরিজ।
 
অনিশ্চয়তার রোমাঞ্চের সাথে ক্রিকেটের নিত্য বসবাস। তাই কোনো দল এখানে প্রায় ছয়শো রান করেও পরাজিত হয়। কেউ দ্বিশতক করার পরও বিহ্বল নেত্রে দেখেন প্রতিপক্ষের বিজয়োল্লাস। কখনো কখনো কারও ব্যাট-বলের দুর্দান্ত লড়াইও বড় ম্রিয়মান দেখায় এখানে! পাঁচ দিনের পনেরো সেশনের টেস্ট ক্রিকেট যেন, জীবনের উত্থান-পতনের গল্পগুলির সমাহার। এই এগিয়ে গেলে তো, এই পিছিয়ে গেলে। একবার একটু ঢিল দিয়েছে তো, জীবন তোমাকে দেখিয়ে দেবে পতনের তলানি। আর কঠিন মনোযোগী ও অধ্যাবসায়ী যদি হও, তবে দিনান্তের গোধূলী বেলার সূর্য ঔজ্জ্বল্য ছড়াবে তোমার সাফল্যে উচ্ছ্বসিত হয়েই।
 
ধর্মশালার সূর্য কার সাফল্যে উদ্ভাসিত হবে, আর কার বিজয়ে উচ্ছ্বসিত হবে সে না-হয় সময়ের হাতে তোলা থাক। তার চেয়ে চলুন আমরা বরং ‘হারার আগে হার না মানা’ অস্ট্রেলিয়া আর ‘তিল পরিমাণ ছাড় না দেয়া’ মানসিকতার ভারতের জমজমাট লড়াই উপভোগ করি।
বহুদিন পর যে ক্রিকেটে এমন ফাইনাল টেস্টের বাতাবরণ ছড়িয়ে পড়েছে। এই টেস্ট উপভোগ না করে উপায় কি!