নন্দন কাননের ক্রিকেটানন্দ
পোস্টটি ৬২৫৪ বার পঠিত হয়েছে৩রা এপ্রিল, ২০১৬।
এক.
কলকাতার ইডেন গার্ডেন চেনেন তো? না, কোনদিক হয়ে কিভাবে যেতে হবে, সেই চেনার কথা বলছি না। ওই নামের সাথে পরিচিত তো? বহুবার এই ইডেন গার্ডেনের কথা শুনেছেন নিশ্চয়? ঐ যে অস্ট্রেলিয়া-ভারত সেই যুগানন্দ সঞ্চারী টেস্ট হয়েছিল? লক্ষণ-দ্রাবিড় অবিশ্বাস্য এক রুপকথার জন্ম দিয়েছিল? ঐ যে ১৯৮৭তে এশিয়া মহাদেশে ‘নন-এশিয়ান’ অস্ট্রেলিয়া-ইংল্যান্ড ফাইনাল হয়েছিল? সেই যে ১৯৯৬ বিশ্বকাপে সেমিফাইনালে শ্রীলংকার সাথে ১২০/৮ হয়ে যাওয়ায় ভারতীয় দলের প্রতি বোতল-বৃষ্টি হয়েছিল?
হ্যাঁ, সেই ইডেন গার্ডেনের কথা-ই হচ্ছে। বাংলায় যাকে বলে নন্দন কানন। সেই নন্দন কাননের আজ মহা সমারোহে সাজসজ্জার দিন। সেই যে কবিতায় বলে, ‘কাননে কুসুমকলি সকলি ফুটিল’। আজ এই নন্দন কাননের সকল ফুল ফোটার দিন। কেন? বাঃ রে, আজ যে এখানে ক্রিকেটের সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত ও নবীন সংস্করণের ষষ্ঠ আসরের যবনিকাপাত ঘটবে! আজ যে এই নন্দন কাননে, ইংল্যান্ড-ওয়েস্ট ইন্ডিজ ফাইনাল খেলবে। আনন্দবাজারের ভাষায় বললে, আজ এই নন্দনে রবিবাসরীয় ফাইনাল হবে যে!
দুই.
কত ইতিহাস, কত স্মৃতি, কত গল্প, কত রুপকথা এই মাঠ ঘিরে। প্রায় ২৯ বছর পর আবার এখানে বসেছে ফাইনালের মতো এক মহাযজ্ঞ। কতভাবেই না আজ তাকে সাজতে হবে, সবাইকে তাজ্জব করে দিতে হবে না! এই মাঠে দস্যিপনা করে বেড়ে উঠা, কলকাতার রাজপুত্তুর, প্রত্যাবর্তনের রাজা এখন এই মাঠের অভিভাবকত্ব গ্রহন করেছেন। শুধু এই মাঠের নয়, পুরো রাজ্যের ক্রিকেটেরই তিনি অভিভাবক। তিনি বিস্তর খাটাখাটনি করছেন, নন্দন কাননকে নান্দনিক করে গড়ে তুলতে তার সে কী প্রচেষ্টা! তিনি শিশু-বুড়ো সবার দাদা, অনেকে ডাকে মহারাজা, তাই তাঁর কাজের ধারাও তেমন হতে হবে না!
কিন্তু চেষ্টা করলেই কি আর সব হয়? যাদের জন্য এত আয়োজন, এত সাজসজ্জা, এখানকার সেই মানুষগুলোই তো কেমন ঝিম মেরে গেছে। অবশ্য তাদের আর কি দোষ? দু-দুটো শোকের ঝড় তাঁরা সামলাবেই বা কিভাবে? ফ্লাইওভার ধ্বসে নগর-কলকাতা অনেকটাই যেন বিহ্বল, বিধ্বস্ত। সাথে যোগ হয়েছে ৩১শে জানুয়ারীর রাতে ওয়েংখেড়ে-বিভীষিকা। যেখানে স্যামি-ব্রাভোদের ‘চাম্পিয়ন নৃত্যে’ ভেসে গেছে ভারতের টানা দ্বিতীয়বার ফাইনাল খেলার সুখস্বপ্ন। তাই ফ্লাইওভার ধ্বসের শোকে যেটা প্রলেপ হতে পারত, সেটাই এখন মড়ার উপর খাড়ার ঘা’র অবস্থা সৃষ্টি করেছে।
তিন.
