• ক্রিকেট

বিদায় পুনর্জন্মের নেতা...

পোস্টটি ৮০৪৯ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

১৯৫২ সালে আব্দুল কারদারের নেতৃত্বে টেস্ট অভিষেক পাকিস্তানের। এরপর নেতৃত্বে বদল এসেছে ৬৫ বার, প্রতি অধিনায়কের গড় স্থায়িত্ব এক বছর। এমন চেয়ারেই রয়ে গেলেন সাত বছর, একমাত্র অধিনায়ক হিসাবে দেশকে নেতৃত্ব দিলেন অর্ধশতাধিক টেস্টে। ৫৩ টেস্টের ২৪টি জিতে পরিসংখ্যানে দেশের সর্বকালের সেরা অধিনায়ক। তার নেতৃত্বে প্রথমবারের মতো নাম্বার ওয়ান টেস্ট টিমও হয়েছে পাকিস্তান।

 

শুরুটা হয়েছিল সম্ভবত পাকিস্তান ক্রিকেটের সবচেয়ে টালমাটাল সময়ে। ২০০৭ এ ইনজামামের বিদায়ের পর তিন বছরে ৫ অধিনায়ক, দল বিপর্যস্ত অন্তঃকলহ, রাজনীতি, ক্ষমতার দ্বন্দ্ব, গ্যাংস্টার আর বুকিদের দাপটে। ২০০৯ সালে লাহোরে সন্ত্রাসী হামলায় দেশের মাটিতে ক্রিকেট নির্বাসিত। পরের বছর আরও বড় আঘাত, ইংল্যান্ড সফরে স্পট ফিক্সিং এ নিষিদ্ধ তৎকালীন অধিনায়ক সালমান বাট, মোহাম্মদ আমির, মোহাম্মদ আসিফের মতো তারকারা। বিকল্প না পেয়ে সাময়িক দায়িত্ব তুলে দেওয়া হয় ১৯ টেস্টের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ৩৬ বছর বয়সী মিসবাহর কাঁধে। নির্বাচকরা বলেছিলেন যোগ্য অধিনায়ক না পাওয়া পর্যন্ত তত্ত্বাবধায়ক দায়িত্ব পালনের জন্য।

 

দায়িত্ব নিয়েই আবিষ্কার করলেন টেস্ট জেতানো কোন ম্যাচ উইনার নেই দলে। পেস আক্রমণে ওয়াসিম, ওয়াকার, আকিব, শোয়েবদের শেষ প্রতিনিধি আমির, আসিফরা নিষিদ্ধ, ফর্মে নেই অভিজ্ঞ উমর গুলও। ব্যাটিং বিভাগে নেই ইউসুফ, ইনজামামদের অভিজ্ঞতা। এখান থেকেই ব্যক্তিনির্ভর পাকিস্তানকে গড়ে তুললেন টিম পাকিস্তান হিসাবে। তার ছায়ায় বেড়ে উঠলেন আজমল, আজহার, ইয়াসির শাহর মতো আজকের তারকারা।

 

 

মিসবাহর সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব সম্ভবত দলকে ঐক্যবদ্ধ করা। একমাত্র বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়ক ইমরান খানের দল ঠাসা ছিল ওয়াসিম, ওয়াকার, আকিব, মিয়াদাদ, জহির আব্বাস, আবদুল কাদিরদের মতো তারকায়। কিন্তু দলের ঐক্য কি পর্যায়ে ছিল একটি তথ্য থেকে বোঝা যাবে। ইমরানের অবসরের পর দশ বছরে এই দল থেকে পাক অধিনায়ক হয়েছেন নয়জন। পাকিস্তান ক্রিকেটের চিরন্তন দ্বন্দ্ব ব্যক্তিত্বের সংঘাত মিটিয়ে সাধারণ দল নিয়েই মিসবাহ গড়েছেন অসাধারণ সব কীর্তি। একটি উদাহরণ দিচ্ছি, ১৯৯৬ সালে ক্রিকেটমক্কা লর্ডসে ইংল্যান্ডকে হারিয়েছিল পাকিস্তান। দলে ছিলেন আমির সোহেল, ইজাজ, সাইদ আনোয়ার, ইনজামাম, সেলিম মালিক, ওয়াসিম, ওয়াকার, মুস্তাক আহমেদের মতো ম্যাচ উইনাররা। কুড়ি বছর বাদে মিসবাহর হাত ধরে ফের লর্ডসে ইংলিশদের হারালো পাকিস্তান। এই জয়ে নেতৃত্ব দিলেন শান মাসুদ, আজহার, আসাদ শফিক, রাহাত আলী, ইয়াসির শাহ্‌র মতো তরুণরা।

 

২০০৩ থেকে ২০০৭ পর্যন্ত ছিলেন ঘরোয়া ক্রিকেটের সেরা ব্যাটসম্যান। তবু ডাক পাননি জাতীয় দলে, হাল না ছেড়ে লড়াইটা করে গেছেন। হার না মানা মানসিকতাটা ছড়িয়ে দিয়েছিলেন দলের মধ্যে। কার্যকরী পেসার দলে না থাকায় সমর্থন জুগিয়েছেন আজমল, জুলফিকার বাবর, আবদুর রেহমানদের। ২০১৪তে আজমল নিষিদ্ধ হলে তুলে আনেন ইয়াসির শাহকে। ঠাণ্ডা মাথায় ইস্পাত কঠিন মানসিকতায়  মোকাবেলা করেছেন যেকোনো পরিস্থিতি। দশ টেস্ট সিরিজ জিতে এশিয়ার সেরা অধিনায়ক তিনি, পেছনে ফেলেছেন গাঙ্গুলি ও ধোনিকে। উপমহাদেশের অধিনায়কদের সাফল্যের চাবিকাঠি যেখানে ঘরের মাঠ, সেখানে দেশের মাটিতে কোন ম্যাচেই নেতৃত্ব দিতে পারেননি মিসবাহ।

 

 

দলকে অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে দিতে শুধু অধিনায়কত্ব নয়, ব্যাট হাতেও পথ দেখিয়েছেন। নিয়মিত সমালোচনার তীর ছুটেছে তার দ্রুত রান করার যোগ্যতা নিয়ে। জবাব দিয়েছেন ৫৬ বলে টেস্টের দ্রুততম সেঞ্চুরি করে। এই রেকর্ডে তার সঙ্গী কিংবদন্তী ভিভিয়ান রিচার্ডস। যে বয়সে গিলেস্পি, ভেট্টোরিরা কোচিং এ থিতু হয়েছেন সেসময় তিনি দেখাচ্ছেন বুড়ো হাড়ের ভেল্কি। ৩৬ বছরের পর করেছেন আট টেস্ট সেঞ্চুরি। এই বয়সে এতো সেঞ্চুরি করতে পারেন নি আর কোন ক্রিকেটার।

 

অবসরের ঘোষণা দিলেও এখনো খেলবেন তিন টেস্ট। অস্থিতিশীল একটি পাকিস্তান দলকে স্থিতিশীল অবস্থানে রেখে যাচ্ছেন। ভবিষ্যৎই বলে দেবে পাকিস্তান মিসবাহর দেখানো দলীয় ঐক্যের পথে হাঁটবে নাকি ফিরবে তার পুরনো পথে।