কালো-ধলো, সাদা-কালো, কৃষ্ণাঙ্গ-শ্বেতাঙ্গ, শোষক-শোষিত, ঔপনিবেশিক-উপনিবেশ... ইত্যাকার কত কিছু জড়িয়ে এই ইংল্যান্ড আর ওয়েস্ট ইন্ডিজের সাথে। টেমস নদীর চোখ ধাঁধানো তিলোত্তমার পেছনে কত কালো মানুষের শ্রম, দ্বীর্ঘশ্বাস, কান্না, রক্ত লুকিয়ে আছে, তা ব্রাভোরা হয়তো জানেন। কিংবা জানেন না। রুটদের পূর্বসূরীরা একসময় কিভাবে দিনের পর দিন পশুর মতো কৃষ্ণাঙ্গদের চাবকে গেছেন, সে ইতিহাস হয়তো হেলসরা পড়েননি। অথবা পড়েছেন। কিন্তু আশ্চর্য্যের ব্যাপার হলো, একসময়ের প্রবল শোষণবাজ অধিপতি ইংরেজদের ইংলিশ ক্রিকেট দলে এখন এগারো জন বিশুদ্ধ ইংলিশ খুঁজে পাওয়া ভার। বহু বর্ণের, বহু জাতের মিলনে বুঝি ইতিহাসের ঋণ শোধে লিপ্ত হয়েছে তাঁরা। সেজন্যেই কি ‘জর্ডান’ নামের এক কৃষ্ণাঙ্গ আজ ইংলিশ ক্রিকেট দলের অবিচ্ছেদ্য অংশ? ‘মরগান’ নামের একজন আইরিশ তাদের দলনায়ক?
কোথায় গেল ইংলিশদের সেই জাত্যাভিমান? গাত্র বর্ণের সেই দম্ভ? নাক উঁচু আভিজাত্যের সেই অহংকার?
ব্রাভো ‘চাম্পিয়ন চাম্পিয়ন’ গানে ওবামা-ম্যান্ডেলা-সেরেনা কে চাম্পিয়ন বলে নিশ্চিত করেছেন, তিনি ইতিহাসের খুব একটা অমনোযোগী ছাত্র নন। আবার অন্যদিকে ইংলিশদের রক্তেই নিশ্চয় শাসনচেতা মনোভাব মিশে আছে। তাহলে আজকের সন্ধ্যা-রাত নিশ্চয় ক্রিকেটীয় আনন্দের মহা আয়োজনে, ফুলে-ফেঁপে ঢোল হয়ে উঠবে। নাকি?
চার.
হাসিমুখ করে টস করতে নামলেও ভেতরে ভেতরে পর্বত প্রমাণ চাপ অনুভব করছেন ড্যারেন স্যামি। কিছুক্ষণ আগেই ল্যানিংয়ের অস্ট্রেলিয়াকে উড়িয়ে দিয়েছে, টেইলরের উইন্ডিজ নারী ক্রিকেট দল। তাহলে উইন্ডিজ পুরুষদের কি হার মানা মানাবে? টেইলরদের সুন্দর রাতটা আরো সুন্দর করার পরিবর্তে বিস্বাদ মুখর করে দেয়া কি ঠিক হবে? ইংলিশ দলপতি ‘আইরিশ’ ইয়ন মরগানেরও মুখও হাসি হাসি। দুই দলনায়কের মুখেই হাসি, তবু স্পষ্ট বোঝা যায়, এ হাসি তৃপ্তির হাসি নয়, বরং সৌজন্যের হাসি।
সত্যিকারের প্রথম হাসিটা হাসলেন, ড্যারেন স্যামি। টসভাগ্যে জিতলেন, বোলিংয়ের সিদ্ধান্ত নিলেন। ক্রিকেটের রুপ-রসে বিভোর হতে তখন কানায় কানায় পূর্ণ নন্দন কানন। দর্শকের হর্ষধ্বনি তে উন্মাতাল, ইডেনের গ্যালারী। শহর-কলকাতারও কি একই অবস্থা? ক্রিকেটের অমৃত-রস কি তবে ভুলিয়ে দিয়েছে শোক-তাপের মহামারী ঝড়? ক্রিকেট নামক অমীয়-সুধায় মাতাল হতে, বাকী বিশ্বের মতো নগর-কলকাতাও কি তবে তৈরী? ক্রিকেটীয় রুপ-রসে সিক্ত হতে কি তবে শোক-তাপকে একপাশে সরিয়ে রেখেছে এই জনপদের জনমানুষেরা?
পাঁচ.
ইংলিশদের হয়ে ওপেন করছেন জ্যাসন রয় ও অ্যালেক্স হেলস। যাদের একটাই থিওরী ‘নামো এবং মারো’। দক্ষিন আফ্রিকাকে কি মারটাই না দিল! ২৩০ চেজ করে বসেছিল অনায়াসে, অবলীলায়। স্যামি বল তুলে দিলেন ‘লেগি’ স্যামুয়েল বদ্রীর হাতে। গ্যালারীর কান ফাটানো আওয়াজকে সঙ্গী করে, প্রথম বলটি করলেন বদ্রী। খেললেন রয়। কি হলো এটা? দ্বিতীয় বলেই স্পিনে নাকাল হলেন জ্যাসন রয়। বোল্ড। মরগানকেও ফেরালেন বদ্রী। মাঝে হেলস গেলেন রাসেলের বলে।
প্রথমেই গেলেন জ্যাসন রয়। বোল্ড!
তবে কি ফাইনালটা একদম ম্যাড়ম্যাড়ে হবে? ভীষণ একতরফা? রুট-বাটলার যেন জানান দিতে চাইলেন, ‘হুঁহ, আমরা আছি কি করতে!’ ইংলিশ-ক্রিকেটের ‘আগামীর গ্রেট জো রুট’ এক পাশ থেকে দিয়ে গেলেন নির্ভরতা, খেলতে থাকলেন তাঁর মতোই। অন্যপাশে বাটলারও খেলছেন চমৎকার। এই দুজনের ব্যাটে ইংল্যান্ড প্রাথমিক দূরাবস্থা তো কাটিয়ে উঠলই, ভালো একটা লক্ষ্যের দিকেও ছুটতে লাগল।
ছোটা আর হলো কই? হঠাৎ কি হয়ে গেল, বাটলার গেলেন। স্টোকসও থাকলেন না বেশীক্ষণ। রুটও ৫৪তে থেমে দলকে ‘নেলসন স্কোর ১১১’ তে রেখে ফিরলেন, সপ্তম উইকেটের পতন নিশ্চিত করে। মোটে চলছে ১৫ ওভার, তবে কি পুরো ওভারও খেলতে পারবে না ইংল্যান্ড? কালো মানুষদের একতরফা বিজয়োৎসবের মঞ্চ হবে এই নন্দন? উইলি ও জর্ডান লড়ে গেলেন, শাসন করলেন, ইংলিশরা পেরিয়ে গেল দেড়শ, খেললো পুরো ওভার।
নয় উইকেটে কুড়ি ওভারে ১৫৫ রানের লড়াকু স্কোর করে খেলার মধ্যহ্ন বিরতিতে গেল ইংল্যান্ড। ওয়েস্ট ইন্ডিজের সামনে লক্ষ্য, ১৫৬।
ছয়.
মাত্র ১৫৬? গেইলে একার জন্য হবে? সিমন্স-ব্রাভো কি নামার সুযোগ পাবে? রাসেল কি ব্যাট করার সুযোগ পাবে? স্যামি কি তবে আঙ্গুলই চুষবে? স্যামুয়েলসের তো বুঝি দরকারই পড়বে না! এই টার্গেট চেজ করতে কয় ওভার লাগতে পারে? ১৫ নাকি ১৭? নাকি তারও আগেই শেষ হয়ে যাবে?
সব যদি আগে থেকে ভেবে রাখা এমন চিত্রনাট্য মতোই হবে, তবে আর খেলাটার নাম ক্রিকেট কেন? কেন খেলাটাকে বলা হবে গৌরবময় অনিশ্চয়তার খেলা?
তাই ক্যারিবীয়ান ইনিংস শুরুতেই ধারণ করল ধ্বংসস্তুপের আকার। দ্বিতীয় ওভারে মরগানের ক্ষুরধার মস্তিষ্ক থেকে বেরিয়ে আসল, এক অভিনব চমক। সেই চমকেই ফেঁসে গেল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। জো রুট, একজন অকেশনাল অফ স্পিনার। মরগান করলেন কি, তাকেই লেলিয়ে দিলেন চার্লস ও গেইলের মতো দুই মানবাকারের দানবের সামনে! আর রুট তাতেই করলেন বাজিমাত, দেখালেন ভেল্কী। ‘কট স্টোকস বল রুট’ যুগলবন্দীতে প্রথমে গেলেন চার্লস। একটি চার মেরে দ্বিতীয় বলে গেইলও অনুসরণ করলেন একই পথ। পরের ওভারে নেই সিমন্সও। ১১ রানে তিন উইকেট হারিয়ে স্যামির দলের তখন ‘কি করি আজ ভেবে না পাই’ দশা। একপাশে স্যামুয়েলস, অন্যপাশে এলেন ডোয়াইন ব্রাভো। বড় মঞ্চের খেলোয়াড় মারলন স্যামুয়েলস, যেন বড় মঞ্চের অপেক্ষাতেই ছিলেন। সুযোগ পেয়ে দেখাতে লাগলেন তাঁর বড়ত্ব, ব্যাটসম্যানশিপের নিদারুণ মহিমা। অন্যপ্রান্তের ব্রাভো এখানে ‘কবি নীরব’ ধরণের ভূমিকায় অবতীর্ণ। স্যামুয়েলসকে সাহচর্য্য দিয়ে গেলেন শুধু। হাতে রাখলেন উইকেট। ২৭ বলে ২৫ করে অনেকটা অ-ব্রাভো সুলভ একটা ইনিংস খেলে যখন ফিরছেন, তখন তাঁর দল কাটিয়ে উঠেছে প্রাথমিক বিপর্যয়। এতক্ষণ টুকটুক করে যেন তৈরী করেছেন রাসেল-স্যামিদের চালিয়ে খেলার অপার স্বাধীনতার ভিত্তিপ্রস্তর।
ঠিক ১৪ ওভার শেষে ফিরলেন ব্রাভো। ছয় ওভারে তখন দরকার ৭০ রান, হাতে আছে ছয় উইকেট।
সম্ভব? পারবে ওয়েস্ট ইন্ডিজ? নাকি কলিংউডের পর মরগান হয়ে যাবেন ইংলিশদের আরেকটি বিশ্বকাপ শিরোপা জেতানো দ্বিতীয় অধিনায়ক?
সাত.
রাসেল এলেন, গেলেন। স্যামিও এলেন, গেলেন। আজ তাহলে সাদা মানুষদেরই জয়োৎসব হবে? উইলি-রুটরা পূর্ব পুরুষদের মতো ক্রিকেটের মাঠেও শাসনে রাখবেন কালো মানুষদের? তাঁরাই হাসবেন শেষ হাসি? টেইলররা তবে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়েও উপভোগ করতে পারবেন না আজকের রাত? ওই যে এক কোণায় তাঁরা ক্লান্তিহীন সমর্থন দিয়ে যাচ্ছেন পুরুষ-ক্রিকেটারদের, সেসব কি তবে বৃথাই গেল?
স্যামুয়েলস যেন জানিয়ে দিলেন, বৃথা যাবে কেন? আমি মারলন তাহলে আছি কি করতে? তিনি লড়াইটা টেনে নিয়ে গেলেন শেষ ওভার পর্যন্ত। ছয় বলে দরকার ১৯। সমস্যা একটাই স্যামুয়েলস এখন ও-প্রান্তে। ছয় বলে ১০ রানে অপরাজিত কার্লোস ব্রাথওয়াইট আছেন স্ট্রাইকে। তাঁর প্রথম এবং প্রধান করণীয় কি তা নিশ্চয় এখন কাউকে শিখিয়ে দিতে হবে না? তিনি একটি ‘সিঙ্গেল’ নিয়ে দুরন্ত টাচে থাকা স্যামুয়েলসকে অবশ্যই স্ট্রাইক দেবেন। হুঁহ, বললেই কি হলো?
ওরা যে ক্যারিবীয়ান। ওদের চিন্তাধারা সব অন্যরকম, অন্য ধাঁচের। ফ্রন্ট লাইনের সব বোলারের ওভার শেষ। মরগান শেষ ওভার দিলেন ইংলিশদের ‘প্রিয় ফ্রেডি’র জায়গা নেয়ার অপেক্ষায় থাকা বেন স্টোকসকে।
সলা-পরামর্শ করে, প্রথম বল করে প্রথম ধাক্কাটা খেলেন বেন, লেগ সাইড দিয়ে ছয়। পরের বলে আবার, এবার লং অন দিয়ে। ধুম করে লক্ষ্যটা চলে এলো হাত ছোঁয়া দূরত্বে, চার বলে সাতে। মরগান কি সব যেন শিখিয়ে দিলেন তাকে। তৃতীয় বলটি করার পর বোঝা গেল, মরগান যা শিখিয়েছিলেন সবই বৃথা। লং অফ দিয়ে আবার ছয়। বেন স্টোকস প্রায় কেঁদে দেয়ার মতো হয়ে গেছেন। কি হলো এটা? নিজেকে ক্ষমা করার সুযোগ কি হবে আর? মুহূর্তেই যেন মনে হলো, পুরো দুনিয়াটা নিমিষেই ধ্বংস হয়ে গেছে। তিন বলে দরকার এক। বল যেন করতে হবে বলেই করা। চতুর্থ বলটি করলেন, এবং এটিও অনুসরণ করলো আগের তিনটিরই কক্ষপথ। ছয়।
ধারাভাষ্য কক্ষ থেকে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে চিৎকার করে উঠলেন ইয়ান বিশপ, ‘কার্লোস ব্রাথওয়াইট, রিমেম্বার দ্য নেইম!’
কার্লোস ব্রাথওয়াইট! রিমেম্বার দ্য নেইম!
হতাশায় মুখ ঢেকে ফেললেন স্টোকস, কাঁদছেন। হেঁটে এলেন জর্ডান, পিঠে রাখলেন হাত। যেন বলতে চাইলেন, ‘বন্ধু, দিনটি আজ তোমার ছিল না, এই যা! তুমি তোমার সর্বোচ্চটাই করেছো।’ এলেন রুট, স্টোকসের পিঠে মুখ ঠেকিয়ে কাঁদলেন তিনিও। একে একে সতীর্থরা সবাই এলেন, সমবেদনা জানালেন। যেন স্টোকসকে বলতে চাইলেন, ‘কেঁদো না বন্ধু! কাঁদার মতো হয়নি কিছুই। বীরের মতো লড়াই করে হেরেছো। আমরা লড়েছি সামর্থ্যের সবটা দিয়ে। কে বলে আমরা হেরেছি? আমরাও তো ওদের মতো সমান উইনার।’
কাঁদছেন স্টোকস, কাঁদছেন রুট! এ ছাড়া আর কিই-বা করার আছে!
আট.
সে কী মুহূর্ত! মাঠের একটা পাশ যদি হয় বেদনা-বিস্বাদের নীল কাব্য, তো অন্য পাশটা যেন আনন্দ-উচ্ছলতার মহাকাব্য। ক্যারিবীয়ানদের সে কী আনন্দ! আনন্দের নেই কোন বাঁধা ধরা নিয়ম, যে যেমন পারছে লম্ফ-ঝম্ফ করছে, দাপাচ্ছে-দৌড়োচ্ছে, হাসছে-কাঁদছে, ইচ্ছেমতো বাঁধনহারা উচ্ছ্বাসে উল্লাস করছে তাঁরা। দেখে স্পষ্ট বোঝা যায়, কলম্বোর প্রেমাদাসার সেই ক্যারিবীয়ান ‘গ্যাংনাম-উৎসব’ই একটু রঙ বদলে কলকাতার নন্দন কাননে ফিরে এসেছে ‘চাম্পিয়ন-উৎসব’ হয়ে।
আনন্দ প্রকাশেই নেই কোন ব্যকরণ। উদ্দাম আনন্দে উচ্ছ্বসিত স্যামির দল।
কে বলে শ্বেতাঙ্গদের নেই কোন মানবীয় আবেগ? তাঁরা যন্ত্র-মানব? সব মিথ্যে, সব ভুল। ইংলিশ-শিবিরটির দিকে তাকালেই আনমনেই মনটা কাতর হতে বাধ্য। কেঁউ কাঁদছে, কারও মুখশ্রী রক্ত জমে টকটক লাল হয়ে গেছে, কারও চোখে চিকচিক করছে বিন্দু বিন্দু জল। সে এক দুঃসহ মুহূর্ত! পরাজয়ের নীল কষ্ট যে বড় বেদনার, বড় ব্যথার, বড় যন্ত্রণার।
সে এক দুঃসহ মুহূর্ত! কোন কথা নেই মুখে, শুধু বিহ্বল চেয়ে থাকা!
আনন্দ-বিস্বাদ মিলেমিশে যেন একাকার হয়ে গেছে কলকাতার নন্দন কাননে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের ‘চাম্পিয়ন-নৃত্যে’ যারাও বা এতক্ষণ উচ্ছসিত ছিলেন, তাঁরাও কিছুটা ভারাক্রান্ত হয়ে পড়েছেন ড্যারেন স্যামির ম্যাচ-সমাপনী বক্তব্যে। নির্মম-বাস্তবতা, নিষ্ঠুর সত্যিটা যে অকপটে তুলে ধরেছেন, ‘দ্য স্মাইল ম্যান’ ড্যারেন স্যামি। ওরেল-লয়েডের উত্তরসূরী বলেই হয়তো, ক্যারিবীয়ান-ক্রিকেটের ভগ্ন-রুগ্ন হতশ্রী দশায় তাঁর ব্যাথাটাই সবচেয়ে বেশী। তাই ওয়েস্ট ইন্ডিজের ‘চাম্পিয়ন-উচ্ছ্বাস’ সত্ত্বেও সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, ক্যারিবীয়ান ক্রিকেটের সোনালী সময় ফিরতে আর কত দেরী, পাঞ্জেরী?
নয়.
আনন্দ-বেদনার মহাকাব্য রচিত হতে হতে একটা সময় পৌছে যায় অন্তিমতা দ্বারে। নন্দন কাননের ক্রিকেটীয়-মহাকাব্যেও চলতে চলতে পেয়ে যায় শেষের পথ, টানে দাঁড়ি। তবে দাঁড়ি টানার আগেই শাশ্বত সত্যের মতোই দিয়ে যায়, না-ভোলার মতো কিছু মুহূর্ত, কিছু স্মৃতি, কিছু ক্ষণ। যে ক্ষণগুলো জয়-পরাজয় কিংবা আনন্দ-বেদনার উর্ধ্বে উঠে শোনায়, চিরন্তন ক্রিকেটীয় অনিশ্চিত সৌন্দর্য্যের মোহনীয় সুর। ক্যারিবীয়ান ক্রিকেটের মহানন্দ কিংবা ইংলিশ ক্রিকেটের মহা বিস্বাদের চেয়েও তাই বড় হয়ে উঠে, ক্রিকেটীয় আনন্দ, ক্রিকেটীয় মূর্ছনা, ক্রিকেটীয় মহোৎসব। সেজন্যেই বোধকরি, ক্রিকেটানন্দটা চিত্তে সদানন্দায়ী হিসেবে থেকে যায়।
বয়স বাড়বে, এক সময় নবীনরা প্রবীণ হবে। কিন্তু নন্দন কাননের এই ক্রিকেটানন্দটা হয়তো থেকে যাবে চির সবুজ, চির নবীন, চির অম্লান, চিরন্তন আনন্দ-সঞ্চারী টুকরো স্মৃতি হয়ে।
জয়তু ক্রিকেট, জয়তু ক্রিকেটানন্দ।
জয়তু ক্রিকেট, জয়তু নন্দন কাননের ক্রিকেটানন্দ!
- 0 মন্তব্য